মরিবার হল তার সাধ
শৌনক দত্ত
|
রাতে বৃষ্টি এলো। এলোমেলো ঘর জুড়ে তখন হরিণ স্বপ্ন ময়ূরের
মত পাখা মেলে দিয়েছে। মাঝে মাঝে জীবনানন্দ নিয়ে অপেক্ষায় থাকি। ভার্জিনিয়া উলফ বা
সিলভিয়া প্লাথ ডেকে বলে- মাঝে মাঝে কি হয়
জানিনা। আজকাল একা একা বিষন্নতার ধারে গিয়ে বসি। বাঁধের উপর বসে আনমনে ঘাসগুলো ছিঁড়তে
থাকি। হঠাৎ চিনচিন কিছু একটা জেগে ওঠে। আমি তখন চুপচাপ বৃষ্টির সাথে কথা বলি আর
দেখি জানালার ওপারে কবিতা তার পাশ দিয়ে ভার্জিনিয়া নিজের ওভারকোটের পকেটে নুড়ি
পাথরবোঝাই করে হেঁটে নেমে যাচ্ছে খরস্রোতা পাথুরে নদীতে।
হঠাৎ সেদিন কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখলাম। কাকিমা জল দিচ্ছে।
কাকিমা আমাকে বিকেলে পুকুর পাড়ে নিয়ে যাবে? কতদিন ফড়িংয়ের নাচ দেখিনি। পুকুরের জলে
তখন অমিমাংসিত ডুব। তুখর সাঁতারু অরুনেষ ঘোষ আত্মরক্ষার কোনো তাড়া বোধ করছেন না।
কিংবা আজীবন আত্মভোলা, নিঃসঙ্গ কবির মনে কি তাঁরই স্বরচিত অদ্ভুত আঁধার জেঁকে
বসেছিল, তিনি কোনো চিত্তচাঞ্চল্য বোধ করছেন না?
তারপর
দেখলাম, প্রজাপতিটা নীল পাখা নিয়ে আমার বনশাই এর নতুন পাতা টার ওপর
এসে বসলো। মনে হলো বাবার কপালের সব জ্বর কমে গেলো। মা পাশের ঘর থেকে ডাক দিল,সন্ধ্যে বেলা রাই
আসবে। আমার ছোট বেলার বন্ধু, কবে যে পরিচয়, কেমন করে যে ওকে আমার সেদিন অর্ধেক চকলেট দিলাম কে জানে।
বাড়িতে ভাই এর সাথে যেই চকলেট নিয়ে মাঝেমধ্যেই ঝগড়া হয়। রাই এখন জাটিঙ্গায়
থাকে। Human
Studies বিষয়।
ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছি। দশ মিনিট ট্রেন দাঁড়িয়ে,দিনহাটা পাস হবে।
তারপর সিগনাল। এমন সময় বাদামওয়ালারা পাশ দিয়ে গেলে প্রাণটা আনচান করে ওঠে।
ঝালমুড়িওয়ালার পাশে দাড়িয়ে ইয়ানশিনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ করা মায়কোভস্কি। নারকেল
চিলতায় কামড় দিয়ে পোলানস্কায়ারকে বিয়ের করার কথা বলছেন মায়াকোভস্কি।বন্দুকের নল
নিজের মুখে ঢুকিয়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে জোর করে বিক্রি করছেন ‘দ্য ওল্ড ম্যান
অ্যান্ড দ্য সি’। পাশের যাত্রীদের আলোচনার বিষয় জন ব্যারিম্যান যিনি
তোর্ষাকে মিসিসিপি ভেবে লাফ মেরেছেন। ট্রেন ছাড়লো আর কার্বন মনো-অক্সাইড গ্যাসে
ঢেকে গেলো অ্যানি সেক্সটন।
কারিন বোয়ের
গাড়ি আর ফেরেনি কিন্তু আমার আজো বাড়ি ফেরার হলে মন কেমন আনন্দে ভরে ওঠে। টেলিফোনে
থম্পসন তাঁর স্ত্রীর সাথে সেই যে কথা বলছিলো বলেই যাচ্ছে কোথা থেকে একটা গুলির
শব্দে রাতের মত নির্জনতা। এডগার অ্যালান পো তখন ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ
হিসেবে মানসিক বিষণ্ণতা থেকে আত্মহত্যার কথা লিখছেন।আর ফোস্টার ওয়ালেস গাড়ির
গ্যারেজে ‘ইনফিনিটি জাস্ট’দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখছে। গ্যাসের চুলায়
তখন মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে সিলভিয়া প্লাথ।
মনে হয় কামরার এমাথা থেকে ওমাথা একটু দৌড় দিই। সে না হয়
পরে কখনও হবে। হালকা শীতের স্টেশন দেখতে ভালোই লাগে। মনে হয় যারা প্রেম করতে
বেরিয়েছিল তারা গুটিসুটি হয়ে বেশ ভালোই প্রেম করবে। তা করুক। সম্পর্ক টিকে থাক।
ভালোবাসা বাঁচুক। দূরের প্রেম গুলোও আরও
জমাটি হোক। কে যে বলেছিলো প্রেমে পড়া বারণ।ট্রেন থেকে নেমে হাঁটছি দেশপ্রিয়
পার্কের কাছে ট্রামলাইনে,সঙ্গে জীবনানন্দ বড্ড অন্যমনস্ক ও বিক্ষিপ্ত।আমরা কেউ
দেখছিনা যে ঘণ্টি বাজিয়ে আসছে ট্রাম,চোখে কেবল ভাসছে –
শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাদ
মরিবার হল তার সাধ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন