মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

সুরমা গাঙর পানিঃ পাঠ প্রতিক্রিয়ায় প্রলয় নাগ




সুরমা গাঙর পানি: দেশভাগ ও নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবন আখ্যান 

প্রলয় নাগ



‘বোদলেয়ারের বন্ধু থিয়োফিল গোতিয়ের একটি অণু-কবিতায় জানিয়ে ছিলেন, কালের প্রহর ছোটখাটো শিল্প সইতে পারে না। ‘Only the strong art is eternal!’ এই নিরিখে মহাকাব্য আর ভাস্কর্যকে বলা যেতে পারে ‘শক্তিশালী শিল্পকলা’ অর্থাৎ শুধু তাদেরই আছে ‘frozen music of time’ ধারণের ক্ষমতা। উপন্যাস মহাকাব্যের উত্তরসূরি, বয়নে অন্তর্বয়নে ভাস্কর্যপ্রতিম। অতএব উপন্যাসিক প্রতিবেদনে সময় স্বভাবের আলোছায়া সবচেয়ে চমৎকার ভাবে ব্যক্ত  হতে দেখব, এটাই ঈপ্সিত।’’ (উপন্যাসের প্রতিবেদন: তপোধীর ভট্টাচার্য)। আর এই মহাকাব্যিক দ্যোতনায় উপস্থাপিত হয়েছে বাঙালির জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজিক আখ্যান—দেশভাগ, রণবীর পুরকায়স্থের কলমে। ‘সুরমা গাঙর পানি’তে রণবীর পুরকায়স্থ কেবলমাত্র দেশভাগেরর ঘটনাকেই তুলে ধরে ক্ষান্ত হননি বরং তাঁর আখ্যানের কথাবস্তু নির্মাণ হয়েছে কিছুটা আগের সময় থেকেই। শিকড়ের সন্ধান, মাটির  সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর কথাই বেশি করে পাই রণবীর পুরকায়স্থের কথাভুবনে। দেশভাগ যখন সমগ্র বাঙালি জাতিসত্তাকে খণ্ডিত করেছে, তার প্রভাব নিম্নবর্গীয় নিঃস্ব মানুষগুলোর ওপর কীভাবে পড়েছে, সে-কথাই যেন বারবার বলেছেন প্রতিবেদক। উপন্যাসে ‘ভাটিপর্ব’ থেকে ‘উজানপর্ব’-- সমস্তটাই যেন উত্তরপূর্ব তথা ঈশান বঙ্গে বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাবে বেঁচে থাকার লড়াইকে বড় করে দেখিয়েছেন। ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষিতভূমি থেকে তুলে এনেছেন ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রগুলোকে। প্রত্যেক চরিত্রের নিখুঁত উপস্থাপন যেন, প্রতিবেদনটির সার্বিক গ্রহণযোগ্যতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়।      
        ‘সুরমা গাঙর পানি’  রণবীর পুরকায়স্থের এখনো পর্যন্ত লেখা একমাত্র উপন্যাস। প্রতিবেদনটির আখ্যান বৃত্তে  রয়েছে দেশভাগ, পাশাপাশি তার অন্তরে  বেঁচে থাকা মানুষের কথা। দেশভাগ যেখানে উপন্যাসের বিষয় হয়ে আসে সেখানে লেখকের ব্যক্তি জীবনের একটা প্রভাব লক্ষ করা যায়। হয়তো-বা এই প্রতিবেদনটিতেও রয়েছে। উপন্যাসের ভূমিকাংশে লেখক বলেছেন:  ‘দেশভাগ দেখেছেন আমার মা-বাবা, আমি দেখেনি। একটু বড়ো হয়ে শুনেছি, স্মৃতিহীন পরম্পরাহীন ভাঙা মানচিত্রে অবহেলিত ছিটমহলে থাকার যা সুবিধা পেয়েছি--- স্বাধীনতা এরে কয়। ছেলেবেলা  থেকে স্রোতের শ্যাওলা হয়ে  ভেসে বেড়িয়েছি। আমার আপন ভাষাকেও আঁকড়ে থাকার উপায় নেই ছিটমহলে।…. বাড়ি যেখানে তা পরদেশ।’ এই আখ্যান মূলত বৈতলের ভেসে বেড়ানো জীবন। কোথাও স্থায়িত্ব নেই। লেখক দুটি পর্বে উপন্যাসটি সমাপ্ত করেছেন। ‘ভাটি পর্বে’ বৈতলের বৈতল হয়ে ওঠার কথা আর ‘উজান পর্ব’ সর্বস্ব হারানো একজন মানুষের টিকে থাকার কথা। উজান পর্বের কাহিনির নির্মাণ হয়েছে ভাটি পর্বের ভিতের ওপর। ছোটোবেলা থেকে বৈতল মানুষ হয় এক জল-জঙ্গল ঘেরা  পরিবেশে। বাপ বলে: ‘হেই বৈতল পানিত লাম। নেমে যায় বৈতল অগাধ জলে। জলের অতল থেকে তুলে আনে আধমণি বোয়াল। বাপ দেয় সাবাশ। বলে, ---অউ না হইলে মাইমলর পুত!’
        বাইয়াখাউরির পাটনির ছেলে বৈতলের ভেতর কোনো ভয়-ডর নেই। এমন-ই দুরন্ত তার পরান। সে লক্ষ করে তাঁর বাপ মায়ের মধ্যে এক ঢলানি-জিয়ানির সম্পর্ক। বৈতলের তা ভালো লাগে না। ‘খাওয়ার সময় ভাত দে, হাওরে জলে যাওয়ার সময় জাল দে, এছাড়া বাপ কোনো কথা বলে না মার সঙ্গে। চারপাশে এত সুন্দর জল হাওরের পরিবেশে কেন তাঁর বাপ-মায়ের  মনে এত কষ্ট। বৈতল ছুটে যায় জৈন্তেশ্বরী মন্দিরে, দু’পয়সা এক আনা ছুঁড়ে দিয়ে বিগ্রহের কাছে বাবা মায়ের মিলের জন্য প্রার্থনা করে। সমগ্র উপন্যাসে আমরা যে-বৈতলকে পাই তাঁর জীবনবোধ গড়ে উঠেছিল শৈশব থেকে।  তাঁর প্রতি অন্যায় অত্যাচার মেনে নেয়নি।, এমনকী সমগ্র জীবনে  কখনও মাথা নোয়ায়নি। রীতি-নীতি বর্হিভূত তাঁর জীবন হতে পারে কিন্তু সে জীবনেও তাঁর আদর্শ রয়েছে। দোষীকে নিজে হাতে শাস্তি দিয়েছে। মন্দির থেকে পুরোহিত তাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যে তাড়িয়ে দিলে, বৈতল তার প্রতিশোধ নেয়। পাগলার দাম বাড়ির বৌ-ঝিদের শরীর থেকে এক বিছে হার নিয়ে পালায়। একই রকম ভাবে, পেশকার বাড়ির বুড়ি যখন বৈতল-কে চোর অপবাদ দিয়ে চাকর বলে সম্বোধন করে, বৈতল তার প্রতিবাদ করে বলে: ‘চুর কারে কছ। চাকর কারে কছ। চাকর তো তোর বাপ, হাকিমর  গোলামি করে, আবার বড় বড় মাত। তোর কিতা বেটি অত ফুটানি।’ আর পেশকার বাড়ির মেয়ের কানের মাকড়ি ছিঁড়ে পালায়। আর দেশভাগ ও বন্যা পরিস্থিতির মাঝে বন্ধু লুলা যখন বন্ধু থেকে মুসলমান হয়ে গিয়ে দুর্গাবতীর দিকে হাত বাড়ায় তখন বৈতল লুলাকেও ক্ষমা করেনি। পিয়াইনের স্রোতে লুলার লাশ ভাসিয়ে দিয়ে মন্ত্র উচ্চারণ করে: ‘বিসমিল্লার রাহমানির রহিম।… পবিত্রোপবিত্রবা।’
