উত্তরের তরুণ কবি শিবনারায়ন রাউতের প্রথম ও একমাত্র প্রেম হল কবিতা। দীর্ঘদিন যাবৎ তিনি লিখে চলেছেন প্রকৃতি,সমাজ ও মানুষের অপরুপ গাঁথা। 'যে অতীত ইতিহাস হয়না' তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ। পাঠক প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত। তাঁর এই গ্রন্থ সময়ের এক অদ্ভুত দলিল। কাব্যগ্রন্থটির নামকরণ ভীষণভাবে সাংকেতিক ও অর্থপূর্ণ। মোট ২৬ টি কবিতা রয়েছে এই কাব্যগ্রন্থ টিতে। প্রত্যেকটি কবিতায় কবি গভীর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজের বাস্তব চিত্র, যা সেই প্রাচীনকাল থেকে শুরু করে বর্তমান যুগেও প্রবাহমান। যা অতীত হয়েও কখনও ইতিহাস হয় নি।
কবির এই
কাব্যগ্রন্থ মূলত সমাজ ভাবনারই এক প্রকার বিক্ষিপ্ত প্রতিফলন। প্রত্যেকটি কবিতাতে
কবি সুনিপুণভাবে এঁকেছেন সমাজের ছবি,, সমাজের ঘুন ধরা অংশের ছবি। সাংকেতিকভাবে তাঁর
কলম থেকে ঝরে পড়েছে শ্লেষাত্মক প্রতিবাদ। প্রত্যেকটি কবিতা গভীরভাবে পাঠ করলে
পাঠক মনে সমাজের এই অন্ধকার দিকগুলোর প্রতি তীব্র ধিক্কার জন্ম নেয়।
কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা "ল্যাংটা" তে কবি তুলে ধরেছেন কুসংস্কার এবং
অশিক্ষায় জর্জরিত একদল মানুষের প্রতিচ্ছবি। যারা ল্যাংটা সাধুকে তন্ত্র মন্ত্র ও কালাজাদু করার অপবাদ দিয়ে
পিটিয়ে মেরে ফেলে। এরকম ঘটনা আমাদের সমাজে অহরহ ঘটেই চলে। ডাইনি অপবাদ,ছেলে ধরা অপবাদ, চোর অপবাদ, যাদু-টোনা করার অপবাদে অনেক সময় নিরীহ
মানুষকে একদল মানুষ অশিক্ষিত ও কুসংস্কারচ্ছন্ন মানুষ নির্বিচারে হত্যা করে,আইনের পরোয়া না করেই। কবি সেই অন্ধকার
দিকটির উপরেই আলোকপাত করেছেন।
কবির আর একটি
বলিষ্ঠ কবিতা "দ্রৌপদীর কান্না" কবিতায় কবি নিপীড়িত-লাঞ্ছিত-বঞ্চিত
নারী সমাজের চিত্র তুলে ধরেছেন। তার তীর্যক শব্দ বাণে তিনি পুরুষতান্ত্রিকতার
পাহাড়ে ধস নামাতে চেয়েছেন। সেই আদি যুগ থেকে যেভাবে নারীকে লাঞ্ছনা ও বঞ্চনার
শিকার হতে হয়েছে সেই প্রথা এখনো এই সভ্য সমাজে বর্তমান। সেই আদ্যিকালের দ্রৌপদী
থেকে বর্তমান সমাজের অহরহ নারীর একই রুপকথা। কবির ভাষায়---
"নারীর সহজাত চোখে দেখলাম
আমার মুখের দিকে
নয়
আপনার চোখ দুটি
লোহা হয়ে
তাকিয়ে আছে
আমার ২১ বছর
বয়সের
চিহ্ন দুটির
দিকে
ওড়না
টানলাম"
"ভীম সেন তুমি একজন দুঃশাসনের
রক্ত পান করেছ
সত্য
কুরুক্ষেত্র
থেকে সেই রক্ত পড়েছিল
তার বীজ থেকে
জন্ম নিয়েছে
শত শত লক্ষ লক্ষ
দুঃশাসন
বাঁচাও
আমাকে------
আমাদেরকে --------"
বিনীতা সরকার |
সমাজের
অবক্ষয়ের আরো এক করুন কাহিনী এঁকেছেন কবি শিবনারায়ন রাউত। বৃদ্ধ বাবা-মাকে
চিরকালের নির্বাসনে পাঠানোর ছবি। চারদিকে আজ ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে
বৃদ্ধাশ্রম। আর মানুষের বিবেক জুড়ে গজিয়ে উঠছে পুরু শ্যাওলার আস্তরণ। দু'মুঠো অন্ন ছাড়া যারা কিছু চায় না, সেই পিতা-মাতাকে সন্তান আজ বাড়ি থেকে
বিতাড়িত করছে। সমাজের এক করুন কিন্তু বাস্তব চিত্র এঁকেছেন তাঁর টান কবিতায়।
কবি তাঁর প্রায়
সবগুলি কবিতাতেই প্রান্তিক মানুষদের জীবন চিত্র এঁকেছেন নিপুণভাবে। মাটির খুব
কাছাকাছি যারা থাকেন তাঁদের চিত্র। দারিদ্র নিপীড়িত লাঞ্ছিত মানুষের মুখ এঁকেছেন
তাঁর কলম তুলিতে। কবির নিজস্ব উচ্চারণে----
'একমনে পাতা কুড়িয়ে যায় মেয়েটি
শীতের হাত থেকে
বাঁচতে
কিন্তু
কে বাঁচাবে
দুঃশাসনদের থেকে?'
"
কাঁদতে থাকে
শিরীষ গাছের পাতা গুলি
পুরুষের পৌরষত্ব
দেখে"
তালমা হাটের এক
পাতাকুড়ানি মেয়ের অসহায়ত্বের ছবি এঁকেছেন তাঁর কবিতায়। সত্যিই তো এরকম অসহায়
অবলা নারীদের দুঃশাসনদের হাত থেকে নিজের সম্ভ্রম রক্ষা করা খুব মুশকিল। করুন
বাস্তব চিত্র।
কবি প্রকৃতিকে
নিবিড়ভাবে ভালোবেসেছেন। তাঁর বেশিরভাগ কবিতায় ফুটে উঠেছে ডুয়ার্সের চিত্র।
আদিবাসী প্রান্তিক মানুষরা তার মুখ্য উপজীব্য। তাঁর ব্যর্থ শিকার কবিতায় খুবই
এরকমই এক দিনমজুরের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। যারা তথাকথিত মালিক পক্ষের কাছে
নিপীড়িত,
লাঞ্ছিত ও পাওনা
মজুরি থেকে বঞ্চিত। কবির কথায়-----
'মাছরাঙ্গা পাখিটি তখনও
নোংরা জলে নিজের
অদেখা ছবি
দেখে যাচ্ছিল
জানে শিকার
নেই----
তবুও নেশা..…'
আমরা এখনো
জাতিভেদ,
বর্ণবিদ্বেষের
শিকার হই। সেই আদিকাল থেকেই চলে আসছে এই প্রথা। গায়ের মেয়ের কালো রঙ,দাঁত উঁচু বলে পাত্র পক্ষের প্রত্যাখ্যানের
চিত্র ফুটে উঠেছে তাঁর "যেটা হয় না" কবিতায়। আধুনিক সমাজে দাঁড়িয়ে
এই চিত্র এখনো অহরহ দেখা যায়। সামাজিক অবক্ষয়ের আরও এক জলজ্যান্ত দলিল
"করোতোয়া নদী"। সমাজের এইরূপ অবক্ষয়ের
চিত্রে লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে।
"বুকের মাঝে বিরাট ক্ষতচিহ্ন বুড়িটার
বন্ধু পল্টুকে
সেবার চিতাবাঘ কামড়েছিল
এইরকম খাবচানো
শরীর দেখেছিলাম
তবে কি
বুড়িটাকেউ
কোন
বাঘ........."
"বৃদ্ধাকে আর দেখলাম না
জল হয়ে
গেছে"
প্রত্যেকটি
পংক্তি থেকে ঝরে পড়ছে তীব্র শ্লেষ, ধিক্কার ও প্রতিবাদ এই তথাকথিত সভ্য সমাজের
মুখোশধারী হায়েনাদের বিরুদ্ধে। তাঁর ঘাসফড়িং ছবি আঁকে একদল নারী পাচারকারী দালাল
চক্রের। দারিদ্র,
দিন আনা দিন
খাওয়া পরিবারের কন্যা সন্তানদের বিয়ের নামে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাইরে পাচার করা, বিক্রি করা ও দেহ ব্যবসায় নিয়োজিত করা
দালালচক্রের কুৎসিত নকশা এঁকেছেন দক্ষ হাতে। দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে মানুষকে
বিপাকে ফেলার এই চক্র এখনও বর্তমান সমাজে চূড়ান্তভাবে সক্রিয়। সেই ছবি ধরা
পড়েছে ঘাসফড়িংয়ে। তাঁর "ব্যথা লাগে" কবিতায় কবি এঁকেছেন মহাজন
সমাজের নগ্ন ছবি। দুর্বল মানুষ, কৃষক সমাজ, শ্রমিক কিভাবে দিনে দিনে ঋণের দায়ে জর্জরিত
হতে থাকে ও একদিন শূলে চড়ে যায় সেই করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে ব্যথা কবিতায়।
এখনো একজন
মানুষের কাছে দুর্বলরা, ছোট জাত বলে
প্রতিনিয়তঃ দুর্ব্যবহার পায়। বর্ণবিদ্বেষ, জাতি ভেদাভেদ ও সাম্প্রদায়িকতা যেন সমাজের
রন্ধ্রে রন্ধ্রে গ্রথিত।
কবি যেন অত্যন্ত
দক্ষতার সঙ্গে সমাজের অন্ধকার চোরা গলির ভেতর দিয়ে টর্চ হাতে অভিযান করেছেন।
সবরকম অন্ধকারের বুকে তিনি আলো ফেলেছেন। দোকানে কেনা ভালোবাসা কবিতায় কবি
