গানের ভিতর দিয়ে যখন
সে ছিল আমাদের হাজার বছরের পুরোনো গান। কি যাদু বাংলা গানে। গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে। আমাদের সেই হাজার বছরের পুরোনো গানে নৌকা বাইবার কত কথা। খুঁজে পেতে তুলে ধরলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।
ওই যে চর্যাপদের ভাষাটা নিতান্তই বাংলা, এটা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মশায়কে রীতিমত প্রমাণ করে দেখাতে হল। তার আগে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মশায় ওটি নেপালের রাজ দরবারের লাইব্রেরি ঘেঁটে আবিষ্কার করলেন। । তার মানে সেটা চালু ছিল না। মুনিদত্তের একটা টীকা খুঁজে পাওয়া গেল। তাও সংস্কৃত ভাষায়। তাতে অর্থ কিছু কিছু স্পষ্ট হল। এ যেন সেই হারানো রাজপুত্রের গল্প। তাকে যারা চিনত, জানত, তারা কেউ কোথাও বেঁচে নেই। কেমন নাক, কেমন চোখ, গলার স্বর কেমন কেউ জানে না। অয়েল পেন্টিং দূরস্থান, রাজবাড়ীর কোনো গ্ৰুপ ছবিতে পর্যন্ত তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। কারো স্মরণে নেই। এবার কি তাহলে ডি এন এ টেস্ট হবে? উপস্থিত বুদ্ধি তো সেটাই বলে। সেই আমাদের হাজার বছরের পুরোন গান। কেউ বলে চর্যাগীতি, কেউ বলে চর্যাগাথা। কেউ বলে উঁহু, না না , নাম তার চর্যাচর্যবিনিশ্চয়।
ভাষাও বোঝা সাধারণের কর্ম নয়, লিপিরও সেই দশা। তবু বাংলা। আর সেটাই ঠিক। বিজ্ঞানঘটিত প্রমাণ।আমাদের অস্তিত্বের ভেতরে ভেতরে বিজ্ঞান এমন কাজ করে।
গল্পটা তাহলে কেমন দাঁড়িয়ে গেল? সেই যেন মা হারা ছেলে জঙ্গলে নেকড়ে বাঘের দুধ খেয়ে বড় হয়েছিল। বলছ বাংলা, কিন্তু খুঁজে পেলে বাপু নেপালের লাইব্রেরি ঘেঁটে। হয় কথায় নয় কথায় যাঁদের লাইব্রেরি পোড়াতে হাত নিশপিশ করে, তাঁরা মনে রাখুন। আর মানেটা বোঝার সুবিধে হল মুনিদত্তের সংস্কৃত টীকা থেকে। ওর নাম "নির্মলগিরা"। ভাল করে বলতে গেলে নির্মলগিরার তিব্বতি অনুবাদ। চর্যাটীকার খাঁটি পাঠ পাওয়া গেল ওই তিব্বতি অনুবাদে। বাংলাভাষার এই প্রত্নসম্পদ কি করে বৌদ্ধগানের মধ্যে খুঁজে পাওয়া গেল, তার শিকড় সন্ধান করতে গেলে ব্রায়ান এইচ হজসনের নামটা এসে যায়। তিনিই নেপাল থেকে বৌদ্ধপুঁথি সংগ্রহ করে প্রাচ্যবিদ্যাচর্চায় আগ্রহী মানুষদের কাছে পাঠাতেন।
নাম এসে যায় ইউজিন বার্ণউফ এরও। ড্যানিয়েল রাইট আর সিসিল বেনডালকেও ভোলা চলে না।
তাহলে কি মনে হচ্ছে? নেপালের লাইব্রেরি, সংস্কৃত টীকা, তার আবার তিব্বতি অনুবাদ, বিদেশী পণ্ডিতের অকুণ্ঠ আগ্রহ, সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীরে আমার বাংলার জন্ম? আমরা শুরু থেকেই "বিশ্ববাংলা" ? আমাদের মনে মেজাজে আন্তর্জাতিকতা স্থান পেতে দেরি কিসের?
উঁচু উঁচু পর্বত। সেখানে থাকে শবর তরুণী। পরনে তার ময়ূর পুচ্ছ, আর গলায় তার বনফুলের মালা। তার মুখটি কি পান পাতার মতো? তার হৃদয়টা কি পানের মতো করেই আঁকি না এখানে ওখানে! আহা কর্পূর দিয়ে মিঠে পান খাই আর সহজ সুন্দরীর মুখটি মনে ভাসে। কি চমৎকার করেই না আমার মনের কথা আগে ভাগে জেনে লিখে গিয়েছেন শবরপাদ। গান ধরেছেন বলাড্ডি রাগে। চর্যাগাথার আঠাশ নং কবিতায়।
তার পর জানা গেল শবর তরুণীটি আসলে কবির ঘরণী। সে ছল করে অমন সেজেছে। আমাদের চেনা জানা চণ্ডীও শিবের সাথে অমন ছল করতেন। খাটো পোশাক পরে মাছ ধরতেন। আর তাকে পরস্ত্রী মনে করে শিবের সে কি কাম পিপাসা!
কাম নিয়ে নানারকম মজা চর্যাগাথায়।
আবার পড়ব আঠাশ নং চর্যা গান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন