বুধবার, ২২ জানুয়ারী, ২০২০

গল্প -- মৃদুল শ্রীমানী



                   রানাঘাটের
মেয়ে         

আমার ঘরে সম্প্রতি একজন মহিলা যাতায়াত করেন। মহিলা বলছি বটে, কিন্তু তাঁকে মহিলা বলা ঠিক কি না বুঝতে পারছি না। যাই হোক, কাপড় চোপড় যখন মহিলার ঢংয়ে পরেন, তখন মহিলাই বলা যাক
তিনি যে আমার ঘরে আসেন, তার ঠিক ঠাক সময় থাকে না। প্রায়ই রাত বিরেতে এসে হাজির হন। খুটখাট এটা সেটা নাড়েন। আমি জেগে আছি বুঝতে পারলে দু একটা কথাও জিজ্ঞাসা করেন। আমি খেয়াল করেছি, আমার অজান্তেও কখনো কখনো আসেন। কিন্তু কোনোদিন টাকা পয়সার কিছু হাতটান দেখি নি বলে, বলি বলি করেও কিছু বলতে পারি নি। 
একদিন ছুটির দুপুরে চোখ বুজে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। খবরের কাগজটা হাত ছাড়িয়ে পাখার হাওয়ায় মেঝেতে ফরফর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এমন সময় একটা মৃদু সুবাসে টের পেলাম যে তিনি আবির্ভুত হয়েছেন। 
সামান্য চুড়ির রিনি ঠিনি আওয়াজ তুলে তিনি বললেন, মশাই, ঘুমিয়ে আছেন না কি। আমি ঘুমের ভান করে পড়ে রইলাম গোপনচারিণী যা ইচ্ছে করুন। আমি তো জানি খানিক বাদেই চলে যাবেন
টের পেলাম আমার টেবিল থেকে একটা মোটা বই নিয়ে নাড়ছেন। নাড়ুক গে যাক। আমার এখন কথা বলার ইচ্ছে নেই। খানিক বাদে আধো স্বরে তিনি বললেন, একটা গান খুঁজছি, কিছুতে খুঁজে পাচ্ছি না। বললাম প্রথম ছত্রের সূচী দেখুন। সুভাষিণী বললেন গানের প্রথম লাইনটি মনে করতে পারছি না। বললাম বেশ, ভিতরের দু একটা লাইন বলুন। সুহাসিনী বললেন, কোনো লাইনই মনে আসছে না। আমায় উঠে বসতে হল। চোখ খুলে বললাম, গানটির দু একটা শব্দ বলুন। জলতরঙ্গের মতো হেসে বললেন, দূর ছাই কিছুই মনে নেই। আমি হতাশ হয়ে বললাম, সুরটা কেমন একটু বলবেন?
সুনয়না বললেন, সকালে সুরটা একটু একটু মনে ছিল। এখন তাও আর মনে করতে পারছি না। 
আমি বললাম, তাহলে খোঁজার ব্যাপারটাও ভুলে গেলেই ভাল। কিছুই যদি মনে নেই, তাহলে আর খোঁজেন কেন?
ম্লান হেসে সুবচনী বললেন এমন একটা গীত বিতানের খুব শখ ছিল আমার। আমি চুপ করে রইলাম। আমি আধা বেকার মানুষ। টিউশনি পড়িয়ে খাই। একটা একটা শখের জিনিস জোগাড় করতে আমার প্রাণান্ত হয়। মেঝে থেকে কাগজটা কুড়িয়ে পাট করে ভিতরের একটা খবর দেখতে যেতেই, তিনি হঠাৎ অস্থির হয়ে বললেন, আমার আর থাকার উপায় নেই, আমি আসি। আমার একটু রাগই হল। আমি তো ওঁকে ডাকি নি। নিজের খেয়ালে নিসম্পর্কিত ব্যক্তির ঘরে এসেছেন। আমি থাকতেও তো বলি নি। কিন্তু ওঁর থাকা না থাকায় আমার কি আসে যায়, মুহূর্তে এই কথা 'টা ভাবতে গিয়ে দেখি তিনি নেই। ত্বরিত পায়ে উধাও হয়ে গিয়েছেন
আমি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম। বন্ধ আছে দেখে খবরের কাগজে মন দিলাম। খবরের কাগজ ভর্তি চাপ চাপ রক্ত আর মৃত্যু। শাসকদল যখন বিরোধীদের নিকেশ করে দেওয়া গিয়েছে বলে উদ্বাহু নৃত্য জুড়েছে, ঠিক তখনই দলে গভীর গোষ্ঠী কোন্দল দেখা দিয়েছে। লুঠপাট, অগ্নিসংযোগ, আর খুন জখম ঘটছে দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বে। আর দাম্পত্য অশান্তি। একটি মেয়েকে তার স্বামী স্রেফ সন্দেহের বশে পুড়িয়ে মেরেছে। মেয়েটি কিন্তু স্বামীর সংসার করতে চেয়েছিল। স্বামীকে বাঁচাতে চেয়ে গোটা গায়ে অগ্নিক্ষত নিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট এর কাছে মৃত্যুকালীন জবানবন্দী দিয়েছে, "আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।" হায় রে বাঙালির মেয়ে!
মনে পড়ল ভদ্রমহিলার সাথে প্রথম আলাপের কথা। টিউশনি পড়াতে কোথায় না কোথায় চলে যেতাম। পড়াতে পড়াতে ভুলে যেতাম আমার একটা ঘর আছে। আমাকেও পেটে দুটি দিতে হবে। সে সব মনে পড়লে শেষ ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরতে হত। অত রাতে অটো বন্ধ হয়ে যেত। একা একা হেঁটে নিজের সাথে নিজে কথা বলতে বলতে ঘরে ফিরতাম। সেদিনও শেষ ট্রেনে ফিরছি। বাইরে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে। আমি যে কামরাতে উঠেছি সেখানে একটি মহিলা জড়োসড়ো হয়ে বসেছিলেন। আমি উঠতে আমার কাছে এসে ঘোমটার আড়াল থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, এই ট্রেন কখন রানাঘাট পৌঁছবে? কি আশ্চর্য, নৈহাটি লোকাল শিয়ালদহে ফিরছে, এর মধ্যে রানাঘাট আসছে কোথা থেকে? মহিলা কি পথ ঘাট কিছুই চেনেন না
একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বললাম এটা লাস্ট ট্রেন। এই ট্রেন রানাঘাট যায় না
তবে কি হবে?
আমি এই প্রশ্নের উত্তর দেবার সার্থকতা খুঁজে পেলাম না। উনি যাবেন রানাঘাট। আর ট্রেন যাবে শিয়ালদহ। উনি কি করবেন, আমি কি বলব!
আমার স্টেশন আসতে আমি নেমে এলাম। ডাস্টবিনে কুকুরের দল খাবার খুঁজতে হল্লা পাকাচ্ছে। বেশিরভাগ বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দু একটা পান বিড়ির দোকান খোলা দেখে মনে হচ্ছে বাকি রাতটুকু কাটিয়ে তবেই তারা ঝাঁপ ফেলবে। ঘরে এসে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। কাছের একটা হোম ডেলিভারি পয়েন্ট থেকে আমার খাবার দিয়ে যায়। ঘরের একটা চাবি ওদের কাছেও থাকে। আমার ঘরে কয়েকটা বই আর জামাকাপড় ছাড়া আর বিশেষ কিছু নেই, তাই লোকের হাতে চাবি দিতে গিয়ে বিশেষ ভাবি না। খেয়ে শুয়ে পড়ার পর, কানের মধ্যে সেই কথা বাজল, এই ট্রেন রানাঘাট যাবে? মনে পড়ল সেই ট্রেন যাত্রী মহিলার কথা। কি জানি, কোথায় তিনি গেলেন। অতো রাতে একাকিনী মহিলা কোথায় আশ্রয় পাবেন? ভাবতে ভাবতে রাগ হল। এরা পথঘাট না চিনে চলা ফেরাই বা করে কেন, আর চলে যদি, তা হলে জেনে নেয় না কেন?
ক্লান্ত শরীরে ঘুম পাবার কথা। কিন্তু কেবলই মহিলার কি ব্যবস্থা হল, জানতে ইচ্ছে হল। মাথা থেকে জানার ইচ্ছেটাকে তাড়াতে পারছি না। এমন সময় মনে হল ভদ্রমহিলার মুখটুকু ঘোমটার আড়ালে ছিল। আমি দেখার কোনই চেষ্টা করি নি
সকাল বেলা উঠে মনে হল কত মেয়ে বাড়িতে হয়তো ঠিকমতো খেতে পরতে না পেয়ে পথে বিপথে বেরিয়ে পড়ছে। সবাই তো আর বাঁধানো রাজপথ দিয়ে চলতে পারছে না। কত মেয়ে বেপথু বেভুল হয়ে পৌঁছে যাচ্ছে কানাগলির অন্ধকারে
একটু পরেই স্নান সেরে সারা দিনের মতো বেরিয়ে পড়লাম। একটার পর একটা টিউশন পড়াতে পড়াতে কখন দিন ফুরিয়ে যাবে। হঠাৎ চোখে পড়ল ভদ্রমহিলা হেঁটে যাচ্ছেন। দেখে খুব আশ্বস্ত হলাম। তা হলে এই অঞ্চলে তাঁর পরিচিত কেউ আছেন, আর সেখানেই মহিলা থাকেন
