লেখা আসলে অস্তিত্বের হয়ে ওঠা যা নির্মাণ
দেবজ্যোতি রায়
একজন কবি বা লেখক আসলে নিজেকেই লেখেন , লেখায় সঞ্চালিত হয় তাঁরই নিজের রক্ত ; সে হিসেবে তাঁর প্রতিটি লেখাই তাঁর আত্মজীবনী বই কিছু নয় যে আত্মজীবনী তাঁকেই নির্মাণ করে , তিনি হয়ে ওঠেন ।
জন্মাবার পর থেকে ক্ষমতা সৃষ্ট থাকবন্দি কাঠামোগুলির মধ্য দিয়ে বড় হতে হতে আমাদের যে নির্মাণ ঘটে সেই নির্মাণ ক্ষমতার নির্মাণ, ছাঁচে ঢালাই হতে থাকি আমরা যা ক্ষমতার স্বার্থকে পুষ্ট করে । স্রষ্টার নির্মাণ যেহেতু তাঁর নিজেকেই নির্মাণ , ক্ষমতা দ্বারা নির্মিত ছাঁচ ভেঙে বেরিয়ে আসতে হয় ফলে তাঁকে। নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে শূন্য়ে গিয়ে পৌঁছান তিনি । শূন্য থেকেই শুরু হয় তাঁর নিজস্ব নির্মাণ, - সৃষ্টি ।
অস্তিত্বের যদি কোনো সার্থকতা থেকে থাকে তবে তা এই সৃষ্টিকর্মের মধ্যেই নিহিত ; এর বাইরে কোনো সার্থকতা নেই , থাকতে পারে না । সৃষ্টিহীন অস্তিত্ব সেই ভেড়ার পালের মতো যেখানে আগেরটির নিতম্বের চলন দেখে পরেরটি চলতে থাকে ভাষাও তো ক্ষমতারই নির্মাণ ; ক্ষমতা তার সৃষ্ট ভাষার মধ্য দিয়ে আমাদের রক্তে তার নন্দনতত্ত্ব, তার মূল্যবোধগুলি ঢুকিয়ে দিতে থাকে আর জানাতে থাকে - এ সবই চিরন্তন । যদিও ঘটনা এটাই যে কিছুই চিরন্তন নয় । চিরন্তন সত্য বলেও কিছু নেই । সত্যও এক নির্মাণ ছাড়া অন্যকিছু নয় । ক্ষমতা তার সত্য নির্মাণ করে , একজন কবি বা লেখক নির্মাণ করেন নিজের সত্য । ফলে ক্ষমতার ভাষাকে আক্রমণ করতেই হয় একজন কবি বা লেখককে আর নির্মাণ করে নিতে হয় নিজস্ব ভাষাকে যা তাঁকে তাঁর নির্মিত সত্যের কাছে পৌঁছে দেবে । ক্ষমতা ভাষার মাধ্যমে বাস্তবের যে একমাত্রিক ফ্রেমটাকে আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেয় তাকে ভেঙে বাস্তবের একাধিক মাত্রায় পৌঁছতে ও লেখায় তা তুলে আনতে ভাষাকে আক্রমণ তাই জরুরী এবং ভাষাকে আক্রমণ আসলে ক্ষমতাকেই আক্রমণ । প্রথা ও প্রচলিত যা কিছু সেসব কে আক্রমণ । নিজস্ব সময় খন্ডের বহুকণ্ঠকে তুলে আনা লেখায় কবিতায় যা সবচেয়ে সফল রূপ পায় ।
ভাষাকে আক্রমণ বলতে ক্ষমতা শব্দের যে অবস্থান ও অর্থ ঠিক করে দেয় একজন কবি ও লেখক তা পালটে দেন । তিনি পালটে দেন বাক্যগঠন রীতি , কার্য - কারণ সম্পর্ক , এলোমেলো করে দেন ক্ষমতার ভাষাকে , এমনকী ক্ষমতার ভাষায় বর্জনীয় অনাভিধানিক শব্দগুলিকেও তিনি তুলে আনতেই পারেন । ভাষা বহন করে চেতনাকে আর চেতনা বিস্ফোরক হলে ভাষাও বিস্ফোরক হতে বাধ্য ।
একজন কবি বা লেখক তিনি নিজেকেই নির্মাণ করেন , র্নিমাণ নিজস্ব সত্য , তাকে যাত্রা করতে হয় , উদ্দীষ্ট স্থানে পৌঁছানো যাবে না জেনেও তাঁর এই আজীবন যাত্রা আর এই যাত্রাপথের অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্য দিয়েই তিনি স্পর্শ করেন সময়ের ভেতরে থাকা সময়কে ,সময়ের বহু মাত্রাগুলিকে , নির্মাণ করেন নিজেকে , নিজের সত্যকে , তিনি হয়ে ওঠেন , অস্তিত্বে মূল্য আরোপ করেন তিনি । কবিতা বা গল্প- উপন্যাস , সৃষ্টি যা-কিছু , এই হয়ে ওঠা ব্যতিরেকে , এই নতুন নির্মাণ ব্যতিরেকে অন্যকিছু নয় । নিজের সিগনেচার , যা তাকে বহু-র থেকে আলাদা করে , গড়েও ওঠে এভাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন