রবিবার, ১৪ জুন, ২০২০

কল্পবিজ্ঞানের গ্লপ -- কবি দেবাশিস দাশ



অব্যর্থ টিএমএ    




প্রচণ্ড যানজটের দরুন আমাদের সময়সূচি বিগড়ে গেল একেবারে ওড়িশা-বর্ডার পেরোতে পেরোতে সিদ্ধান্ত নিলাম, ভুবনেশ্বরে ঢোকার আগেই কোথাও একটা রাত্রিবাসের উপযুক্ত ব্যবস্থা খুঁজতে হবে নেট সার্চ করছিলাম আমি, কিন্তু সফরসঙ্গীরা আমাকে আশ্বস্ত করল দেখলাম, গোটা পথের ব্যাপারে ওরা যথেষ্ট ওয়াকিবহাল আপাতত রাত থাকতে-থাকতেই যতদূর টানা যায় গাড়ি এগিয়ে নিতে চাইছিল ড্রাইভার
"অ্যাবস্ট্রাক্ট সায়েন্স!— এটাই তো আপনার বিষয় বললেন, তাই না, ডঃ দেবমিত্র?" প্রশ্নটা আমার দিকে ছুড়ে দিলেন অর্ঘ্য মণ্ডল ভদ্রলোক আমার বন্ধু সৌমেনের বস একটা সামুদ্রিক নিরাপত্তা সংস্থার বিপণন তথা রক্ষণাবেক্ষণের পূর্ব ভারতীয় শাখার দায়িত্বে রয়েছেন ভদ্রলোক। ক'দিন আগে, ফ্লোটেলে আয়োজিত একটি সমুদ্রবিজ্ঞান বিষয়ক অনুষ্ঠানে আলাপ হয়েছিল আমাদের আমার গবেষণার পরিধি সম্পর্কে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। জানতে পারলাম, কাকতালীয়ভাবে একই দিনে ওঁরাও নিজেদের কাজে ভুবনেশ্বর যাচ্ছেনআমার প্রোগ্রাম পাকাপাকি করা ছিল নাভেবেছিলাম, তৎকালে টিকিট বুকিং করে নেব অবস্থা বুঝেতার আর প্রয়োজন হল না 
গল্পকার দেবাশিস দাশ
বিকেল সাড়ে চারটের ভেতর সৌমেন আর ওর বস অফিস থেকে এসইউভি গাড়ি নিয়ে রওনা হলমিঃ মণ্ডলের প্রস্তাব অনুসারে, টোল-প্লাজার কাছ থেকে আমাকে পিক-আপ করে নিল ওরাএকসঙ্গে আড্ডা মারতে-মারতে বাই-রোড নৈশ-অভিযানে শামিল হতে এককথাতেই রাজি হয়েছিলাম
রাস্তায় একটা ধাবায় রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে নিলাম আমরা চণ্ডীখোল পৌঁছে চলনসই রুম জোগাড় করা গেল 'মিড ইস্ট' নামক একটা হোটেলে দোতলায় ওঠার সময় মধ্যরাতে সিঁড়ির মুখে দেখলাম, একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক ঢাউস একটা লাগেজ টানতে-টানতে ঢুকছেন রাতবিরেতে এতগুলো অনাহূত অতিথির কাছ থেকে অ্যাডভান্স আদায় করে ম্যানেজার একজন ঘুমকাতুরে কর্মচারীকে পাঠিয়ে দিল ঘরদোর বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য