মাঝে মধ্যে এক আধ বার মহিলাকে দেখতে পেতাম। তারপর একদিন কাছে গিয়ে বললাম চিনতে পারছেন?
ঘোমটা আরো একটু টেনে জড়সড় হয়ে মহিলা বললেন, সেদিন ভারী বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম। আপনি না থাকলে যে কি হত?
আমি একটু অন্য দিকে তাকাতেই মহিলা সরে পড়েছিলেন। আমি ভাবলাম, আচ্ছা অভদ্র তো! না বলে কোথায় কেটে পড়ল। পর মুহূর্তে আমার মনে হল, আমিই বা কোন সদ ব্যবহারটা করেছিলাম? লাস্ট ট্রেনের খালি কামরায় একাকিনী একটা মেয়ের কিছুমাত্র ব্যবস্থা না করেই চলে আসতে আমার তো বাধে নি!
মাঝে মধ্যে হঠাৎ মহিলাকে দেখতে পেতাম। সর্বদা মুখ তাঁর আড়ালে রাখতেন
একদিন তাঁকে বলে ফেললাম, আচ্ছা, এখানে কোথায় থাকেন? মহিলা বললেন, আমাদের বাড়ি থেকে আপনার ঘরটা দেখা যায়। আচ্ছা, রোজ কেন অতো রাত করে ফেরেন আপনি?
বলতে ইচ্ছে হল, পেটের দায়ে ম্যাডাম। কিন্তু তা বলতে রুচিতে বাধল। বললাম, অতো রাতেও আপনি জেগে থাকেন?
উদাস স্বরে মহিলা বললেন, কত রাত যে ঘুমাই না...
লজ্জা পেলাম। আমি কিছুতেই শালীন আলাপ বিধির নিয়ম কানুন লঙ্ঘন করব না। উনি রাতে ঘুমান না কেন, জানার ইচ্ছে থাকলেও সে প্রশ্ন করা ভদ্রতা বহির্ভুত। 
একদিন মহিলা বললেন, আপনার গান শুনতে পাই। বেশ গানের গলা আপনার। ওঁকে বলতে ইচ্ছে হল, আমার মা রেডিও শুনে শুনে বেশ গাইতেন। যদিও প্রথাগত তালিম তাঁর ছিল না। মায়ের মুখটা মনে পড়তে আমার ভারি মন কেমন করল। চোখে জল এল। গলাটা খাঁকার দিয়ে পরিষ্কার করতে যাব, দেখি মহিলা সরে পড়েছেন
এর পর থেকে মাঝে মাঝে ইচ্ছে হত একটু দেখা হোক। ওঁর মুখটি আড়াল রাখতেন। কিন্তু তাঁর গায়ের মৃদু সৌরভ আর চুড়ির রিনি ঠিনি আমার মনে গাঁথা ছিল
তাঁকে আমিই একদিন বলেছিলাম, কাছেই থাকেন যখন, ইচ্ছে হলে আমার ঘরে আসতে পারেন। আশা হচ্ছিল, তিনি গান শুনতে চেয়ে একদিন আসবেন। বন্ধু বান্ধব জুটিয়ে হারমোনিয়াম টেনে নিয়ে গান কতকাল গাই না। এই মহিলাকে শোনানোর ছুতোয় যদি গানের চর্চা ফিরে আসে, তাতে মন্দ কি?
আমি দরজা আলগা রেখে গা এলিয়ে পড়ে থাকতাম। আঁধার রাতে তিনি ইচ্ছে হলে আসতেন। গীত বিতান নাড়তেন চাড়তেন। আমি তার শরীরের মৃদু সৌরভ আর কাঁকনের শব্দ শুনতে পেতাম। কিন্তু কোনো দিন জিজ্ঞাসা করতে পারতাম না, আমাদের পাড়ায় ঠিক কোন বাড়িটির তিনি কে? অতিরিক্ত জানতে গেলে তাঁর এই মৃদু পায়ে আসা যাওয়া যদি বন্ধ হয়ে যায়?
আজ যখন তিনি গানের লাইন মনে করতে পারছেন না, কোনো শব্দ মনে করতে পারছেন না, এমন কি সুর টুকুও নয়, তখন কি এক অদ্ভুত আকুতিতে তাঁকে আমার গান শোনাবার ইচ্ছে হচ্ছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল আমার শয্যার এক কোনে তিনি একটু বসুন
আমি কিছু বলার আগেই তিনি চলে গেলেন। তার সৌরভটিও যখন মিলিয়ে গিয়েছে, তখন আবার কাগজ পড়ার চেষ্টা করলাম। জনৈক গানের শিক্ষকের সাথে পরকীয়া সন্দেহ করে বর গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল মেয়েটির। মেয়ের বাপের বাড়ি ছিল রানাঘাট


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বনিক

  উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বণিক উৎসবের আর মাত্র কয়েকটা দিন, একদম হাতে গোনা।  আর উৎসব  সংখ্যা ছাড়া উৎ...