দেখিয়েছেন পণ প্রথার মত অমানবিক ও নির্লজ্জ একটি সংস্কারকে। যেখানে মেয়ের সুখ
কিনতে বাবা-মাকে পুরোপুরি নিঃস্ব হতে হয় ----
"বাবা বিক্রি করেছে বসতবাটি
মা গয়না
পাঁচ লক্ষের
বিনিময়ে"
তাঁর
"মেচেনির গান'',"পালাটিয়া","জীবনের লক্ষ্য", "বসবাস" কবিতায় কবি আবহমানকালের
কিছু চিরাচরিত
সংস্কৃতির কথা উল্লেখ করেছেন।
এই
কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতায় কবির কলমে প্রেমও ধরা পড়েছে এবং তাতে রূপকের
ব্যবহার।রূপক কবিতার একটি অনন্য উপাদান। কবির বিভিন্ন কবিতায় রূপকের উল্লেখযোগ্য
ব্যবহার চোখে পড়ে। রূপকের আশ্রয়ে কবিতাগুলি অসামান্য ছাপ ফেলে যায় পাঠক মনে।
যেমন---
'নদী ভালোবেসেছিল আকাশকে
বৃষ্টি হয়ে
আকাশের ভালোবাসা
ঝরে পড়তো নদীতে'
নদী তাই আর
কাউকে
ভালবাসতে চায়
না
কান্না হয়ে বয়ে
যায়
নিঃশব্দে------
এক গভীর প্রেমের
ছবিও ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায়। আসলে অন্ধকারের পরে যেমন ভোরের আলো ঝিলিক
দেয় তেমনি শত ঝড়-ঝঞ্ঝার পরেও জীবনে প্রেম আসে। চাঁদের স্পর্শ একটি চূড়ান্ত
প্রেমের কবিতা। এখানেও প্রান্তিক জীবন প্রাধান্য পেয়েছে। ধুপঝোড়ার জঙ্গলের এক
সাঁওতাল রমণীর সঙ্গে শহরে বাবুর প্রেম কাহিনীর গল্প। আপাতদৃষ্টিতে সামাজিক অবস্থান
তাঁদের মিলনের অন্তরায়।
তাঁর আবাহন
কবিতায় জলঢাকা নদীর চরের ওপর ফুটে থাকা কাশফুল গুলির থেকে যেন বিন্দু বিন্দু
কান্না ঝরে পড়ছে। ট্রাক্টর দিয়ে কাশিয়া বন উপড়ে দিয়েছে অমানুষ হায়নার দল।
কবির সেই হৃদয়বিদারক কিছু লাইন-----
"একটু দূরেই
লাল শাড়ী
পরিহিত এক গৃহবধূ
কাছে গেলাম, সমস্ত শরীরে কালশিটে দাগ"
'বুঝতে অসুবিধা হল না
কাশিয়া কন্যার
কান্নাকে'
নির্মম করুণ
চিত্র। কবি তথাকথিত সভ্য সমাজের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন সমাজের বুকে
আছে দগদগে ঘা। মানবতার এই বিপর্যয়, নারীদের এই লাঞ্ছনা আর মেনে নেওয়া যায় না।
ধর্ষণের মতো নাটকীয় ঘটনার সাক্ষী কবিতা 'আবাহন'। তীব্র প্রতিবাদের সময় এসেছে এই সব ঘটনার
বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করার। তাই কবির এই কবিতায় ফুটে উঠেছে তীব্র ধিক্কার।
তবে একজন
একনিষ্ঠ পাঠক হিসেবে বেশ কয়েকটি কবিতা একটি দুর্বল লেগেছে। আর দু'এক জায়গায় বানানোর কিছু ভুল চুক আছে। তবে
সব মিলিয়ে কবি শিবনারায়ন রাউত এর এই কাব্যগ্রন্থ সময়ের এক জ্বলন্ত দলিল। আশা
করি তা কোনদিনই অতীত হবে না। চিরকালীন আবেদন রেখে যাবে পাঠকের মনে। অবশেষে,
কবিকে জানাই
আমার একরাশ শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা এত সুন্দর একটি বই পাঠকদের উপহার দেবার জন্য। কবির
কাছে আমার অনুরোধ এভাবেই যেন তিনি আঁধার কাটিয়ে স্নিগ্ধ আলোর সৃজনে নিরত থাকেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন