সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০
কবি শম্ভু রক্ষিত স্মরণ -- কলমে কবি সুদীপ্ত মাজি


'ক্রোধ ও কান্নার পর স্নান সেরে' :
সত্তরের
শম্ভু রক্ষিত সেই বিরল ব্যতিক্রমীদের অন্যতম যাঁর জীবন এবং কবিতা অচ্ছেদ্য সম্পর্কে
আবদ্ধ। পরিকল্পনাহীন এক জীবন- উদযাপন আর ভয়াবহ দারিদ্রকে অতিক্রম করে উঠে আসে তাঁর
কবিতার স্বর --- যা তাঁর জীবনযাপনের মতোই এলোমেলো এবং প্রক্ষিপ্ত --- অন্তত দৃশ্যত।
তাঁর প্রথম বই 'সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ'- এই তিনি তাঁর আত্মপরিচয় বিধৃত করে
দিয়েছিলেন নিজস্ব আদলে :
"
রবি ঠাকুর বা নজরুল নই আমি, আমি শম্ভু রক্ষিত ; এবং যেহেতু ভিরমি খাওয়া পথের ওপর সমস্ত
ধুলো-ময়লা পরিষ্কার করার জন্য আমার গা শিউরে শিউরে উঠছে , খারাপভাবে জড়ো করা নানান
বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি হয়েছে আমার দেহাভিমান এবং সমস্ত বারণ অমান্য করে আমি আমার আত্মার
কাছে যেতে চাইছি। "
![]() |
লেখক কবি সুদীপ্ত মাজি |
লিখতে আসার প্রথম প্রহরে আমরা তখন সুযোগ পেলেই অগ্রজ
কবিদের বাড়ি দৌড়ে যেতাম। বিশেষ করে নিজের জেলায় বসবাসকারী কবিদের বাসায়! দু'দণ্ড আলাপ
করে কবিতার বহির্জগত সম্বন্ধে নানাবিধ তথ্যের যথেচ্ছ কাঁচামাল সংগ্রহ করে ফিরে আসতাম
নিজের ডেরায়, কখনও বা বন্ধুমহলে! কবিতাকে ঘিরে দিনরাত্রি উদযাপনের সে সব আশ্চর্য মায়াপ্রহর
সত্যিই বড় অনাবিল ছিল! শম্ভুদা তখন থাকতেন হাওড়ার কদমতলা সংলগ্ন ক্ষীরেরতলা অঞ্চলের
ঠাকুরদাস দত্ত লেনে, তাঁর মামার বাড়িতে! একবার হাওড়ার সেই বাড়িতে শম্ভুদার খোঁজ করতে
গিয়ে এক বাজখাঁই কন্ঠস্বরের মহিলার তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেঁচেছিলাম! বহুদিন পরে শম্ভুদার
সঙ্গে দেখা হতে ওঁকে বলেওছিলাম, সেকথা! কেন যে তাড়া করেছিলেন ভদ্রমহিলা, আজও সে রহস্য
শম্ভুদার জীবনপ্রণালী ও রচনারহস্যের মতো অনুদ্ঘাটিতই থেকে গেল! প্রসঙ্গত আরও দুয়েকটা
ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে! তাঁর কবিতার কাছে পৌঁছোনোর আগে সেগুলিও ব্যক্ত করে ফেলি!


কবি শম্ভু
রক্ষিত ছিলেন এরকমই একজন কবি-ব্যক্তিত্ব --- আমাদের কবিতাসভ্যতার সাজানো গোছানো বায়োস্ফিয়ারে
যিনি ছিলেন একজন নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধির মতো, অতুলন। প্রচলিত অভ্যাসের চিরাচরিত বহমানতার
মাঝখানে আশ্চর্য এক অনিয়মের প্রতিভূ হয়ে জাগিয়ে রাখতেন তাঁর চলাচল!
আমরা লক্ষ
করেছি, অদ্ভুত এক পরাবাস্তবতার আলো ছড়িয়ে থাকে শম্ভু রক্ষিতের কবিতায়। অজস্র দৃশ্যকল্পের
একত্র সমীকরণে শম্ভু তাঁর শব্দবিশ্বে একটু একটু করে ছড়িয়ে যেতে থাকেন তাঁর উচ্চারণ।
আপাত-অসংলগ্নতার আড়াল থেকে উঁকি মারে তাঁর চৈতন্য ও অবচেতনের কাছ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া
বোধের অভিজ্ঞান:
"
ক্রমশ সেই মুহূর্ত, ধনুক আর তূণ, রামধনুর ফোয়ারার মত শেষ তুষারস্তর সৌরপৃষ্ঠের বর্ণছত্র
যেন অতিক্রম করে গহ্বর অতল, তোমার অধুনালুপ্ত স্পর্শ অরণ্যের মত পড়ে থাকা রূপান্তর
প্রশান্তির গভীরে, অন্তর্নিহিত হয়ে বিশ্লেষিত উদ্ভাবনার ঊর্ধ্বে, অন্ত্য অনাবৃষ্টির
যুগের এই তন্ময়তা, জীর্ণপাতা পরীক্ষা, কৌতূহল চরিতার্থ করে যাও। "
( ১০৬ সংখ্যক কবিতা, প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না)
পাঠকপ্রিয়তার
বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর স্বর সম্পর্কে কবিতার রসিকজনের কয়েকটি মতামত আমরা দেখে
নিতে পারি প্রসঙ্গত :
১.
" কবির কাছে যে কোনো উপলব্ধি এবং পরিত্যক্ত কৌতূহল সারাজীবনই তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে
বেড়ায়, অভিকর্ষের আকর্ষণে কবি ছুটে যেতে পারেন মায়াসন্ধ্যার ছায়া বুকে নিয়ে।
"
[ গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় ]

[ অশোক দত্ত চৌধুরী ]
৩.
" আমরা বারবার লক্ষ করছি শম্ভু রক্ষিতের কবিতায় নতুনতর শব্দের অনিবার্য প্রয়োগ
; হৃদয়ের বহর, অনঘ মোহিনী কিংবা কান্নার প্রসূন ফলানোর শরাঘাত --- লোক দেখানো দ্রোহ
নয়, অন্তরের অমোঘ নির্দেশে মহাপৃথিবীর রহস্যময় ভাষায় শম্ভু নির্মাণ করেন পংক্তি সমগ্র।
"
[ বুদ্ধদেব বন্দ্যোপাধ্যায় ]
শম্ভু রক্ষিতের
কবিতার সাধনা তাই এক ধরণের দুরূহতার সাধনা --- আমাদের মনে হতে থাকে। নির্জন এককের পথে
চলা শম্ভু কখনও কখনও একটু সহজ হয়ে আসেন, দেখা-না-দেখায় মেশা তাঁর কবিতার অভিজ্ঞানকে
পাঠকের সংলগ্ন করে তোলার সাময়িক ইচ্ছাধীনতায়, যদিও তাঁর নিজস্ব ভাষাসরণির স্থাপত্য
তাতেও অক্ষুণ্ণ থাকে, অনিবার্যভাবে :
"
আমার স্ত্রী পুষ্টিকর দ্রব্যে সমৃদ্ধ যেন এক উদ্ভিদাণু
আমার শূন্যগর্ভ
উক্তিতে সুমুদ্রিত মোমের ছাপ
তার কণ্ঠস্বর অতিগম্ভীর, ঈষৎ কর্কশ
তার মুখের ডৌলটা নিরেট, রঙটা অর্থময় সাদা
আমার স্ত্রীর অপ্রত্যাশিত সব উদ্যোগ, উদ্বেগ
আর তার
অপরূপ ভাগ্য
তার শোলার
জুতো, কাঁচা রেশমের দস্তানা
তার ছত্রিশ
ব্লাউজ ধীরে শান্তভাবে
মাঝে মাঝে
বিরতি দিয়ে কথা বলে
আমি তাকে
কি আর প্রেমিকার মত ব্যবহার করতে পারি! "
( আমার স্ত্রী, আমার বংশধররা)
অনুসন্ধানী
এক কবিতাখননকর্মী শম্ভু রক্ষিত। অদৃশ্য এক মূলমধ্যরেখা দিয়ে সংযুক্ত হয়ে আছে তাঁর ব্যক্তিজীবন
আর কবিতার মহাকাশ। মহাপৃথিবীর নানা অস্থির তরঙ্গ ও রঙের পরিমাপক তিনি নিজস্ব প্যারামিটারে
নির্মাণ করে নিয়েছিলেন! নির্জন ও একক সেই অভিযাত্রায় তিনি শুধু দায়বদ্ধ থাকতে চেয়েছিলেন
সেই অন্তর্গত আলোড়ন ও নিঃশব্দ অন্তর্ঘাতের প্রতিই! কোত্থাও কোনোরকম কৈফিয়ত দেওয়ার সামাজিক
দায়কে অঙ্গীকার না করেই! প্রকৃত অর্থে শুধু সত্তর দশক নয়, আবহমান বাংলা কবিতার পরিমণ্ডলেই
তিনি চিরদিনের অপ্রতিম, নিঃসঙ্গ, একা!
কবিশম্ভু রক্ষিত স্মরণ -- কলমে জয়ন্ত শী
পেয়েছি অনেক শম্ভু-দার সান্নিধ্যে…
![]() |
লেখক জয়ন্ত শী |
আমি তখন সদ্য
প্রকাশনার জগতে আসি সে অর্থে
কারো সঙ্গে পরিচয় নেই। আমার স্যার তপন
কর আর্টিস্ট
ছিলেন।
সেই স্যারের
একটি স্টুডিয়ো
ছিলো। সেখানেই প্রথম
শম্ভু রক্ষিত-
কে দেখি। স্যারের
সাথে শম্ভুদার
হৃদ্যতা
ছিল অনেক
আগে থেকেই।
স্যারের একটি লেটার প্রেস ছিলো।
আগে প্রেসের কাজটা তো
সহজ ছিল না। ধরুন
আজকে প্রথম
ফর্মাটার ছাপা হলো তারপর
টাইপ করে
কয়েক
দিন পরে আবার দ্বিতীয়বার
ছাপা হলো। এভাবেই হতো। শম্ভুদা একটা পত্রিকা করবে
বলে স্যারের
কাছে গিয়ে
থাকতো সেখানেই
প্রথম শম্ভুদার
সাথে আলাপ
হলো।
শুনেছিলাম শম্ভুদা কোন একটি প্রেসে
চাকরি করতেন
এবং কাজের
শেষে রাত
জেগে কম্পোজ
করতেন নিজের
পত্রিকা মহাপৃথিবী-র কাজ
এবং নিজেই
সেই পত্রিকা
ছেপে বের
করতেন।
সেই সুবাদে
স্যারের স্টুডিয়োতে
মাঝেমধ্যে থাকতেন। পরে স্যারই
একদিন শম্ভুদাকে
নিয়ে আমার
এখানে আসেন।
শম্ভুদার অফিসটাই ছিল কফি হাউস। কফি
হাউসের বা-
দিকে ঢুকে
একটা টেবিলে ।
শম্ভুদা একমাত্র
ব্যক্তি যে
কফি হাউসের
চেয়ারে পা
তুলে বসতেন। অনেক
লেখক এর
লেখায় কবিতায়
তার উল্লেখ
আছে।

স্যার একদিন
শম্ভুদাকে নিয়ে এলো আমার মুক্তারাম
স্ট্রিটের অফিসে। শম্ভুদাকে
বল্লো তুমি
মাঝে মাঝে
এসে এখানে
বসতে পারো। এখানে
তোমার একটা
স্থায়ী যোগাযোগের
ঠিকানা ও
থাকবে আর