        মায়ের মতো বৈতলের জীবনের সাথে একসময় জড়িয়ে গিয়েছিল লুলাও। লুলার বয়স দশ, মাতৃহারা হয়ে বেরিয়ে পড়ে গান গাইতে। লুলাট জীবন বৈতলের মতো না-হলে অনেকটাই চালচুলোহীন। ' কোন গুণ নেই লুলার, মায়ের জন্য কাঁদে, ক্ষিদে পেলে চুরি করে। লুলা গান শোনে, গান গায়। সারি গানে চটুল কথায় মজে লুলা। গানের পাকা পাকা কথা বেশি দিন ভালো লাগেনি বলে ওস্তাদের খুতি নিয়ে পালায়। ঘাটুর পুয়া হয়ে হিন্দু বাড়িতেও কিছুদিন কাটিয়ে দেয় লুলা দাস হয়ে। লুলা কী বেজ কী দাস। কী হিন্দু কী মুসলমান।  ভালো লাগলে থাকে ভালো না লাগলে চুরি করে পালায়।' এহেন লুলাকে আপন করে নেয় বৈতলের মা। আর এই লুলার সঙ্গে স্মৃতি জড়িয়েছে বৈতলের।  দু'জনে মিলে অনেক জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছে। লুলা বৈতলকে  সাপ ধরা শিখিয়েছে। বৈতলের অনুপস্থিতিতে লুলা মায়ের শেষকৃত্য সম্পন্ন করেছে। আর এই বন্ধু লুলা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে দিলবাহার বাঙাল।  গুরু সৃষ্টিধর ওঝার কথাও মিথ্যে হয়ে যায় : ' আর হে কুনু মুসুলমান নি, হে তো তুমার বন্ধু। বন্ধুর কুনু জাত নাই রেবা।' লুলাকে হত্যা করলেও বৈতল সারা জীবন ধরে লুলা স্মৃতি বহন করে চলেছ। পরবর্তীতে 'উজান পর্ব' -এ দুখু, বছই, আপদ---- এরা কেউ লুলা জায়গা দখল করতে পারেনি।  বৈতলের জীবন গড়ে ওঠার পেছনে তাঁর মা ও গুরু সৃষ্টিধর ওঝা ভূমিকা উল্লেখযোগ্য।  বাবা যেখানে  খলুইয়ের ভেতর আলাদের বাচ্চা রেখে বৈতল-কে মারতে চায়।  বৈতলও তেমনি 'পাটনির পুত' যে আলাদের বাচ্চা কে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তার পরিবর্তে  বাপের দিকে যে-প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় তার উত্তর খুঁজে পায় না বৈতলের বাপ।  মায়ের মৃত্যু বৈতলের জীবনে এক শূন্যতার সৃষ্টি করে। কোনো কিছু না-থাকার মধ্যে মাকে ঘিরে যে-জগৎ বৈতলের গড়ে উঠেছিল সেটাও ভেঙে যায়।  বৈতল সম্পূর্ণ একা হয়ে যায়।  বৈতল আর তার গুরু সৃষ্টিধর ওঝার কাছেও ফিরতে চায় না।  বৈতলের জীবন দর্শন  ও সার্বিক জীবনবোধ গঠনের পেছনে  গুরু সৃষ্টিধর ওঝার ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সৃষ্টিধর ওঝা, বৈতল ও কথক সত্তা কোথাও কোথাও যেন মিলে মিশে  যায়। বৈতল যখন একা---- দুঃসময়ের মধ্যে, তখন সৃষ্টিধর ওঝার কথাগুলি বৈতলের জীবনীশক্তি হয়ে ওঠেছে। কেবল মনসাপুঁথি নয়, গুরু বৈতলকে শিখিয়েছে, চিনিয়েছে জীবনের পথ ও পাথেয়কে। সৃষ্টিধর ওঝার মতো সর্বজনগ্রাহ্য একটি চরিত্রও বাংলা সাহিত্যে বিরল। উজান পর্বে বৈতলের মনে যখন বিরূপ চিন্তা প্রবেশ করেছে তখন গুরু সৃষ্টিধর ওঝা তাকে যেন নিভৃতে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। 
        উপন্যাসটির বিস্তৃত ক্ষেত্র নির্মাণ করা হয়েছে যার ওপর, তা হল দেশভাগ। দেশভাগ থেকেই উদ্ভূত সমস্যা দাঙ্গা, হিন্দু-মুসলমান বিভেদ পরিশেষে হাজার হাজার মানুষের বাস্তু ত্যাগ। 'সুরমা গাঙর পানি'তে লেখক সেই সমস্যা তথা রাজনৈতিক কূট-চক্রান্তের শিকার মানুষগুলির কথা আমাদের শুনিয়েছেন। যাদের  মনে কোনোদিন ছিল না, দেশভাগের মতো ঘটনা ঘটতে পারে।  আজন্ম লালিত বিশ্বাস সংস্কৃতির মেলবন্ধনে গড়ে ওঠা মানুষগুলোর জীবন ছলচাতুরি করে রাজনৈতিক পাশার গুটির কাছে পরাজিত হয়ে সর্বস্ব হারাতে হবে।  লেখক সেই চিত্র বৈতলের মতো মানুষের মধ্যে দিয়ে অঙ্কন করেছেন।  দেশ ভাগ হবে, কোনও অংশ হবে পাকিস্তান আর কোন অংশ হবে হিন্দুস্তান---- এ নিয়ে দেশের অন্যান্য অংশের মতো সুরমা তীরবর্তী মানুষেরাও চিন্তিত। কেউ জিগির তোলে ধর্মের দোহাই দিয়ে আবার কেউ রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভে। শেষপর্যন্ত দেশটাও ভাগ হয়ে যায়। ১৯০৫ থেকে ১৯১১-র বঙ্গভঙ্গ রদ করার জন্য যে আবেগ নিয়ে মানুষ পথে ঘাটে নেমে এসেছিল তা দেখা গেল না ১৯৪৭-এ। ঈশান বাংলার সঙ্গে এই খেলাটা বারবারই হয়েছে। ১৮৭৪- এ সিলেট-কাছাড়-গোয়ালপাড়ার মতো বাংলাভাষি অঞ্চলকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে আসামের সঙ্গে।  আবার ১৯৪৭- সিলেট জেলার কিছু অংশ পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সীমার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আলোচ্য প্রতিবেদনে লেখক সেই দহলবেলার প্রকৃত বাস্তবটি তুলে ধরেছেন। বাস্তুহারা হওয়ার আশঙ্কার কথাগুলি শুনিয়েছেন। প্রতিবেদনে বৈতল গিরিবাবার কাছে জানতে চায়:
 '--- আইচ্ছা বাবাজি ইতা ঠিক নি কথা।
--- কী কথা বা।
--- আউবে খেদাই দিব। ঘরবাড়ি নিব গি।
---শুনা কথাত বিশ্বাস করিও না। অইলে তো অই বউ, কিতা করবায়, গুলার পানি আটকাইতায় পারবানি।
--- সিলেটও পাকিস্তানো যাইব গি। আমরার সুনামগঞ্জও।
--- অ বা বৈতল। হিন্দুস্তান পাকিস্তান দিয়া আমরার কিতা কও। গরিবর হক্কক খানউ কাম করি খাওন লাগব। তুমি তো ইলাখান মানুষ নায়।'
        নিম্নবর্ণের মানুষের কাছে হিন্দুস্থান-পাকিস্তান সব জায়গাই সমান। উপন্যাসেও দেখি নিম্নবর্ণের মানুষদের নিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে জোর সাওয়াল করেন যোগেন মণ্ডলের মতো কিছু নেতারা। তবে লেখক বিভেদের মধ্যে থেকে যেন বাঙালি সংস্কৃতি তথা মানুষের মেলবন্ধনকেই প্রশ্রয় দিয়েছেন। দেশভাগের থেকে উদ্ভূত বৈরিতা মানুষকে আলাদা করে দিলেও বাঙালি জাতিসত্তার মূলে যে-সমন্বয় তথা মেলবন্ধন তা আমরা পাই বন্যা কবলিত মানুষের আশ্রয়ের জন্য কালী মন্দিরের উঁচু টিলাতে ছুটে আসতে দেখে।  বৈতল-লুলা পরদিন এক পাশবিক মনোবল নিয়ে পীড়িত মানুষের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে। আবার এই লুলাই শেষপর্যন্ত বৈতলের বন্ধুত্বের পরিচয ছেড়ে মুসলমান হয়ে ওঠে। হিন্দু নারীর দিকে হাত বাড়ায়।  শেষ পরিণতি বৈতলের হাতে মৃত্যু।  'উজান পর্ব'-এ দেখি বৈতলের আরেক সাথী দুখুকে। যে তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বন্ধু হয়ে বৈতলের জীবন বাঁচায়। অর্থাৎ মানুষের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় কেবলমাত্র কোন ধর্ম দিয়ে নয় বরং মানবিক সত্তা দিয়েই বিচার্য হওয়া উচিত--- উজান পর্বের দুখু আমাদের সেই বার্তাই দেয়।
উপন্যাসে আরও একটি বিষয় জায়গা করে নিয়েছে তা হল, দেশভাগ থেকে উদ্ভূত প্রব্রজন বা উদ্বাস্তু সমস্যা। হাজার হাজার নরনারী যখন গৃহহারা  হয়ে এক অনিশ্চয়তার দিকে পা বাড়ায় সেখানে বৈতল কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা।  সে কিছুতেই চায় নি তাঁর দেশ ত্যাগ করতে। বাইয়াখাউরি, রোদপুয়ানি, মিরতিঙ্গা, ছাতক, পাগলা, সুনামগঞ্জের যে-বিস্তৃত ভূমিতে বৈতল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। সে চায়নি তা ফেলে আসতে। এমনকী বন্ধু লুলাকে হত্যা করার পর সে মনস্থ করে কিছুদিন বাইরে বাইরে কাটিয়ে আবার ফিরে আসবে। আর তখনই তাঁর জীবনে আসে দুর্গাবতী। আর দুর্গাবতীর কথা ভেবেই সে দেশ ছাড়ে।  দুর্গাবতীকে ভালোবেসে ঘর বাঁধে।  ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, পরবর্তীতে হরিৎবরণ জমিদার বাড়ির পুকুর পাড়ে আশ্রয় নেয়। বৈতলের ভূত-ভবিষ্যৎ বদলে যায়। নতুন জীবনে বেঁচে থাকর জন্য বৈতল নতুন করে সংগ্রাম শুরু করে। দেশভাগ ও পরবর্তী পরিস্থিতি তুলে ধরতে লেখক তৎকালীন শিলচর শহরের রাজনৈতিক ও সামাজিক ছবিকে ফুটিয়ে তুলেছেন। যেখানে একদিকে সমস্ত কিছু হারানো বৈতলের মতো মানুষদের মিছিল, অন্যদিকে আবার জমিদার যমুনাপ্রসাদের মতো একদল মানুষের শাসানি: 'হিন্দুস্তানো ইতা চলত না। ইখানো থাকলে হিন্দুর মতো থাকন লাগব। হিন্দুস্তানো হিন্দু অউ থাকব। পাওর তলর বেঙ অইয়া পাওর তলে থাকতে পারলে থাকো, নাইলে ভাগো।' উজান পর্বের  সমস্ত কাহিনি গড়ে উঠেছে বৈতলের পরবর্তী জীবন নিয়ে। তাতে স্থান পেয়েছে দেশভাগের রাজনীতি, শ্রেণিদ্বন্দ্ব, দুর্গাবতীর জীবনও। ভাটি পর্বে যে বৈতলকে আমরা পাই, উজান পর্বের বৈতল যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ছন্নছাড়া বৈতলের মতি, কোথাও যেন স্থায়িত্ব পাচ্ছে না।  এমনই ভাসমান হয়ে ওঠে তাঁর জীবন। আসলে এই শ্যাওলার মতো ভাসমান জীবন তো বৈতলের নয়, সে সময় কার হাজারও প্রব্রজিতা সত্তার।

'উজান পর্ব' - এ দুর্গাবতী চরিত্রটিকে পাই সম্পূর্ণ নতুন ভাবে।  বলা যায় শুধু দুর্গাবতীই নয়, উপন্যাসের প্রত্যেকটি চরিত্র তথা  সৃষ্টিধর ওঝা, গিরিবাবা, দুখু,বছই, আপদ যমুনাপ্রসাদ প্রত্যেকের প্রতিই যত্ন নিয়েছেন, মাঝপথে কোথাও ছেড়ে দেননি।  'ভাটি পর্ব'-এর শুরুতে আমরা দুর্গাবতীর নাম জানতে পেরেছি বা দু'একটি কার্যকলাপ।  এই দুর্গাবতীই 'উজান পর্ব' -এ বৈতলের নিয়ন্ত্রী।  বৈতলের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়নি অথচ সহবাস করছে। জন্ম নিয়েছে এক কন্যা সন্তান। দুর্গাবতীর কথা মতো বৈতল নাম বদলেছে। কৈবর্ত থেকে হয়েছে ব্রাহ্মণ কন্যা দুর্গাবতীর স্বামী সৃষ্টিধর শর্মা। কিন্তু বৈতল কোথায়ও যেন মেনে নিতে পারেনি তাঁর এই নাম। বৈতলের নামের সঙ্গে জলের গন্ধ লুকিয়ে ছিল, বাপ তাকে বলত: 'হৈই বৈতল পানিত লাম।'  আর গুরুর নামের মধ্যে সে তা খুঁজে পায় না। প্রতিবেদনে দেখি বেতলের এই বার বার নাম বদলানো তার গ্রহণযোগ্যতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এ যেন অস্তিত্বহীন মানুষের যে-কোনো ভাবে লড়াই করে বেঁচে থাকার প্রয়াস।  আবার নামকরণের মধ্যে দিয়ে লেখক এক শ্রেণিচেতনার পরিচয় দিয়েছেন।  জমিদার যখন বৈতল কন্যার নাম রাখে 'তিলোত্তমা' তাও যেন বৈতলের মনঃপূত হয় না। কেন-না বৈতলের কন্যার নামে আভিজাত্য কেন থাকবে---- নাম হবে বৈতলের মতোই।  তাই বৈতল নাম রাখে মণি--- মরণি। দুর্গাবতীও যেন সার্থকনামা। ছন্নমতি বৈতলের সংসারকে আগলে রেখেছে। বৈতল যেখানে কারো কাছে বাধা পড়ে না, সেই বৈতল দুর্গাবতীর কাছে ধরা পড়েছে।  দুর্গাবতীকে নিয়ে  বৈতলের দুঃশ্চিন্তা  শেষ নেই। কেন-না  দুর্গাবতী সুন্দরী। বৈতল বুঝতে পারে না, এক কথায় অতল জলে বৈতল যেন তল খুঁজে পায় না : 'দুর্গাবতীর গভীরে ডুব দিয়ে বৈতল তল পায় না। দুর্গাবতী এদিকে হাসলে ওদিকে পাড় ভাঙে। হেডমাস্টার বলে কাঁখে গাগরি। বৈতল দুর্গাবতীর কাঁখের বাঁক দেখেছে। উপমা সঠিক হয়েছে।......  বৈতল মনের অনেক দুর্গতির কারণ হয়েছে বৌ দুর্গাবতী। কখনও খরস্রোতা করাল বদনা কখনও মিঠে পানির ভরা কলস।"
জমিদার যমুনাপ্রসাদের সঙ্গে দুর্গাবতীর সম্পর্কও বৈতল মেনে নিতে পারে না। জমিদার বাড়িতে দুর্গাবতী কাজ করে উপার্জন করে বৈতলের তাতেও সন্দেহ। দুর্গাবতীকে নিয়েই যেন জমিদারের সঙ্গে বৈতলের লড়াই। বৈতল যখন উপযুক্ত শাস্তি জমিদারকে দিতে চায় দুর্গাবতীর জন্য তাও পারে না। দুর্গাবতী ও বৈতলের সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যে আখ্যানের গতি যত এগিয়ে যায়, বৈতল যেন  বুঝতে পারে দুর্গাবতী বৈতলের সঙ্গে এক খেলায় মত্ত।  বৈতল মনে মনে চায় ব্রাহ্মণ কন্যাকে শিক্ষা দিতে, ছন্নছাড়া মতি নিয়ে সে তাঁর বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, মদ্য পান করে পতিতাপল্লিতে রাত্রি যাপন করতে চায়, কিন্তু সেটাও বৈতলের দ্বারা হয় না, এমনি জীবন বৈতলের। শেষপর্যন্ত বৈতল উপলুব্ধি করতে পারে, দুর্গাবতীই যেন তার অন্তিম অবস্থান। আর দুর্গাবতীর ভরসাও একমাত্র বৈতল। বৈতল বুঝতে পারে : 'দুর্বিনীত জমিদার  আর তার সুন্দরী স্ত্রী দুর্গাবতীকে নিয়ে সমস্যা নেই বৈতলের।  বৈতল চেনে তাঁর বৌ দুর্গাকে  বৈতল যেমন দুর্গাও তেমন। এক ধাতুতে গড়া। জমিদার চাইলেই দুর্গাবতীকে অধিকার করবে এমন ক্ষমতাবান নয় ভূস্বামী। দুর্গাবতী তার মর্জির মালিক।'
        প্রতিবেদনটির আপাত সমাপ্তিতে দেখি ষাটের বন্যায় বৈতল জলমগ্ন শহর ছেড়ে আবার কলার ভেলা ভাসায়---- তখন সঙ্গী হয় দুর্গাবতী ও কন্যা তিলেত্তমা। আর পিতা-কন্যার সংলাপে উঠে আসে ছিন্নমূল জাতিসত্তার প্রকৃত বাস্তবটি :
'--- বাবা, আমরার কুনু বাড়ি নাই নি?
--- না, নাই গো মাই।
--- চান্দর আছে, অতবড় মহল, আমরার নাই।
--- আছিল সব অউ বেটি। কিন্তু এক চেংমুড়ি কানিয়ে কাড়ি নিলা সব।'
'সুরমা গাঙর পানি'র প্রতিবেদনটি দেশভাগ বা তার পরবর্তী প্রব্রজন সমস্যা জর্জরিত দেশকালের চিত্র থাকলেও প্রতিবেদনটির মূল সুর কিন্তু লেখকের শ্রেণিচেতনার পরিচয় দানে।  লেখকের দেখার চোখ সমাজ বা ক্ষমতার ওপর থেকে নয় বরং সমাজে বসবাসকারী নিম্নবর্গ তথা নিম্নবর্ণের  মানুষের জীবন-ভূমি থেকে। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে যেমন বৈষম্য আছে তেমনি রয়েছে এক শ্রেণীসংগ্রাম তথা লড়াই করে বেঁচে থাকার কথাও।  উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বৈতলের জীবনই উপন্যাসের মূল বিষয়। বৈতলকে সমৃদ্ধ করতে এসেছে তার মা-বাবা, বন্ধু লুলা-সৃষ্টিধর ওঝা।, গিরিবাবা, দুখু, বছই, আপদ-রা।  ভাটি পর্বের বৈতল থেকে উজান পর্বের বৈতলের মধ্যে যে তফাৎ তার জন্য দায়ি দেশ-কাল-রাজনীতি, দুর্গাবতী ও জমিদার যমুনাপ্রসাদ। 'পাটনির পুত' বৈতল দেশ-ভিটে-মাটি-স্বজন হারিয়েও কোথাও পরাজয় মেনে নেয়নি। বরং অন্যকে আশ্রয় দিয়েছেন বীরত্বের সঙ্গেই।  দুর্গাবতীর সহায় হয়েছেন বৈতল। বৈতল সম্পদে নয় বরং মনের ধনে ধনী সে।  জল হারিয়ে বৈতল পেয়েছে শহরের মাটি, শহরের গলিতে গলিতে রিকশা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে, উপার্জন করতে চেয়েছে।  জমিদার সঙ্গে তাঁর যে-দ্বন্দ্ব তা যেন অনেকটাই শোষক ও শোষিতের পর্যায়ের। বরং বৈতল জমিদারের কাছে পরাজয় স্বীকার না-করে জমিদারকেই তাঁর কাজে লাগিয়েছে। নিম্নবর্গীয় প্রান্তিক জীবন দেখার চোখ লেখকের তীক্ষ্ণ যে, লেখক প্রত্যেক চরিত্রের জীবন শৈলীকে তুলে ধরেছেন। লুলা-বৈতলের যে-সম্পর্ক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসেও আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। পরবর্তীতে দুখু, বছই, আপদেরা যেন বৈতলের অপরসত্তা। লেখক দুখুর পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছেন: দুখুই ইচ্ছে করে বৈতলকে রাগিয়ে দেয়। বৈতলের নাকের ডগায় গোফ তৎক্ষণাৎ রাগে সব ভস্ম করে। বৈতলের সেই গুলতি ছোঁড়া রাগের সময় চুপ করে থাকে দুখু। শুধু মুচকি হাসি দিয়ে তাতিয়ে দেয় বন্ধুকে। দুখু কম কথার মানুষ। বেশিক্ষণ বকতে পারে না। নাগাড়ে কথা বলে চুপ মেরে যায়।... দুখু বছই আপদের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর বন্ধুত্বের সংজ্ঞা নতুন করে শিখেছে বৈতল। বুঝেছে বাইয়াখাউরি যা পারেনি, মিরতিঙ্গা পারেনি, খিত্তাগাউ বা রইদপুয়ানিও যা দিতে পারেনি তাকে তাই দিয়েছে তেড়া বেঁকা  এক নদীর পার।' বৈতল দুখুর ভেতর লুলাকে খুঁজে না পেলেও বৈতলকে বন্ধুর পরিচয় দিয়েই বাঁচিয়েছে। অর্থাৎ যারা রাজনীতির পাশা খেলে হিন্দু মুসলমানদের বিভাজন তৈরি করে বাঙালি জাতিসত্তাকে দুর্বল করতে চায়, সেখানেই লেখক আঘাত করেছেন। দেখিয়েছেন হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতি ও মিলনকে। তাই বাঙালি জাতিসত্তার পরিচয় কোনোধর্মীয় নয় বরং ভাষিক ও সাংস্কৃতিক। এখানেই ' সুরমা গাঙর পানি' আমাদের সামনে খুলে দেয় আরো একটি মিলনের ক্ষেত্র।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বনিক

  উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বণিক উৎসবের আর মাত্র কয়েকটা দিন, একদম হাতে গোনা।  আর উৎসব  সংখ্যা ছাড়া উৎ...