গানের ভিতর দিয়ে যখন
লেখক মৃদুল শ্রীমানী |
মানোএল দা আসসুম্পসাঁও রোমান হরফে বাংলা ভাষার ব্যাকরণ লিখেছিলেন। নাথানিএল ব্রাসি হালেদ বাংলা ভাষায় ব্যাকরণ লিখলেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের তরফে উইলিয়াম কেরী কিছু বাঙালি পণ্ডিতকে ডেকে বাংলা ভাষায় বই লিখতে বললেন। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামরাম বসু প্রমুখ পণ্ডিত সাহেব পড়ানোর দায়ে বাংলা ভাষায় লেখা লেখি শুরু করলেন। তবে সে ফরমায়েশি কেজো গদ্য। শিল্পবস্তুর সন্ধান দেওয়া মাইনে করা পণ্ডিতের ক্ষমতার বাইরে।
বাংলা গদ্যভাষায় মনের উচ্চ ভাবপ্রকাশ সর্বপ্রথম করলেন রাজা রামমোহন রায়। বাঙালির কলমে বাংলাভাষার ব্যাকরণ বই রচনার কৃতিত্বও এই রাজার। গণিতের বই ক্ষেত্রতত্ত্বসার রামমোহন রায়ের আর এক কীর্তি।
একদিকে আরবী ফারসি, অন্যদিকে সংস্কৃত ভাষায় গভীর জ্ঞান, তার সাথে ইংরেজি ভাষায় পাণ্ডিত্য রাজাকে বহুভাষাবিদ করে দিয়েছিল। বিভিন্ন সংস্কৃতির ধর্মগ্রন্থ তিনি গভীরভাবে পাঠ করে এক অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করেন। এই পুঁজি নিয়ে রাজা তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় মাতলেন। সংবাদপত্রে বিতর্ক মূলক লেখা ছাপিয়ে তিনি বাংলা ভাষায় বিতর্কের পরিসর গড়ে দেন। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও সমাজ সংস্কার করার প্রয়োজনে রামমোহন রায়ের দেখানো পথে বিতর্ক মূলক রচনা চালিয়ে গিয়েছেন।
রাজা রামমোহন রায়ের ভাষায় বলিষ্ঠ ভাব ছিল, ছিল যুক্তি বিন্যস্ত চিন্তার প্রকাশ। কিন্তু ততটা মিষ্টতা ছিল না। সে জিনিস উপহার দিয়েছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলা ভাষার প্রথম শিল্পী তিনিই। হিন্দি, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষার সাহিত্য পাঠ করে তিনি সাধারণ ছাত্রের স্বার্থে বেতাল পঞ্চবিংশতি, সীতার বনবাস, শকুন্তলা ও ভ্রান্তি বিলাস লিখে বাংলাভাষার সম্পদ তৈরি করলেন।
১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্মেছিলেন আমাদের মধুকবি। মাইকেল মধুসূদন দত্ত। আমাদের বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগে একমাত্র মহাকবি। ১৮৭৩ এ প্রয়াত হন। ১৮৬১ তে প্রকাশিত তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য। ওই মেঘনাদবধ কবে থেকে পড়ছি । এখনো বিস্ময় আর আকুলতা কমে নি। ওজস্বিতায়, উপমার অসামান্য ব্যবহারে, রূপকে , অলঙ্কারে তো বটেই; কবিতার আসল যে প্রাণসত্ত্বা, সেই মন্ময় গভীরতায় মেঘনাদবধ আজো আমাকে নিবিড় তৃপ্তি দেয়। আমি মনে মনে বেশ কিছু পংক্তি অক্লেশে আউড়ে যেতে পারি।
বাংলাদেশের কপোতাক্ষ নদের তীরে সাগরদাঁড়ি গ্রামে সম্পন্ন শিক্ষিত ব্যবহারজীবী পরিবারের আদরের দুলাল হয়ে জন্মেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। নিরালা নিরুপদ্রব সুখী জীবনের হাতছানি এড়িয়ে নিজের হাতে গড়লেন নিজের কবিজীবন। ইংরেজি ভাষায় লিখবেন, ইংরেজিতে ভাববেন, ইংরেজিতে স্বপ্ন দেখবেন, এসব উলটে পাল্টে গেল। খুঁজে পেলেন নিজের কবিভাষা। লিখলেন মেঘনাদবধ কাব্য। রামায়ণ নিয়ে সাধারণের বিশ্বাসকে অন্য রকম করে দেখলেন। রামকে দেখালেন পরদেশে আক্রমণকারীর বেশে। রাবণ ও ইন্দ্রজিৎকে স্বদেশপ্রেমী বীর করে। এই যে নতুন করে দেখানোর চেষ্টা ওঁকে বাংলা ভাষার মহাকবি করে দিল।
বড়ো কবির মেধা মনন আর স্পর্ধা ছিল তাঁর। ছাপোষা কেরানীর মন নিয়ে তো আর তাঁকে বোঝা সম্ভব নয়। তাঁর পিতার অর্থ ছিল। ছিল চালু ওকালতি ব্যবসাও। কবি ছিলেন ব্যারিস্টার। বাবার মক্কেলদের যোগাযোগ যদি নাও পেতেন তবু কেজো বুদ্ধির লোকের পক্ষে ওই পেশায় রোজগারের অভাব তো হতো না।
কিন্তু তিনি কবিজীবনকে পেতে চেয়েছিলেন। অনিশ্চিতের পথে ঝাঁপাতে দ্বিধা তিনি করেন নি। যথার্থ কবি পা টিপে টিপে, শাসকের মন যুগিয়ে, সমকালের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলেন না।
তাঁরা যুগের জন্ম দেন।
তাঁদের আশ্রয় করে ইতিহাসের বাঁক বদল হয়।
বাংলায় সে সময় যে নাটক অভিনীত হচ্ছিল, তা দেখে তাঁর মোটেও ভাল লাগে নি। অবশ্য বড় মানুষদের মধ্যে একটা মহৎ অতৃপ্তি বোধ কাজ করে। তিনি বলেছিলেন "অলীক কুনাট্য রঙ্গে মজে লোক রাঢ় বঙ্গে, নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়। " তিনি নিজেই নাটক লিখে দেখিয়ে দিলেন নাটক কেমন হতে পারে।
নাটকের সাথে প্রহসনও লিখেছিলেন। সমকালীন বাঙালি জমিদার বড়লোকের নারীঘটিত কুঅভ্যাসকে ব্যঙ্গ করে দুটি নাটিকা। একেই কি বলে সভ্যতা, আর বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ ।
নারীমাংস ভোগের বেলা জমিদার মহাজনের জাতবিচার কোথায় থাকে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে জমিদার মহাজনেরা যে গরিবের ঘরের নারীর ইজ্জত লুটতে সমান দক্ষ ছিল, তিনি কলমের মুনশিয়ানায় সেটা দেখিয়েছেন। জাত নয়, এদের শ্রেণীচরিত্র উন্মুক্ত করেছেন কবি। শ্রেণীচরিত্র অনুধাবন করার ক্ষমতা তাঁর কলমের জাত চিনিয়ে দেয়।
ওই যে তিনি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে খ্রিস্টান হলেন, সেটা কেন? কেন না, ওঁর প্রবল ইচ্ছে ছিল গ্রীক রোমান ধ্রুপদী সাহিত্য সরাসরি পড়বেন। তাই সেই গ্রীক ল্যাটিন ভাষা শেখা প্রয়োজন ছিল। আর সেই সব সভ্যতার পুরাণকথা পড়তে, তাদের সংস্কৃতির ভিতর মহলের কথা জানতে পাদ্রীদের সঙ্গলাভ ছিল বাস্তব প্রয়োজন। ব্যক্তিগত স্তরে যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরি না করে উঠতে পারলে দত্তকুলোদ্ভব কবির পক্ষে সেই যুগে ওই ভাষা সংস্কৃতির নিবিড় পাঠ সম্ভব হত না।
একে কবিধর্ম পালন ছাড়া আর কি বলব?