ওরো একটু
ভরসা হবে। কিছু
যোগাযোগও হবে। সেই
থেকে শম্ভুদা
আমার এখানে
আসতে শুরু
করে এবং
ধীরে ধীরে
আমাদের মধ্যে
এক আত্মীয়তা
গড়ে ওঠে
। সেই সময় অবশ্য শম্ভুদার কোন কাজ ছিল
না।
কম্পোজিটর মেশিন বদলে অফসেট
আসার ফলে
শুধু শম্ভুদা নয় প্রচুর
লোক রুজি-রুটি হারালো
। কারন অফসেটের সাথে
পাল্লা
দিতে পারলো
না সেই
পুরনো ছাপার
পদ্ধতি । আর এই কাজে যুক্ত
লোক গুলো এছাড়া অন্য কোন কাজও
জানতো না। ফলে অফসেট
মেশিনের যুগে তারা আর কোন কাজেও লাগলো
না।
আমি অবশ্য বললাম
যে শম্ভুদা
প্রেসে
কাজ করতেন কিন্তু শম্ভু দার সাথে পরিচয় হওয়ার
পরে এটা
অন্তত
বুঝলাম শম্ভুদা
কোনদিনই রুটি
রুজির জন্য
কাজ করতেন
না। এ ব্যাপারে
তিনি কোনদিনই
সিরিয়াস ছিলেন
না। শুধুমাত্র মহাপৃথিবী
ও অন্যান্য
ছাপাছাপির কাজ করার জন্য কাজ
করতেন বলেই
আমার ধারণা।

আগেই কথাপ্রসঙ্গে
রমাপ্রসাদ দত্ত বলেছিলেনন উনাকে কোন
একটি কবিতার পত্রিকার
একজন বলেছিলেন
যে "শম্ভু
রক্ষিতের এসব
ছাপাছাপি, নিজের কাজ করার দরকার
নেই আমরাই
তো করতে
পারি।
" আসলে ইমারজেন্সি পিরিয়ড এ শম্ভু
রক্ষিত
আট মাস জেল খেটে ছিল
তারপরে একটা
ব্যাপক অর্থে
শম্ভু রক্ষিতের নাম জনসমক্ষে উঠে
আসে। এবং সেই সময়
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় শম্ভু
রক্ষিতের লেখা মুদ্রিত
আকারে প্রকাশ পেতে থাকে। অবশ্যই
শম্ভুদা-ই সবজায়গায় লেখা
দিতে চাইতেন
না।
বলতেন 'আমি
লেখালেখি করবো
কি করবো
না ছাপাছাপি করবো না করবো
কি করবো
না তাকে
লেখা দেবো
আর কাকে
দেবো না
এটা নিয়ে কোন ক্যালানের কি
বল্লো তাতে
আমার আসে
যায়
না।
'
শম্ভুদা যে ইমার্জেন্সি
সময় আটমাস
জেল কেটে
ছিলেন।
সে সম্পর্কে
আমি উপযাচক
হয়ে কিছু
জিজ্ঞেস করিনি। শম্ভুদাই
কখনো সখনো
কিছু কিছু
টুকরো ঘটনা
নিজে থেকেই
বলেছিল , সেসময়
শম্ভুদার উপর
অমানুষিক অত্যাচার
হয় জেলে। উপর
দিকে পা
ঝুলিয়ে প্রচন্ড
টর্চার করা
হয়।
জেল থেকে
মুক্তি পাওয়ার
পরও সেই
সেই স্মৃতি
শম্ভুদাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আমৃত্যু।
রাতে ঘুমের
ভিতর আর্তনাদ
করে উঠতেন,
চোখে মুখে
ফুটে উঠতো
প্রচন্ড পায়ের
চিহ্ন।
সে ঘটনার
সাক্ষী আমি
নিজেই হয়েছিলাম
দু-রাত,
দেওঘরে।
এই ঘটনাটা
একজনকে বলেছিলাম,
তিনি বলেছিলেন
জেলে শম্ভু
রক্ষিতের উপর
প্রচন্ড অত্যাচার
হয় এরপর
থেকেই শম্ভুদার
রাতে এরকম
হয়।
সে আতঙ্ক
শম্ভুদা
হয়তো কোনদিনই কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
একদিন শম্ভুদার
সাথে ঠিক হল আমরা দেওঘর
যাব। একজন আমাদের নিয়ে
যাবে সে
নাকী দেওঘর
সম্পর্কে সব
জানে। কিন্তু
সেই ব্যক্তি
আর আসেনা
আমরা তার
জন্য অপেক্ষা
করে করে
শেষে শম্ভুদা-ই বল্লো
চলো আমরা
দুজনেই চলে
যাই।
এবং আমরা
দুজনেই এক
বস্ত্রেই, শম্ভুদার ঝুলাব্যাগে একটা গামছা
ছিল আর
কয়েকটি বই।
আমার দোকান থেকে একটা তোয়ালে
নিয়ে আমরা
দুজনেই রওনা
দিলাম রাতের
ট্রেনে।
রাতের সেই
ট্রেনেও আমাদের
কম অভিজ্ঞতা
হয়নি।
যাক পরদিন
ভোরে আমরা
ট্রেন থেকে
নেমে স্টেশনের
বাইরে থেকে
ম্যাজিকভ্যানে অনুকুল ঠাকুরের আশ্রমে গেলাম।
দেখি ওখানে নগরকীর্তন হচ্ছে শম্ভুদা
বল্লো চল
ওদের সঙ্গে
যাই।
ওদের সঙ্গে
ঘুরে ঘুরেই শহরটাকে
দেখে নেওয়া
যাবে।
নির্ঘুম রাতের
ট্রেনে জেনারেল
কামরার জার্নি,
রাতের খাবার
বলতে ছিল
চিড়ে-বাতাসা
সবমিলিয়ে আমরা ক্লান্ত
ছিলাম খুব। কিন্তু
শম্ভুদার উদ্যমের
কাছে হার
স্বীকার করতেই
হল
সুতরাং..

অনুকুল ঠাকুরের মন্দিরের
ছোট একটিনদী। দেওঘরের
সেই ছোট্ট
নদীতে আমরা
সঙ্গে আনা
গামছা ও
তোয়ালের সদ্ব্যবহার করলাম। স্নান
সেরে দেখি
আশ্রমে খাবার
জন্য সুবিশাল
লাইন।
পেটে তখন
প্রচন্ড খিদে। খাবার
জন্য এমন
আন্দোলন জীবনে
সেই প্রথম
করেছিলাম।
শম্ভুদা আর
আমি সেই
ভীড়ে আলাদা
হয়ে গেলাম। পরে
দেখি শম্ভুদা
অনেকটাই এগিয়ে
গেছে।
যাক খাবার
পর নদীর
পাশেই খানিকটা
বিশ্রাম নিয়ে
আমরা শহর
দেখতে বেরিয়ে
পরলাম।
তখন মূলমন্দিরে
সভার আয়োজন
চলছে।
ঘুরতে ঘুরতে
আমরা একসময়
অনুকুল ঠাকুরের
ছোট ছেলের
বাড়ীতে এলাম। দেখি
ওখানেও
সৎ সংঘের সভা হচ্ছে। যদিও এখানের আয়োজন
তুলনামূলক অনেক ছোট। আগত
ভক্তরা সবাই
ধোপদুরস্ত সাদা পোশাকে আর
আমরা কলকাতা
থেকে এক
পোশাকে বেরিয়েছিলাম,
শম্ভুদার পোশাক
আরও একটু বেশীই ময়লা হয়তো বেশ কয়েকদিন আগে
কাঁচা হয়েছিল।
শম্ভুদাকে যারা চেনেন
তারা জানেন
পোশাক-আশাকে
শম্ভুদা
কখনোই পরিপাটি নয়। একপোশাকে
দিনের পর
দিন কাটিয়ে
দিতে পারেন
নির্দ্বিধায়। আমরা
পিছনের সারির সবার শেষে
বসে পড়লাম
দুজনে। কিছুক্ষণ
পর শম্ভুদা
এগুতে লাগল
ধীরে ধীরে
একসময় একসময় তিনি পৌঁছে গেলেন
অনুকুল ঠাকুরের
ছোট ছেলের
কাছে এবং
কি এক
আলোচনায় মেতে