||২||

সকাল-সকাল ভারী শোরগোলের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল দরজা খুলে দেখি, রাতের দুই কর্মচারী আর রিসেপশন কাউন্টারে বসা সেই ম্যানেজার,— উঁচু গলায় বিস্ময় প্রকাশ করে স্থানীয় ভাষায় বকবক করছেহোটেলের প্রত্যেকটা রুমে ঢুকে বাথরুম খানাতল্লাশি করতে লেগেছে ওরাঅকুপ্যান্ট অতিথিরা সেই নিয়ে রীতিমতো অসন্তুষ্ট
জানতে পারলাম, কাল রাতে আমাদের ফ্লোরেই উঠেছিলেন বছর ষাটেকের এক বাঙালি ভদ্রলোক, যাঁর নাকি সকাল থেকে কোনও হদিশ পাওয়া যাচ্ছে নাআমরা যেহেতু প্রায় একই সময়ে হোটেলে চেক ইন করেছিলাম, সুতরাং আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হল অনেকক্ষণ ধরে।
ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে ঠেকলযে-রুমে তিনি উঠেছিলেন, তা ভেতর থেকে অটো-লক করাই ছিল হোটেল এনট্রান্স দিয়েও কাউকে বেরোতে দেখা যায়নি। 
ভোর-ভোর বন্ধ দরজার ফাঁক গলে এক ধরনের বাদামি তরলের ধারা বেরিয়ে আসতে লক্ষ করে একজন হোটেল কর্মী অনেকক্ষণ হাঁকডাক আর দরজা ধাক্কানোর পরেও কোনোরকম সাড়াশব্দ না পেয়ে ওরা অবশেষে অতিরিক্ত বিশেষ চাবির সাহায্যে ঘরে ঢোকেভেতরে কিন্তু মানুষটির চিহ্নমাত্র পাওয়া যায় না পরিবর্তে একটি তিনপেয়ে ধাতব কাঠামো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় বাথরুমের দরজার সামনেওই রুমে ঢুকে দেখে এলাম, তিনটি পায়াওয়ালা এই খাঁচাটা অনেকটা একটা তাঁবুর মতো আকৃতি ধারণ করে আছে চট করে দেখলে মিশরের পিরামিডের ছবিও মনের পর্দায় ভেসে উঠতে পারে। 
তরল পদার্থের স্রোত গড়িয়ে এসেছে ট্রাইপড কাঠামোর ভেতর উলটে-পড়া স্নানের বালতি থেকে, যেটাকে সম্ভবত মেঝের ওপর ত্রিভুজাকার ভূমিতলের মাঝ-বরাবর বসানো হয়েছিল কোনও এক অজ্ঞাত কারণে।
ঘটনাটা শুনে মনে পড়ল, শেষ রাতের দিকে একবার সম্ভবত পচা-পচা অদ্ভুত মিষ্টি একটা গন্ধের রেশ টের পেয়েছিলাম কিন্তু পথযাত্রার ক্লান্তিতে ভালো করে বুঝে দেখার মতো মানসিকতা ছিল না খুব ফিকে হয়ে গেলেও সেই গন্ধটা কিন্তু ওর রুমে রয়ে গেছে এখনও

||৩||
অশোকনগরের কাছে ভুবনেশ্বরের নির্দিষ্ট গন্তব্যে আমাকে নামিয়ে দিয়ে নিজেদের কাজে চলে গেছে সৌমেনরাঠিক হয়েছে, সন্ধ্যার ভেতর কাজকারবার শেষ না হলে আবার একসঙ্গে রাতে থাকব আমরা তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের অধিবেশন বসেছে হোটেলের কনফারেন্স রুমে জনা কুড়ি বিজ্ঞান-ভাবুক এবং কয়েকজন বিজ়নেস ম্যানেজমেন্টের মানুষ একটা পরিকল্পিত বিষয় নিয়ে মত বিনিময় করছে এবং প্রোজেক্টরের সাহায্যে একটি স্ক্রিনে গবেষণাধর্মী লেখা পেশ করছেবক্তৃতা-সভায় ঢুকে যাঁর পাশের খালি সিটে বসলাম, একেবারে চমকে গেলাম তাঁর দিকে তাকিয়ে শ্বেতাভ ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি দেখেই চিনতে ভুল হল না যে, এই ভদ্রলোককেই কাল রাতে চণ্ডীখোলের হোটেলে একঝলক দেখেছিলাম সিঁড়ির বাঁকে 