বাংলায় সে সময় যে নাটক অভিনীত হচ্ছিল, তা দেখে তাঁর মোটেও ভাল লাগে নি। অবশ্য বড় মানুষদের মধ্যে একটা মহৎ অতৃপ্তি বোধ কাজ করে। তিনি বলেছিলেন "অলীক কুনাট্য রঙ্গে মজে লোক রাঢ় বঙ্গে, নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়। " তিনি নিজেই নাটক লিখে দেখিয়ে দিলেন নাটক কেমন হতে পারে।
নাটকের সাথে প্রহসনও লিখেছিলেন। সমকালীন বাঙালি জমিদার বড়লোকের নারীঘটিত কুঅভ্যাসকে ব্যঙ্গ করে দুটি নাটিকা। একেই কি বলে সভ্যতা, আর বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ ।
নারীমাংস ভোগের বেলা জমিদার মহাজনের জাতবিচার কোথায় থাকে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে জমিদার মহাজনেরা যে গরিবের ঘরের নারীর ইজ্জত লুটতে সমান দক্ষ ছিল, তিনি কলমের মুনশিয়ানায় সেটা দেখিয়েছেন। জাত নয়, এদের শ্রেণীচরিত্র উন্মুক্ত করেছেন কবি। শ্রেণীচরিত্র অনুধাবন করার ক্ষমতা তাঁর কলমের জাত চিনিয়ে দেয়।
"বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ" - হ্যাঁ , বানানটা ঠিক এই রকম ছিল । বইমেলায় গিয়ে অতি ছোটো সাইজের বইটি মাঠে ঢেলে বিক্রি হচ্ছিল । আমি ক্লাস সেভেন এইটের ছোটো ছেলে নিজের খুশিতে সেই মিনি বুক কিনেছিলাম গোটা একটাকা দিয়ে । তখনকার দিনে লোকে ছোটোদের ভালবেসে একটাকা দিতে পারত । ওই মিনি বইতে আরো একটি নাটক ছিল - "একেই কি বলে সভ্যতা" । দুটো নাটক এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলেছিলাম। মাইকেলকে ভালোবাসার সেই শুরু ।
'বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ' নাটকটিতে দেখেছি হিন্দু জমিদার মুসলিম মেয়ের শরীর ছুঁতে চেয়ে লোক লাগিয়েছেন। মুসলিম মেয়ের শরীর ছুঁতে চাইলে হিন্দু ধর্মধ্বজীর ধর্ম নষ্ট হয় না। আসলে ততদিনে জেনে গিয়েছি , দুটো মাত্র জাত আছে - গরিব আর বড়লোক । এই ধরুন রামা কৈবর্ত আর হাসিম শেখ - এদের কিন্তু গরিব বলে চিনতে শিখেছি - হ্যাঁ , শিখেছি বঙ্কিমের হাত ধরে । মাইকেলের নাটক পড়ে অসহায় মুসলিম মেয়ের জন্যে মন কাঁদল ।
"ছিনু মোরা সুলোচনে গোদাবরী তীরে ..."। হ্যাঁ, ঠিক এভাবেই সীতা সরমার সাথে গল্প করছেন অশোকবনে। শব্দবিন্যাস যাই হোক না কেন, একটি বধূ যে আর একটি বধূর সাথে সুখদুঃখের গল্পটি করে , আমি তার আমেজ পূর্ণমাত্রায় পেয়েছিলাম ওই কটা শব্দে ।
'দাস' - কথাটা যে এভবে ব্যবহার করা যায় , ছোটবেলায় মাইকেল না পড়লে বুঝতাম না। মেঘনাদ ইন্দ্রজিৎ তার কাকা বিভীষণ এর সাথে বাক্যালাপ করার সময় নিজেকে দাস বলছেন। আবার কবিও আত্মবিলাপমূলক কবিতায় নিজেকে "দাস" বলছেন। 'রেখো মা দাসেরে মনে'। ওই দাস শব্দটি আমার মর্মে লেগে আছে ।
কেন তিনি মহাকবি ? নিজের ভেতরের মানুষটির কাছে বারবার জানতে চেয়েছি। বাবার চালু আইন ব্যবসায় নিজেকে রপ্ত করে প্রতিষ্ঠা পাবার সব রকমের সুযোগ ওঁর ছিল । সে সব দিনে বিদেশি ভাষা শেখার আজকের মতো সোজা সরল বাঁধানো রাস্তা ছিল না। সে বিদেশি ভাষার নাড়ী নক্ষত্র মেজাজ মরজি আগাপাশতলা বুঝবেন, বিদেশের পুরাণ উপপুরাণ ভালো করে বুঝবেন বলে নিজের কৌলিক ধর্ম পরিত্যাগ করলেন । জাত ধর্ম সব কিছু ত্যাগ করে মাইকেল যেন সুস্থিতি আর নিরাপত্তার সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিলেন নিজের । ওই বিদেশি ভাষা আর তার সংস্কৃতির অন্দর মহলে না ঢুকলে মহাকাব্যিক মেজাজে নিজেকে দীক্ষিত করতে পারতেন না। এ যেন ঝড়ের মুখে পাল তুলে দেওয়া ।
অলীক কুনাট্য রঙ্গে --- সম সময়ে বাঙালি যে জীবনটা যাপন করছিল তাতে বড়ো কিছু করার স্পর্ধা , বড়ো করে ভাবার চেষ্টা প্রায় লোকের ছিল না। গতানুগতিক থেকে বাংলা কবিতাকে ছিটকে বের করে আনলেন। বাংলা ভাষায় একটা বড়ো মাপের কাঁপন ধরিয়ে দিলেন । ওই 'ইরম্মদময় বজ্র' কথাটা বেশ মনে পড়ে। বজ্র শব্দের আগে ওই 'ইরম্মদ' কথাটার ব্যবহার কোথাও পাই নি । 'কোকনদ' আর 'তামরস' শব্দ দুটিও আমার ভেতর যেন একটি একটি করে কমল খুলতে থাকে , ইড়া পিঙ্গলা বেয়ে কোন সহস্রারের দিকে ধেয়ে চলি প্রিয় কবির হাত ধরে ।
চলবে ...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন