'ক্রোধ ও কান্নার পর স্নান সেরে' :
সত্তরের
শম্ভু রক্ষিত সেই বিরল ব্যতিক্রমীদের অন্যতম যাঁর জীবন এবং কবিতা অচ্ছেদ্য সম্পর্কে
আবদ্ধ। পরিকল্পনাহীন এক জীবন- উদযাপন আর ভয়াবহ দারিদ্রকে অতিক্রম করে উঠে আসে তাঁর
কবিতার স্বর --- যা তাঁর জীবনযাপনের মতোই এলোমেলো এবং প্রক্ষিপ্ত --- অন্তত দৃশ্যত।
তাঁর প্রথম বই 'সময়ের কাছে কেন আমি বা কেন মানুষ'- এই তিনি তাঁর আত্মপরিচয় বিধৃত করে
দিয়েছিলেন নিজস্ব আদলে :
"
রবি ঠাকুর বা নজরুল নই আমি, আমি শম্ভু রক্ষিত ; এবং যেহেতু ভিরমি খাওয়া পথের ওপর সমস্ত
ধুলো-ময়লা পরিষ্কার করার জন্য আমার গা শিউরে শিউরে উঠছে , খারাপভাবে জড়ো করা নানান
বিস্ফোরক দিয়ে তৈরি হয়েছে আমার দেহাভিমান এবং সমস্ত বারণ অমান্য করে আমি আমার আত্মার
কাছে যেতে চাইছি। "
লেখক কবি সুদীপ্ত মাজি |
লিখতে আসার প্রথম প্রহরে আমরা তখন সুযোগ পেলেই অগ্রজ
কবিদের বাড়ি দৌড়ে যেতাম। বিশেষ করে নিজের জেলায় বসবাসকারী কবিদের বাসায়! দু'দণ্ড আলাপ
করে কবিতার বহির্জগত সম্বন্ধে নানাবিধ তথ্যের যথেচ্ছ কাঁচামাল সংগ্রহ করে ফিরে আসতাম
নিজের ডেরায়, কখনও বা বন্ধুমহলে! কবিতাকে ঘিরে দিনরাত্রি উদযাপনের সে সব আশ্চর্য মায়াপ্রহর
সত্যিই বড় অনাবিল ছিল! শম্ভুদা তখন থাকতেন হাওড়ার কদমতলা সংলগ্ন ক্ষীরেরতলা অঞ্চলের
ঠাকুরদাস দত্ত লেনে, তাঁর মামার বাড়িতে! একবার হাওড়ার সেই বাড়িতে শম্ভুদার খোঁজ করতে
গিয়ে এক বাজখাঁই কন্ঠস্বরের মহিলার তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেঁচেছিলাম! বহুদিন পরে শম্ভুদার
সঙ্গে দেখা হতে ওঁকে বলেওছিলাম, সেকথা! কেন যে তাড়া করেছিলেন ভদ্রমহিলা, আজও সে রহস্য
শম্ভুদার জীবনপ্রণালী ও রচনারহস্যের মতো অনুদ্ঘাটিতই থেকে গেল! প্রসঙ্গত আরও দুয়েকটা
ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে! তাঁর কবিতার কাছে পৌঁছোনোর আগে সেগুলিও ব্যক্ত করে ফেলি!
তরুণ বয়সে
একবার হলদিয়ায় কোনও একটি কবিতার অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম সেবার! সন্ধে ডিঙিয়ে রাত এলো,
কবিতাপাঠের বিরতিতে নৈশভোজ হল! তবু, কবিতার অনর্গল ধারা তো সহজে থামার নয়! শ্রোতারা
অনেকেই কবিতার অবিশ্রাম প্রবাহে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন! ইতিউতি তাকাচ্ছি, আর মাঝেমধ্যে
সিগারেটে টান দিতে লম্বা চালাঘরের বাইরের উঠোনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছি। বাইরে নক্ষত্রখচিত
আকাশ ঝলমল করছে! বেশ কিছুক্ষণ পরে কবিতার পাহাড় টপকে একটু ঘুমের খোঁজে মেঝেয় বিছিয়ে
রাখা বিছানায় শুয়েছি! সাত-পাঁচ ভাবনার মধ্য দিয়ে তন্দ্রাদেবী তখন সবে চোখে এসে বসেছেন,
হঠাৎ খুটখাট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল! উঠে দেখি, শম্ভুদা তাঁর শতচ্ছিন্ন ঝুলি থেকে সমস্ত
পোশাক একবার বের করছেন, তো পরক্ষণেই ঢুকিয়ে রাখছেন সবকিছু! এরকম বারকয়েক চলার পর অস্থির
হয়ে থাকা শম্ভুদার কাছে উঠে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম -- কী ব্যাপার! মধ্যরাতে এরকম তন্নতন্ন
করে কী খুঁজে চলেছেন আপনি! একগাল হেসে, চোখ টিপে শম্ভুদা বললেন -- সকালে সম্বর্ধনা
দেবে না ওরা? কোন্ পাঞ্জাবিটা পরা যায়, সেটাই খুঁজে রাখছিলুম! শম্ভুদার সঙ্গে আসা তাঁর
বালিকা কন্যা তখন বাইরের জ্যোৎস্নায় একা একা এক্কাদোক্কা খেলে বেড়াচ্ছে!
আর একটি
গল্প বলে ব্যক্তি শম্ভু রক্ষিতের প্রসঙ্গ থেকে তাঁর কবিতাকৃতির দিকে যাব। এটি আজ থেকে
বছর কুড়ি আগে 'রক্তমাংস' পত্রিকার একটি সংখ্যায় কবি প্রমোদ বসুর লেখা ব্যক্তিগত গদ্য
থেকে পাওয়া। সত্তরেরই আরেক বিশিষ্ট কবি সুব্রত রুদ্রের বাড়িতে তখন মাঝেমধ্যেই কবিসভার
আয়োজন হত। এক বর্ষাপীড়িত সন্ধ্যায় এরকমই একটি ঘরোয়া কবিসম্মেলনে সুব্রতদা ডেকেছেন সমসময়ের
বেশ কয়েকজন সতীর্থকে! সৌখিন মানুষ সুব্রতদা! ধবধবে,সাদা ফরাস পেতেছেন মেঝেতে। সাদা
ফরাসের ওপর সাদারঙের তাকিয়া। বাইরের কর্দমাক্ত রাস্তাঘাট পেরিয়ে এসে কবিরা হাত-পা ভালো
করে ধুয়েমুছে এসে বসছেন ফরাসে! কিছুক্ষণ পর হঠাৎ দেখা গেল হন্তদন্ত হয়ে এসে ঢুকলেন
কবি শম্ভু রক্ষিত! খালি পায়ে, ব্যস্তসমস্ত হয়ে! ঢুকেই, নির্বিকারচিত্তে উঠে এসে বসলেন
ধবধবে সাদা ফরাসের এক প্রান্তে! তারপর, যত্ন করে ফরাসের একটি প্রান্ত ধরে অবলীলায় মুছে
ফেললেন তাঁর কাদায় কালো হয়ে থাকা পা-দুখানি! যেন অস্বাভাবিক কিছুই ঘটেনি -- এমন চোখমুখ
নিয়ে তারপর নিবিষ্টচিত্তে শুনতে লাগলেন কবিদের মনোগ্রাহী কবিতাপাঠ!
কবি শম্ভু
রক্ষিত ছিলেন এরকমই একজন কবি-ব্যক্তিত্ব --- আমাদের কবিতাসভ্যতার সাজানো গোছানো বায়োস্ফিয়ারে
যিনি ছিলেন একজন নিপাতনে সিদ্ধ সন্ধির মতো, অতুলন। প্রচলিত অভ্যাসের চিরাচরিত বহমানতার
মাঝখানে আশ্চর্য এক অনিয়মের প্রতিভূ হয়ে জাগিয়ে রাখতেন তাঁর চলাচল!
আমরা লক্ষ
করেছি, অদ্ভুত এক পরাবাস্তবতার আলো ছড়িয়ে থাকে শম্ভু রক্ষিতের কবিতায়। অজস্র দৃশ্যকল্পের
একত্র সমীকরণে শম্ভু তাঁর শব্দবিশ্বে একটু একটু করে ছড়িয়ে যেতে থাকেন তাঁর উচ্চারণ।
আপাত-অসংলগ্নতার আড়াল থেকে উঁকি মারে তাঁর চৈতন্য ও অবচেতনের কাছ থেকে কুড়িয়ে পাওয়া
বোধের অভিজ্ঞান:
"
ক্রমশ সেই মুহূর্ত, ধনুক আর তূণ, রামধনুর ফোয়ারার মত শেষ তুষারস্তর সৌরপৃষ্ঠের বর্ণছত্র
যেন অতিক্রম করে গহ্বর অতল, তোমার অধুনালুপ্ত স্পর্শ অরণ্যের মত পড়ে থাকা রূপান্তর
প্রশান্তির গভীরে, অন্তর্নিহিত হয়ে বিশ্লেষিত উদ্ভাবনার ঊর্ধ্বে, অন্ত্য অনাবৃষ্টির
যুগের এই তন্ময়তা, জীর্ণপাতা পরীক্ষা, কৌতূহল চরিতার্থ করে যাও। "
( ১০৬ সংখ্যক কবিতা, প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না)
পাঠকপ্রিয়তার
বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর স্বর সম্পর্কে কবিতার রসিকজনের কয়েকটি মতামত আমরা দেখে
নিতে পারি প্রসঙ্গত :
১.
" কবির কাছে যে কোনো উপলব্ধি এবং পরিত্যক্ত কৌতূহল সারাজীবনই তাঁকে ছুটিয়ে নিয়ে
বেড়ায়, অভিকর্ষের আকর্ষণে কবি ছুটে যেতে পারেন মায়াসন্ধ্যার ছায়া বুকে নিয়ে।
"
[ গৌরশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় ]
২.
" সেই মহাপৃথিবীর আংশিক মহাকাশ দেখতে পেয়েছি। শ্রুতি পেয়েছে আংশিক অশ্রুত সুর।
যেহেতু এক অতৃপ্ত অনিশ্চিত আলো আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, এই ষাটোর্ধ্বে, কখনো কখনো
তাই 'প্রিয় ধ্বনির জন্য কান্না'র মধ্যে ঢুকে পড়ি।... পূর্বসূরী বা সমসময়ের স্রোতের
অস্বীকারে বাংলা কবিতায় সম্ভবত উত্থান হলো এক অবিমিশ্র মৌলিক গদ্যছন্দের বা এক কণ্ঠস্বরের।
"
[ অশোক দত্ত চৌধুরী ]
৩.
" আমরা বারবার লক্ষ করছি শম্ভু রক্ষিতের কবিতায় নতুনতর শব্দের অনিবার্য প্রয়োগ
; হৃদয়ের বহর, অনঘ মোহিনী কিংবা কান্নার প্রসূন ফলানোর শরাঘাত --- লোক দেখানো দ্রোহ
নয়, অন্তরের অমোঘ নির্দেশে মহাপৃথিবীর রহস্যময় ভাষায় শম্ভু নির্মাণ করেন পংক্তি সমগ্র।
"
[ বুদ্ধদেব বন্দ্যোপাধ্যায় ]
শম্ভু রক্ষিতের
কবিতার সাধনা তাই এক ধরণের দুরূহতার সাধনা --- আমাদের মনে হতে থাকে। নির্জন এককের পথে
চলা শম্ভু কখনও কখনও একটু সহজ হয়ে আসেন, দেখা-না-দেখায় মেশা তাঁর কবিতার অভিজ্ঞানকে
পাঠকের সংলগ্ন করে তোলার সাময়িক ইচ্ছাধীনতায়, যদিও তাঁর নিজস্ব ভাষাসরণির স্থাপত্য
তাতেও অক্ষুণ্ণ থাকে, অনিবার্যভাবে :
"
আমার স্ত্রী পুষ্টিকর দ্রব্যে সমৃদ্ধ যেন এক উদ্ভিদাণু
আমার শূন্যগর্ভ
উক্তিতে সুমুদ্রিত মোমের ছাপ
তার কণ্ঠস্বর অতিগম্ভীর, ঈষৎ কর্কশ
তার মুখের ডৌলটা নিরেট, রঙটা অর্থময় সাদা
আমার স্ত্রীর অপ্রত্যাশিত সব উদ্যোগ, উদ্বেগ
আর তার
অপরূপ ভাগ্য
তার শোলার
জুতো, কাঁচা রেশমের দস্তানা
তার ছত্রিশ
ব্লাউজ ধীরে শান্তভাবে
মাঝে মাঝে
বিরতি দিয়ে কথা বলে
আমি তাকে
কি আর প্রেমিকার মত ব্যবহার করতে পারি! "
( আমার স্ত্রী, আমার বংশধররা)
অনুসন্ধানী
এক কবিতাখননকর্মী শম্ভু রক্ষিত। অদৃশ্য এক মূলমধ্যরেখা দিয়ে সংযুক্ত হয়ে আছে তাঁর ব্যক্তিজীবন
আর কবিতার মহাকাশ। মহাপৃথিবীর নানা অস্থির তরঙ্গ ও রঙের পরিমাপক তিনি নিজস্ব প্যারামিটারে
নির্মাণ করে নিয়েছিলেন! নির্জন ও একক সেই অভিযাত্রায় তিনি শুধু দায়বদ্ধ থাকতে চেয়েছিলেন
সেই অন্তর্গত আলোড়ন ও নিঃশব্দ অন্তর্ঘাতের প্রতিই! কোত্থাও কোনোরকম কৈফিয়ত দেওয়ার সামাজিক
দায়কে অঙ্গীকার না করেই! প্রকৃত অর্থে শুধু সত্তর দশক নয়, আবহমান বাংলা কবিতার পরিমণ্ডলেই
তিনি চিরদিনের অপ্রতিম, নিঃসঙ্গ, একা!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন