সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

ব্যক্তিগত গদ্য -- ঔপন্যাসিক ও গল্পকার মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য


                                                                                       ঘুম  



অ্যাদ্দিন যাকে "ডন কুইক্সোট" বলে জেনে এসেছে হালে শুনলাম "দোন কিহোতে" নাকি তার সঠিক উচ্চারণ। সেটা বড় কথা নয়, আসল কথা হলো  "দোন কিহোতে"- স্রষ্টা সার্ভেন্তিস  বলেছিলেন, ঘুম যিনি
লেখক মৃগাঙ্ক ভট্টাচার্য 

আবিস্কার করেছেন ঈশ্বর যেন তাঁকে আশীর্বাদ করেন। কারণ একমাত্র নিদ্রিত অবস্থাতেই রাজা ভিখারি, জ্ঞানী মূর্খ একই রকম সুখে নিমজ্জিত থাকে। আমার একার নয়, গোটা মানবজাতির পক্ষে ঘুম এক জরুরী জিনিস। উনিশ শতকের শেষে শিকাগোর হে মার্কেটে যে আন্দোলন হয়েছিল শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক শ্রমদিবস প্রতিষ্ঠার, যার পরিণতিতে আজকের এই মে দিবস- তার শর্তই  তো ছিল  ছিল আট  ঘণ্টা কাজআট ঘণ্টা ঘুম, আট ঘন্টা সংসারের অন্যান্য কাজ আর বিনোদন


নিদ্রিত  অতিথি ডানকান কে হত্যা করার পর ম্যাকবেথ দৈববাণী শুনতে পান- "তুমি আর কখনো ঘুমোতে পারবে না ম্যাকবেথ। তোমার নিজের ঘুমকে হত্যা করলে তুমি।এরপর ম্যাকবেথের  জীবন কেটেছে বিশ্রামহীন অবিরাম উদ্বেগ, অশান্তি অস্থিরতার মধ্যে।মৃত্যুই তাকে দিয়েছে চিরশান্তি। স্বীকারোক্তি আদায় করার জন্য এখনও বহু ক্ষেত্রেই অপরাধীকে চোখের পাতা এক করতে দেওয়া হয় না। কারণ খিদে সহ্য করেও বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু না ঘুমিয়েভয়াবহ সে যাপন। বঙ্কিমচন্দ্র রামকৃষ্ণকে বলেছিলেন, জীবনের উদ্দেশ্য  হল আহার নিদ্রা আর মৈথুন। লক্ষণীয় যে নিদ্রাকে তিনি দ্বিতীয় স্থানে রেখেছিলেন। প্রাণের কাছে ঘুমের স্থান সবার আগে। না খেয়েও কিছুদিন বেঁচে থাকতে পারে মানুষ। মৈথুন তো জীবনে মধ্যপর্ব পর্যন্ত সীমিত। শৈশবের যেমন নেই, বার্ধক্যেও তেমন নেই। কিন্তু ঘুম জন্ম নেবার পর মুহূর্তে থেকে অন্তিম শয্যা পর্যন্ত তার প্রয়োজন। নিদ্রার সঙ্গে আমাদের জীবনের গোটাটাই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা

রাতের শয্যায় ঘুমের আঠা  যাদের চোখে জড়ায় সহজেই, তাদের ঘুম নিয়ে মাথাব্যাথা নেই। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয়  যামেও যাদের ঘুম আসে না তারাই বোঝে ঘুমের মর্ম। শুধু মানুষ কেন, অন্যান্য পশুপাখীদের এমনকী গাছপালাদের  জন্যও কি ঘুম জরুরী নয়? কুকুরবিড়াল গরু ছাগল ছাড়া অন্য প্রাণীরা কীভাবে ঘুমোয় তা জানার সুযোগ ঘটেনি কখনও। ঘোড়া নাকি দাঁড়িয়ে ঘুমোয়।চিড়িয়াখানার লোকেরা সেটা ভালো বলতে পারবেন।,ছেলেবেলায় পড়েছিলাম সম্রাট নেপোলিয়ন ঘোড়ার পিঠে ঘুমোতেন। ঘোড়া বা  নেপোলিয়ান, কারো ঘুম দেখারই সৌভাগ্য হয়নি আমার। তবে মনের মধ্যে একটা খটকা ঘুরপাক খায়, নেপোলিয়নের ঘোড়াটা কি আদৌ কখনও ঘুমোবার সময় পেত?

হিন্দু পুরাণে ঘুমের কোন দেবতা নেই। "সম্নোস" নামে গ্রিক দেবতা আছেন ঘুমের। স্বচক্ষে না দেখলেও সিনেমায় দেখেছি ঘুমের মধ্যে দিব্যি হাঁটাচলা করেন অনেকে। এই ব্যাপারটাকে বলে somnambulism, যা এসেছে সম্নোসের নামের থেকে। যেটা বলছিলাম, সেই গ্রিক দেবতার আশির্বাদ আমি ছোটবেলা থেকেই পেয়েছিলাম। আমার ছিল 'সাধা ঘুম' প্রেমিকার মানভঞ্জন করার মতো সাধ্যসাধনা করতে হতো না, নিদ্রা দেবী এমনি এসে ধরা দিতেন চোখে। বিছানায় বডি ফেলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুরো ফ্ল্যাট, যাকে বলে জগৎ অন্ধকার। একটা সাদা- বেডকভার পাতা টানটান সুন্দর বিছানা আর রোদে দেওয়া গরম বালিশ। শুধু এইটুকু ভাবলেই আমার হাই উঠতে শুরু করে।  তবে ঘোড়ার মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমাবার স্বপ্ন আমি কখনও দেখিনি। বাসে ট্রামে সফর করতে গিয়ে এক ধরনের লোককে দেখা যায় তারা  সেটাও অক্লেশ  পারে। তাদের খুরে  আমার শত কোটি প্রণাম

জলপাইগুড়ি থেকে মালবাজার রুটে ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছি একটা সময়। তখন বেশ কিছু নিত্যযাত্রীকে দেখেছি একবার বসার সিট পেয়ে গেলে চোখের পাতা দোকানের শাটারের মতো নামিয়ে আনত মসৃণভাবে। এবং অবশ্যম্ভাবী যেটা, এর পর সহযাত্রীর কাঁধে তাদের মাথা ঢুলে পড়ত। এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু পেতাম না। কিন্তু অবাক হতাম এর পরের ঘটনা দেখে। পথে কোনও দেবস্থান এসে গেল তো ঘুমের মধ্যেই একটু ঝুঁকে হাতজোড় করে প্রণাম সেরে নিতেন এক ভদ্রলোক। পথে যত মন্দির­-মসজিদ পড়ত কোনওটাই বাদ দিতেন না। তাঁর অচলা ভক্তির প্রাবল্যের সঙ্গে অসম যুদ্ধে ঘুম বেচারি এঁটে উঠতে পারত না কখনও।

 ঘুমের ভেতর পাওয়া সবচেয়ে গভীর আনন্দদায়ক ও অলৌকিক সুখের স্বাদের কথা বলেছেন আমাদের ঋষিরা।  ঘুমের ভিতর সুষুপ্তির মুহূর্তটাই সবচেয়ে সুখ ও সুন্দর মুহূর্ত । ওটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু সুষুপ্তি যখন ঘটে তখন তার চেতনায়  ব্রহ্মোপলদ্ধির আনন্দ আনে। ওই বিশেষ মুহূর্তে চেতনায় কোন চিন্তা, স্বপ্ন বা স্মৃতি থাকে না। মায়াসক্তি বা আকাঙ্খা  থাকে না। থাকে শুধু চেতনার বিশুদ্ধরূপ আর আনন্দের অনুভব। যার যত দীর্ঘস্থায়ী হয় ওই মুহূর্তে তার ঘুমও হয় ততটাই তৃপ্তিদায়ক। 

ঘুম হল আমাদের অচেতনের নিশ্চিন্দিপুর। আবছায়ার আঁতুড়ঘর। এমন নয় যে, দিনের অন্যসময় ঘুমানো যায় না। তবে রাতের  সঙ্গে ঘুমের রাজযোটক সম্পর্ক আছে। প্যাঁচা আর পেঁচো রাতে ঘুমায় না। একটা বয়সে আমরা অনেকেই পেঁচোর দলে ছিলাম। যৌবনের সব বাসরই তো রাতজাগা। এক সময় চুটিয়ে ক্রিকেট খেলেছি। টিমের সঙ্গে বাংলার বাইরে গেছি খেলতে। সে ছিল ইয়ারোস্তদের সঙ্গে এক অনন্ত হাহাহিহি, নির্ঘুম রাত কাটাবার সময়। বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী গেলে রাতজাগা ছিল মাস্ট। এখন ওসব টানতে গেলে চোখ টেনে আসে। 


বয়স বেড়েছে। মিছরির সরবতে না-মেশা মিছরি মতো জীবনপাত্রে থিতিয়ে গেছে যাবতীয় যোশ। উল্লাসের গ্রাফ নেমে এসেছে নিচে। এখন বুঝতে পারছি যে, চোখের দৃষ্টি বা কানের শ্রুতির মতোই একটা বয়সের পর ঘুমও কমে আসে। সেই বয়সে পৌঁছে মানুষ হাড়ে হাড়ে বোঝে, যে ঘুমোতে পারে না ভাল, সে বহু কিছু জীবনে পেয়েও তুমুল অসুখী।  আর যে সবসময় ভালো ঘুম ঘুমোয়, ঘুম থেকে উঠে ফেলে আসা দিন নিয়ে ভাবে না তেমন,  সে-ই সবথেকে তৃপ্ত মানুষ।





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বনিক

  উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বণিক উৎসবের আর মাত্র কয়েকটা দিন, একদম হাতে গোনা।  আর উৎসব  সংখ্যা ছাড়া উৎ...