উঠলেন দুজনে। শম্ভুদা
ব্যাগ থেকে নিজেরই প্রকাশির আলোক সরকার-র
বই ও
তার সম্পাদিত
পত্রিকা মহাপৃথিবী দিলেন
তাকে।
আমি
অবাক দর্শক মাত্র। তারপর
আমরা বেড়িয়ে
এলাম।
এবার আর
চুপ থাকতে
পারলাম না,
শম্ভুদাকে বললাম, চিনতে নাকি! শম্ভুদা
বলল, "প্রথমে ঠিক বুঝতে পারিনি, তার
কথা শুনতে
শুনতে পরে
মনে হলো
চিনি।
তিনি ডাক্তার
কলকাতায় বাড়ী
আছে।
আগে ছোটদের
নিয়ে একটা
পত্রিকাও করেছেন
আর তাতে
আমি দু-তিনবার লিখেওছি। সেটাই
তাকে বললাম,
এবং সেও
আমাকে চিনতে
পারলো।
তাই বই
ও কাগজ
দিলাম।"
সেদিন রাতে
আমরা কোন ঘর না পেয়ে রাস্তার পাশে শেডের
নিচে আরও
কিছু মানুষের
সাথে রাত্রি
যাপন করেছিলাম। পরদিন সকালে কলকাতায়
ফেরার ট্রেনে
উঠে বসি।

জ্যোতির্ময় দত্ত-র কথা মাঝেমধ্যেই বলতেন। পরবর্তী সময়েও জ্যোতির্ময় দত্ত-র সম্পাদনায়
একটি পত্রিকা বের হয় । অনুরাধা মহাপাত্র ছিলেন সহসম্পাদক। শম্ভু-দাকে সেই পত্রিকা
বিক্রি করতে দেখেছি। শম্ভু-দা মহাপৃথিবীর কাজ প্রায় শেষ কিন্তু রমেন্দ্রকুমার
আচার্যচোধুরীর লেখা তখন পাননি তাই পত্রিকা বের হতেও দেরী হচ্ছে। আবার
রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরীও মহাপৃথিবীতে লিখতে খুবই ভালোবাসতেন। ‘কৃত্তিবাস’ থেকে
প্রকাশিত তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘আরশিনগর’ ‘রবীন্দ্র’ পুরষ্কারে সন্মানিত হয়
পরবর্তীতে শম্ভুদা মহাপৃথিবী থেকে সেই বইয়ের সাথে আরও দু-তিনটি পাণ্ডুলিপি জুড়ে
দিয়ে প্রকাশ করলেন। “ব্রহ্ম ও পুঁতির মউড়ি” ।

একবার দেবীবাবুর কাছে শম্ভু
রক্ষিত সম্পর্কে জানতে
চাইলাম - শম্ভুদা
সম্পর্কে দেবীবাবু
বলল,
"শম্ভু জেনুইন।
তার মধ্যে
কোন ছলনা
নেই তার
ভিতরটা
যেমন বাইরেটা তেমনি।
আসলে আমরা সকলেই তাকে খুব-ই ভালোবাসি।" কালীকৃষ্ণ গুহ শম্ভুদা সম্পর্কে বলেছিলেন, এমার্জেন্সির সময়
সকলেই একে
একে সরে
গেলেও শম্ভু-ই একমাত্র
তার অবস্থানে
স্থির
ছিল। তারই পরিচালনায়
এবং ভূমেন্দ্র
গুহ, রবিন মন্ডলের
উদ্যোগে কলকাতার
একচল্লিশজন খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী পরিতোষ
সেন, যোগেন
চৌধুরী, , তপন মিত্র, চিত্রপরিচালক সন্দীপ
রায় প্রমুখের উপস্থিতিতে ২০০৪ সালে
শম্ভু রক্ষিতের
আর্থিক সাহায্যার্থে চিত্রকলা
প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়।
শম্ভু রক্ষিত-র
সমগ্র করছি। সেটার
ভুমিকা লিখে
দেবার জন্য
দেবীবাবুকে বললাম। তিনি
বললেন ভুমিকা
লিখতে গেলে
তো শম্ভু-র সবগুলো
কাব্যগ্রন্থ পড়তে হবে।আমি
তো সবগুলি
কাব্যগ্রন্থ পড়িনি এই বয়সে আর
কি পারব। একটা
পত্রিকার উল্লেখ
করে তার
চেয়ে বরং এই পত্রিকার সম্পাদকের
সাথে যোগাযোগ
করো।
এই পত্রিকায়
একটি নতুন
ছেলে শম্ভুকে
নিয়ে খুব
ভালো লিখেছে। ওকে
দিয়ে লিখাও
সেটা বরঞ্চ
ভালো হবে।

আমার প্রকাশনার জগতে
শম্ভুদার অবদান
অনস্বীকার্য আলোক সরকার,
দেবীপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায়-র সাথে আমার পরিচয়ের সূত্র
কিন্তু শম্ভুদা-ই।
দেবীবাবু একটি
পত্রিকা করবে। শম্ভুদা
দেবীবাবুকে বলেছিল ও খুব ভালো
ছেলে।
প্রকাশনায় প্রায় নতুনই ওকে আপনি
কাজটা দিতে
পারেন।
দেবীবাবু সেদিনই
লেখাপত্র দিয়ে
দেন। এবং বলেন কত, কি কি লাগবে
আমাকে বলো
আমি সবটাই
দিয়ে দেব। সেটা
শুধু শম্ভুদার
কথাতেই, দেবীবাবু
কোনদিন আমার
দোকানে
আসেনি। এমনকি আমার নাম
পর্যন্ত শুনেননি
কোনদিন।
দেবীবাবুর সাথে আলাপ হওয়ার সময়
সেরকম ভালো
কোন লেখকের
বই পর্যন্ত
আমি করে
উঠতে পারিনি। শুধুমাত্র
শম্ভু বলেছে
এই কথার
উপরে তিনি
আমাকে বই
দিয়েছিলেন।
কোন কারনে
কাজ পিছিয়ে
গেলে, দেবীবাবু
আমাকে ফোন
করে বলতেন, “এতো ঘুরাচ্ছো তুমি,
শুধু শম্ভু
পিছনে আছে
বলেই আমি
তোমাকে এতো
প্রশ্রয় দিচ্ছি”। এরকম অনেক ঘটনায়
আছে।
আমার অনেককিছু
গড়ে ওঠা
শম্ভুদার জন্য।

এতে সদস্যতা:
পোস্টগুলি (Atom)
উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বনিক
উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বণিক উৎসবের আর মাত্র কয়েকটা দিন, একদম হাতে গোনা। আর উৎসব সংখ্যা ছাড়া উৎ...

-
সুরমা গাঙর পানি: দেশভাগ ও নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবন আখ্যান প্রলয় নাগ ‘ ‘বোদলেয়ারের বন্ধু থিয়োফিল গোতিয়ের একটি অণু-কবিতায় জান...
-
শেষ বর্ষা মেঘ ফুরোচ্ছে। একটা আত্মতৃপ্তি লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মুখ ভার করছে স্মৃতিরা। ফুটন্ত ভাতে নোনাজল থৈথৈ করছে। রেডিও তে তখন গম্ভী...
-
উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বণিক উৎসবের আর মাত্র কয়েকটা দিন, একদম হাতে গোনা। আর উৎসব সংখ্যা ছাড়া উৎ...