"বাঙালি মনে হচ্ছে?" গম্ভীর টোনে পরিষ্কার বাংলায় কথাগুলো উচ্চারণ করেই হ্যান্ডশেক করার উদ্দেশ্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি, "আমি ডঃ অগ্নীশ দত্ত।
এই নামটাই কাকভোরে মিড ইস্ট হোটেলের কাউন্টারে সাড়া ফেলে দিয়েছিল, মনে পড়ল নাম-এন্ট্রির সময় পরিচয়পত্রের যে-ফটোকপি জমা নেওয়া হয়েছিল, তা থেকেই কিছু প্রাথমিক খোঁজখবরের কথা ভাবছিল হোটেলওয়ালাভদ্রলোকের সেলফোন ছিল আউট-অফ-রিচ। নিজের অপ্রস্তুত ভাব যথাসম্ভব গোপন করতে-করতে একটা বিজ়নেস কার্ড এগিয়ে দিলাম তাঁর দিকে এর মধ্যে একজন বিজ্ঞানীর বক্তৃতা শুরু হয়ে যাওয়ায় খানিক সময় পেয়ে গেলাম ধাতস্থ হওয়ার জন্য
লাঞ্চের বিরতিতে জড়তা কেটে গেল আমারডঃ দত্তের সঙ্গে আলাপ অনেকটাই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল। 
"তোমাকে 'তুমি' বলছি আপত্তি নেই তো?" বললেন ডঃ দত্ত, "বয়সের দিক থেকে দেখলে আমি তো প্রায় বুড়োই হয়ে গেছি, আর কী? তাছাড়া আমার এক ভাগ্নে আছে কলকাতায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ফ্যাকালটি। হয়তো চিনলেও চিনতে পারো নাম আরণ্যক নন্দী তোমারই মতো বয়েস
"আরে, আপনিই তাহলে আরণ্যকের সেই বিখ্যাত মামা? নাম জানতাম না, কিন্তু আপনার যৌবনকালের আশ্চর্য কাহিনি শুনেছিলামআসলে আমরা কলেজ-মেট ছিলাম..."
"তাহলে তো খুবই ভাল হল," বললেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী 
"আচ্ছা, আপনি কি কাল রাতেই ভুবনেশ্বর এসে পৌঁছেছেন?" আমি একটু গোপনীয়তায় খোঁচা মারলাম এবার মুচকি হেসে জানালেন তিনি, "তোমাদের সঙ্গে মিড ইস্টে এক-ঝলক দেখা হয়েছিল, আমিও সে কথা মনে রেখেছি
দেখলাম, ভদ্রলোকের নজর এড়ায়নি কিছুই সাহস পেয়ে মুখ খুললাম এবার, "আপনাকে নিয়ে তো হইচই বেঁধে গেল সাত-সকালে কী ঘটেছিল, জানতে পারি কি? অবশ্যই যদি আপনার আপত্তি না থাকে..." আমার ঘরোয়া ব্যবহারে মনে হল খুশি হলেন ভদ্রলোক প্রশ্নের উত্তরে বললেন, "আপত্তির কিছু নেই কোনও অপরাধ তো করিনি হোটেলে যত টাকা আগাম দেওয়া ছিল, রুম ক্লিনিং চার্জ যোগ করলেও অখুশি হওয়ার কোনও কারণ নেই ওদের"
—"তেপায়া জিনিসটা ফেলে রেখে এসেছেন, ম্যানেজার খুব ঘাবড়ে আছেআসলে দিনকাল তো সুবিধের নয় তাছাড়া অন্তর্ধানেরই বা কী এমন কারণ ঘটে থাকতে পারে?" 
—"শোনো ইয়ং সায়েন্টিস্ট, ওটা কোনও হার্মফুল কিছু নাস্টিলের ফোল্ডেবল একটা ট্রাইপড মাত্র মনে হয় না পুলিশকে জানাবে ওরাজানালেও খুব গুরুত্ব পাওয়ার মতো ব্যাপার নয়। বাই দ্য ওয়ে, আমি অলরেডি একটা ফোন করে যা বোঝানোর বুঝিয়ে দিয়েছি ম্যানেজারকে জিনিসগুলো পরে গিয়ে ঠিক সময়ে নিয়ে আসব" বলে, একটু রহস্যময় হেসে আমার চোখে সরাসরি দৃষ্টি ফেলে বললেন, "রাতে আমার সঙ্গে থাকতে পারবে? তাহলে ডিটেইলস্ আলোচনা করা যাবে অবশ্য সে-ক্ষেত্রে আমার রিকোয়েস্ট হবে, যাতে অন্য কেউ, মানে তোমার সঙ্গীরাও না জানতে পারে আমার ব্যাপারে... এটা একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণার কাজ, বুঝতেই পারছ..."
—"ওরা একেবারে অন্য জগতের লোক
—"তবু আমি চাই না এসব এখনই কেউ জানুক তুমি আমার ভাগ্নের বন্ধু, একেবারে ঠিক সময়ে এসে হাজির হয়েছ, যখন কিনা একজন সহকর্মীর প্রয়োজন খুব বোধ করছিলাম জলদি ভেবে তোমার ডিসিশন জানাও, ওকে?" 
এরপর আর -বিষয়ে কথা হল না আমাদের মধ্যে বরং আরও দু'একজনের সঙ্গে আলাপ করলাম আমরা অধিবেশনের পরবর্তী পর্যায় শুরু হওয়ার আগেই আমি সৌমেনকে হোয়াটসঅ্যাপ মারফত জানিয়ে দিলাম, রাতে দেখা হচ্ছে না জরুরি কাজে অন্য একজন বিজ্ঞানীর সাথে থেকে যাচ্ছি

সৌমেন উত্তর
দিল, ওরা অফিসের কাজে পারাদীপ যাচ্ছে। 

||৪||
আজ সেই আশ্চর্য রাত। যা ঘটতে চলেছে, তার কথা নিজের চোখে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে কিনা জানি না এমন উদ্ভট এবং খাপছাড়া একটা ঘটনা এর আগে কল্পবিজ্ঞানের গল্পে কিংবা থিওরেটিক্যাল ফিজ়িক্সের কোনও বইয়েও পড়িনি কখনও
হোটেলে পাশাপাশি রুম নিয়েছি আমরা আপাতত আমার রুমেই একসঙ্গে বসে নৈশভোজ সারছি আমি আর ডঃ অগ্নীশ দত্ত আমার চোখে চোখ রেখে বললেন বরিষ্ঠ বিজ্ঞানী, "মানুষের যাবতীয় কমিউনিকেশন স্কিল কিন্তু শক্তির রূপান্তর আর অনুলিখনের সঙ্গে জড়িত মাল্টিমিডিয়া সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকলে জানবে, কীভাবে চলমান ছবিগুলো এনকোডেড ডিজিটাল ডেটার মাধ্যমে দ্রুত গতিতে ধেয়ে যায়ফিল্ড আর ফ্রেম স্ক্যানিংডিজিটাল ভিডিওর গল্প... যা কিনা ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্ট্রিমিং করা হয়ে থাকে
"আলো আর শব্দশক্তির এই দুই অবস্থাকেই তো নকল করে টেলিনির্মাণ করা যায়," আমি বললাম, "মানে অন্য কোনও দূরবর্তী জায়গায় লাইভ টেলিকাস্টিং..." 
—"-সব নিয়ে কাজ তো অনেকটাই এগোচ্ছেইন্টারনেট স্পিডও বাড়ছে দিনকে দিন কিন্তু আমি যা নিয়ে কাজ করছি, সেটা একদম আলাদা
—"কীরকম, স্যার?" 
—"এমএমএস, এক্সএমপিপি এইসব শুনেছ তোমরা ইন্টারনেট ইঞ্জিনিয়ারিং টাস্ক ফোর্সের স্ট্যান্ডার্ড মেনে তথ্য চালাচালির সাতকাহন। আমি আবিষ্কার করেছি নতুন একটা প্রযুক্তি, যার নাম হল 'টিএমএস'রক্তমাংসের শরীরকে সূক্ষ্মতম কণায় বদলে ফেলে স্থান পরিবর্তন করানো সম্ভব, এমনকী তার সংস্পর্শে থাকা কিছু জড়বস্তুকেও... সবচেয়ে কঠিন অ্যালগরিদম হল গিয়ে তাকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা, বিশেষ করে যখন সে অলরেডি অন্য কোনও জিওগ্রাফিক লোকেশনে পৌঁছে গেছে, উইদিন আ মিলিসেকেন্ড! নিয়ার রিয়েল টাইম টেলিপোর্টেশন প্রোটোকল..."
—"এই টেকনোলজির প্রায় কিছুই মাথায় ঢুকল না স্যার," আমি অকপটে স্বীকার করলাম, "একেবারে ব্রহ্মতালু ঘেঁষে ট্যান চলে গেল মাইরি।"
ডঃ অগ্নীশ দত্ত খুব হালকা হাসির উষ্ণতা ছড়িয়ে বললেন, "শরীর আর আলোর লীলাখেলা তোমার অত শত বুঝে কাজ নেই যে-জন্য তোমাকে ডেকেছি, সেটা বরং মন দিয়ে শোনো"
—"তার আগে আবিষ্কারের মূল বিষয়টা একটু সহজ করে বলা যায় না?"
—"বেশ, তাহলে মোদ্দা কথাটা শোনো আমি আপাতত একশো থেকে দেড়শো কিলোমিটারের মধ্যে স্থান বদল করতে পারি নিমেষের ভেতর তবে হ্যাঁ, অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় বই-কী" আমি কথাটা শুনে রীতিমতো অবাক হয়ে গেলাম তাহলে কি যে-কোনও বস্তুর আকৃতিকেই ফোটন-কণায় বদলে ফেলার পদ্ধতি উদ্ভাবন করলেন ডঃ অগ্নীশ দত্ত?
একটানা কথা বলে যাচ্ছিলেন তিনি, "একার পক্ষে সমস্ত প্রক্রিয়া পরিচালন করা বেশ ঝুঁকির কাজতাছাড়া, সমস্ত ব্যাগ-ব্যাগেজ টেলিপোর্ট করা বিশাল হাঙ্গামা শরীরের সঙ্গে ক্লোজ কন্টাক্টে আনার আগে জিনিসপত্রগুলোকে একটু অ্যাক্টিভেট করে নিতে হয়সব মিলিয়ে গোটা কর্মটা একজনের পক্ষে সামাল দেওয়া কষ্টকর" এ-পর্যন্ত বলে আমার দিকে আশাবাদী দৃষ্টি ছুড়ে দিলেন, তারপর খুব আস্তে আস্তে এই প্রথম আমার নাম উচ্চারণ করে বললেন, "তোমার সাহায্য চাই, কণাদ বাইরের লোকজনের কাছে ভূতুড়ে কাণ্ড বলে ভয় পাওয়াটাও ম্যানেজ করা দরকারএখনই চারদিকে হল্লাবোল ফেলে দেওয়া রীতিমতো মূর্খের মতো কাজ হয়ে যাবে"
এই পর্যন্ত বক্তব্য রেখে অনেকটা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন আমাদের বিজ্ঞানীবাকি খাবার শেষ করে উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বললেন, "তুমি কি আমাকে একটু অ্যাসিস্ট করতে পারবে না? পুরোপুরি সফল হওয়ার পর তোমার সঙ্গে মিলেই না হয় দুনিয়ার সামনে সেই সাফল্য ভাগ করে নেব, কথা দিচ্ছি।"
আমি রুমসার্ভিসে একটা ফোন করতে-রতে বললাম, "ও কথা থাক স্যার তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের এমন এক উন্নত পরীক্ষার সাক্ষী থাকা আমার পক্ষে বিরল সৌভাগ্য।"
ঘণ্টা দু'য়েকের জন্য বিদায় চেয়ে নিয়ে নিজের রুমে ফিরে গেলেন আশ্চর্য বিজ্ঞানী একটুু টিভি চালিয়ে আন্তর্জাতিক খবরে মন রাখলাম

কথা মতো, রাত প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ রুমের দরজায় টোকা পড়ল আমার খুলতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি, রীতিমতো স্যুটেড-বুটেড হয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন ডঃ দত্ত 
"একটু গুছিয়ে নিলাম নিজেকে," বললেন তিনি, "তাহলে এবার চলে এসো আমার কামরায়
"আপনি কি চেক আউট করবেন নাকি?" জিজ্ঞেস করলাম 
উত্তর না দিয়ে তিনি কেবল সামান্য একটু হাসলেন রুমে ঢুকে দেখি, সবকিছু গোছগাছ করে ফেলেছেনএকটা বিরাট ব্যাগ খুলে কয়েকটা ধাতব রড বের করলেন বড় ব্যাগটার ভেতর চোখ পড়ল এক ঝলক রকমারি জিনিসপত্রে বোঝাই।
বাথরুমের দরজা খুলে জলভর্তি একটা বালতি একটু ফাঁকা দিকে টেনে ধরলেন তারপর ছোট ছোট দুটো পাউচ বের করে বালতির জলে ঢালতে লাগলেন একটা জেলির মতো তরল কিছুর সঙ্গে আরেকটা কোনও রাসায়নিক গুঁড়ো মিশিয়ে নিতেই ব্রোমিনের মতো বাদামি রং ফুটে উঠল চিকচিক করতে লাগল সেটা কয়েকটি ইস্পাতের ফোল্ডেবল রড বের করে নিয়ে পরস্পর জুড়ে একটা বড়সড় স্ট্রাকচার খাড়া করে নিলেন বাথরুমের ভেতরেই স্প্রে-গানের সাহায্যে বালতি থেকে রঙিন তরল টেনে নিয়ে-নিয়ে মালপত্রবাহী প্রমাণ-সাইজের ব্যাগটাকে অনেকক্ষণ ধরে স্প্রে করতে লাগলেন উড়ন্ত কণা-কণা এরোসল থেকে হালকা তিক্ত অথচ মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে লাগল হাওয়ায় চারদিকে ব্যাপ্ত হয়ে গেল মায়াবী ঘ্রাণ
বালতিটা টেনে এনে তার নির্দিষ্ট জমিতে ব্যাগ সমেত নিজের পজ়িশন ঠিক করলেন ডঃ দত্তরড-নির্মিত পিরামিডাল খাঁচার মধ্যে দাঁড়িয়ে কিছু একটা সেট করে নিলেন এক মুহূর্ত তারপর ট্যাবের জিপিএস খুললেন, সম্ভবত দিকনির্দেশ ঠিক করার জন্য গায়ের চামড়া সঙ্গে সেঁটে ট্যাবটাকে বসিয়ে নিলেন জ্যাকেটের ভেতর দিকে একটা পকেটের খাঁজে
এবার একটা কিটের ভেতর থেকে বের করে আনলেন একখানা ডিসপোজ়েবল সিরিঞ্জ, এবং তরল পদার্থটা টেনে ভরে নিলেন তাতে তারপর সেই সিরিঞ্জটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের জামার আস্তিন গুটিয়ে নিতে লাগলেন আমাকে অনুরোধ জানালেন, ওঁর ডান কব্জির রেডিয়াল শিরায় বাদামি তরলটা ইনজেক্ট করার জন্য 
অজান্তেই একটা হালকা বিদ্যুৎ খেলে গেল আমার শরীরে আসলে ছোটবেলা থেকেই ইনজেকশনের ব্যাপারে আমার এক ভয়মেশানো স্পর্শকাতরতা কাজ করেবন্ধুকে টিটেনাস দেওয়া নিয়ে পুরনো দিনের অপ্রীতিকর একটি স্মৃতি হানা দিতে লাগল মাথার মধ্যে
"কী অত ভাবছ?" ডঃ দত্ত বেশ জোরালো গলায় আদেশ করে উঠলেন, "হারি আপ হাতে সময় খুব কম" বলেই লাগেজ-ব্যাগটাকে শক্ত করে দু'পায়ের ফাঁকে চেপে ধরলেনপকেট থেকে নিজের ফোন নম্বর ছাড়াও আরও কিছু যোগাযোগের নম্বর লেখা একটা প্রিন্টেড লিস্ট বের করে হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, "আজ ফাইনাল ট্রায়ালঘাবড়ে যেয়ো না ভাই..."
 যন্ত্রচালিতের মতো, কাঁপা-কাঁপা হাতেই আমি সিরিঞ্জের সুচ ফুটিয়ে দিলাম ভদ্রলোকের ফুলে ওঠা সবুজ রক্তবাহিকায় সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের তাঁর গোটা শরীরে হালকা ঝাঁকুনি খেলে গেল পরমুহূর্তেই মনে হল যেন ঢেউ বয়ে যাচ্ছে... অদ্ভুত এক আলোর আভা বেরিয়ে আসতে লাগল ওই দেহ থেকে ফিনফিনে পাতলা পলিথিনের ভেতর যেমন স্পষ্ট সবকিছু দেখা যায়, ঠিক তেমনি তার অবস্থা তখনচামড়া স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে ফলে ভেতরের অঙ্গতন্ত্রগুলো চোখের সামনে ফুটে উঠেছে পাঁজরের মধ্যে দুটো ফুসফুস বিকটভাবে দৃশ্যমান, আর পেটজোড়া ইনটেসটিন্স... ফুসফুসের খাঁজে তালে-তালে ছোট্ট থলির মতো যে-অঙ্গটা ধকধক করছে, সেটাই যে হার্ট, তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না একদম খুব দ্রুত শরীরের ভেতরকার এই দৃশ্য আবছা হয়ে গিয়ে জমাটবাঁধা আলোর জ্যোতিতে রূপান্তরিত হল ঠিক তার আগের মুহূর্তে ভারী গলার ক্ষীণ আওয়াজ যান্ত্রিক প্রতিধ্বনি তুলল খুব হালকাভাবে, "এদিকটা সামলে রেখো খানিক ঘুরে আসছি, চণ্ডীখোল..." 
ডঃ অগ্নীশ দত্তর সমস্ত শরীর থ্রিডি ইমেজে পরিণত হয়ে আস্তে-আস্তে মুছে যাচ্ছিল আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই কীভাবে যেন আলোর ছবিটা ছোট হতে লাগল এবং অবশিষ্ট ঝলকানিগুলো একসময় দপ করে পুরোপুরি ভ্যানিশ হয়ে গেল। 

ঘটনাটা ঘটতে বড় জোর মিনিট দশেক লেগেছে আমি ছুটে গিয়ে তেপায়ার ফাঁকে ঝুঁকি মেরে দেখলাম, হাওয়ায় মিলেমিশে একদম হারিয়ে গেছেন তিনি যেন কোনও প্রাচীন জাদুকর!... একটা রডে আমার হাত ঠেকে গেল একবার এবং এক ঝটকায় একটা হালকা বৈদ্যুতিক শক খেয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলাম বাথরুম থেকে




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বনিক

  উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বণিক উৎসবের আর মাত্র কয়েকটা দিন, একদম হাতে গোনা।  আর উৎসব  সংখ্যা ছাড়া উৎ...