কবি ও গদ্যকার মলয় পাহাড়ি |
১৪ই অক্টোবর, ১৯৫৪এর কথা, একটু পরেই যখন দু'হাতে দুই কাঁদি ডাব, কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ, ধুতি পাঞ্জাবী পরা বাড়িমুখো কবিকে ধাক্কা মারবে
২৪নং রুটের বি. এল.জি.৩০৪ ট্রাম। গৌতম মিত্র চেনাচ্ছেন জীবনানন্দকে। কবিদের কথা
কেন সত্যি ফলে যায়! কেন লিখেছিলেন "শেষ ট্রাম মুছে গেছে, শেষ শব্দ... কলকাতা এখন অন্তিম নিশীথ"?
১৫ই অক্টোবর যখন রক্ত বমি
হচ্ছে, ডাক্তারকে বললেন, ' মরফিয়া দেবেন না, আমার ডায়াবেটিস। ' আমি ভাবছি ডায়েরিতে এই এন্ট্রি যদি প্রকৃতপক্ষে ১৩ তারিখের হয় , তবে কবি জীবনানন্দ এ কথা লিখলেন কেন, তখনও তো দুর্ঘটনা ঘটেনি!
কম্পাসের উন্মাদনা শিরোনামে
গৌতমবাবু লিখেছেন, (প্রসঙ্গত পর্ব গুলির কী অসামান্য শিরোনাম - অভিভূত চাষা, লুপ্ত নাশপাতি, প্যারাফিন আলো, ঘড়ি শিশু, রৌদ্রবিম্ব, ব্যর্থ জ্যামিতিক দাগ, দূরবীনহীন ব্যাপ্ত রাত্রি প্রভৃতি !) নিজস্ব বাড়ি
জীবনানন্দের কোনদিন ই ছিল না। ডায়েরিতে লেখা -প্রেসিডেন্সি বোর্ডিংএ তাঁর থাকার
ঘরটাকে একেকসময় কফিন মনে হয় ।'চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম চিতা জ্বলে। '
সহজ বিষাদে জীবনানন্দকে
এভাবেই দেখেছেন গৌতমবাবু।
লেখক দেখিয়েছেন জীবনানন্দ
দাশের ডায়েরির অনেকটা অংশ জুড়ে আছে হেঁটে বেড়ানোর কথা -'কলকাতার রাস্তায় ঘোরার ও একসময় খুব value আছে:one meets person :And that may be better than occupying
oneself with some fruitless jobs. কিংবা ' কিছু মানুষ অন্য গোত্রের, দীর্ঘ পথ পেরোনো ইহুদি-হৃদয়ের মতো। '
লেখক সাল ধরে ধরে সাজিয়ে
দিয়েছেন জীবনানন্দের সংগ্রহ করতে পারা ১২৭টি অপ্রকাশিত গল্পের নির্মাণকাল । ম্যানিয়াক ডিপ্রেশনে ভোগা এই
মানুষটি এক মাসে ৩৭টি গল্প লিখে একটিও প্রকাশ করলেন না, সে কি কেবল নেতিবাচক সমালোচনার ভয়ে নাকি সময় প্রস্তুত হয় নি
বলে।
গৌতম দেখাচ্ছেন জীবনের কেন্দ্র নয়, জীবনের কিনার, জমির মাঝটি নয় আল, মার্জিন, অস্পষ্ট ফুটনোট এর কথাকার জীবনানন্দ।
মৃত্যুর ভষ্মের ভিতর পান্ডুলিপি কে জীবন্ত করে রাখার দায় ছিল তাঁর। তাই তো কালো
ট্রাঙ্ককে সাজিয়ে রেখেগেলেন অসামান্য আগামী কে। 'ঈশ্বরের চোখের নীচে আমিও এক অসামান্য রচয়িতা ।'এতটাই আত্মবিশ্বাস ছিল তাঁর।
নির্জন আঙুল শীর্ষক বনলতা
সেন সম্বন্ধীয় আলোচনাটি প্রবল যুক্তিসঙ্গত অথচ মায়াবী। আহা! যদি সত্যিই মহানায়িকা
সুচিত্রাই বনলতা সেন হতেন। পান্ডুলিপি উদ্ধৃত করে লেখক দেখিয়েছেন বনলতা ভুবন সেনের বিধবা বোন নন, ভুবন সেনের কন্যাও নন, লাবণ্য দাশ, শোভনা মজুমদার কিংবা কোন বারবনিতা ও নন , তিনি বিয়াত্রিচে, দান্তের জীবনের অনশ্বর ভালোবাসার মতো।
১৯৫৪র একটি খাতায় তাঁর প্রিয়
বইয়ের তালিকায় বোদল্যের লেখা 'অন্তরঙ্গ জার্নাল ' স্থান করে নিয়েছে। জীবনানন্দের 'লিটারেরি নোটস' ও বোদল্যের জার্নালের মিল চমকপ্রদ। অথচ
অ্যক্সিডেন্ট না হলে জীবনানন্দ হয়তো বা নিশ্চিত ভাবে ডাইরি গুলি পুড়িয়ে দিতেন।
প্লটে আস্থা নেই, নেড়িকুকুর কে নায়ক করে উপন্যাস লিখে ফেলার পরিকল্পনার।তাঁর
নির্মাণ পক্ষপাতশূন্য এক স্পর্শ --কোন ছাঁচে ধরা নয়।
একটা একটা করে সিঁড়ি ভেঙে
নিজের জন্য বরাদ্দ প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং এর ঘরটিতে নিজেকে টেনে তুলেছেন দিনের পর
দিন। কলকাতা, হ্যাঁ কলকাতা, বোদল্যের প্যারিস, জয়েসের ডাবলিন, বেনিয়ামিনের বার্লিনের মতোই জীবনানন্দের
অনিবার্য আধার কোলকাতা।
মা কুসুমকুমারী কবি আমরা
জানি, মাতামহ চন্দ্রনাথ দাস ছিলেন গীতিকার ও কবি, তাঁর তিনখানা বই ছিল, মামার বংশধারার কবিত্বশক্তি কালমিনেট করেছে জীবনানন্দে এ কী নতুন করে বলার
কথা!
সংসার সুখের হয়নি, স্ত্রী লাবণ্য ও যন্ত্রণা ব্যক্ত করেছেন মিনু সরকারের কাছে ,জীবনানন্দ ও ঘনিষ্ঠ জনের কাছে জানতে চান- ' যদি স্ত্রী আপনার আমন্ত্রণে ঘনিষ্ঠ হবার প্রস্তাবে সায় না
দেয় কী করবেন?
' মূল্যবান এ দেখি, 'ওপরের ঘরটায় উৎপলা আর মনু শোয়। একতলায় মাল্যবানের বিছানা। ' মাল্যবানের মানসিক চলন অনেকাংশেই জীবনান্দের মনোজগতের ছায়ায়
আঁকা।
পুস্তকটি শেষ করে আমি শ্রী
মিত্র প্রনিত মুখবন্ধ অংশে আসি, সন তারিখ ধরে ধরে অনবদ্য বিশ্লেষণ করেছেন লেখক।
বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিতকে উদ্ধৃত করে বলেছেন জীবনানন্দের ক্ষেত্রে আভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য
খুব জরুরী, ডায়েরি, প্রবন্ধ, কবিতা, উপন্যাস,চিঠিপত্র প্রভৃতির বুনন প্রত্নছাপ ধরে গভীর
অনুসন্ধান দাবি করে।
জীবনানন্দকে নিয়ে আমার পাঠ
খুব সীমিত, দেবতাজ্ঞানে পুজা ও করি না, আমার খুব তৃপ্তির পাঠ অভিজ্ঞতা ই আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম।
এটি ১ম খন্ড, ২য় খন্ডের অপেক্ষায় রইলাম। লেখকের ভরসার হাত
শাশ্বতী মিত্রকে ও শ্রদ্ধা জানাই।ধন্যবাদ জানাই প্রকাশক সুমিতা সামন্ত কে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন