
‘মন মোর কান্দে রে
কালজানির ওই রে ঢেউ দেখিয়া’।
কালজানির ডিঙিনৌকোর মাঝি বলো নমদাস রাতের
আন্ধারে কিংবা দেখেই ফেলে দমনপুর, রাজাভাতখাওয়ার আলো। শহরের দিকে উড়ে যাওয়া পাখিদল
বহন করতে থাকে নদীজলছোঁয়া বাতাস।কালজানি বাঁক নেয় আরো আরো বাঁকের দিকে।নদী কালজানি
‘মিথ’ হয়ে ওঠে।শিল্পসংস্কৃতি আর গানে গানে। কবি অচিন্ত্য নন্দী সেই কবে লিখে
ফেলেছিলেন-
‘আশৈশব মনে পড়ে দলসিংপাড়া থেকে নেমে আসা
ঝুড়ি ঝুড়ি কমলালেবু,চা ফ্যাক্টারীর নীলঘর আর
পাপ্পাকে
আর কালজানি নদীর তীর ঘেঁষে কুলজঙ্গল।’
দিন যায়। দিনের পিঠে দিন টপকে দিন
যায়।কালজানি কি পুরোন হয়!অতিবৃদ্ধ হয়!
না কি কালজানি ক্রমে ‘কালজানিপুরাণ’ হয়ে ওঠে!
কবেকার শতক শতক পুরোন ‘সওদাগরি নাও’ পালতোলা
হাজারমণী হয়েও ফিরে আসতে পারে এমন সম্ভাবনার আবির্ভাব অসম্ভব জেনেও কালজানি
স্বপ্নের কুয়াশা উড়িয়ে দিতে চায় শহর আলিপুরদুয়ারের দিকে।কর্ণেল হেদায়েত আলি,ভুটান
যুদ্ধ,ইংরেজ সেনা আর কোচবিহার ও ভুটান রাজার সন্ধি(রাজাভাতখাওয়ায় ১৭৭৩-এ) সব
একাকার হয়ে পড়তে থাকে।কবি বেণু দত্ত রায় লিখেছিলেন_
‘বাঘ জল খেতে আসে আমার উঠোনে’।
আর এখন কবির উঠোনে না এলেও জয়ন্তি আর
ভাতখাওয়ার জঙ্গল থেকে বাঘ তো জল খেতেই আসে কালজানিতে।চিলাপাতার হরিণ খেলে
বেড়ায়।হাতিরা চলে আসে দল বেঁধে।কালজানির বাঁশের সাঁকো সাইকেলসমেত পেরিয়ে আসেন
ফুলমণি এক্কা,বুধুরাম মিঞ্জ,জার্মান রাভা,ললিতচরণ বর্মণেরা।আর জ্যোৎস্নারাতে দেখি
পাটকাপাড়ার বাইসন জঙ্গল ডিঙিয়ে কালজানির পথেই।
![]() |
কবি ও গদ্যকার সুবীর সরকার |
‘আজি কালজানির কাছাড় ওরে
হিড়িক হিড়িক করিয়া ভাঙে রে’।
কালজানি নদী থেকে গোপন কান্নার শব্দ উঠে
আসে।জলধোয়া বসুনিয়া সদ্য জেগে ওঠা কালজানির চরগুলিতে খুঁজতে থাকেন
বাথানটাথান,বাড়িটাড়ি,গরুর গাড়ি,মহিষের গলার ঘান্টি,বাওকুমটা বাতাস।গল্পের পাকে
পাকে যেভাবে আমাদের যাপন আটকে পড়ে,ঠিক সেভাবেই নাব্যতা হারায় কালজানি নদী।ভয়াবহতাও
লুপ্ত হয়ে যায় তার।কালজানি তার দূরেকাছের সব
জনপদ,শহর,জলজঙ্গল,হাটহাতি,জলদুষণ,নদীবাঁধ_সব এবং সমস্তটুকু নিয়েই;সমগ্রটুকু সহই
আস্ত এক পরিপূর্ণ বৃত্তান্ত হতে উঠতে থাকে।ইতিহাসভূগোল ও কালখন্ড জড়িয়েই।এভাবেই
উত্তরের নদীকথার এক নুতন আখ্যান রচিত হতে থাকে। কালজানিপুরাণ।

কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন