সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

কবি দুর্জয় দাসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ লন্ঠনগ্রাম ।পাঠ প্রতিক্রিয়ায় কবি সত্যম ভট্টাচার্য



সাম্প্রতিক ভালোলাগা কবিতার বই


সত্যম ভট্টাচার্য

উদাসী এক যুবক শহরের পথ ধরে আনমনে হেঁটে যান,তার দৃষ্টি স্থির।খুব একটা আপাতভাবে তাকে এদিক ওদিক ঘাড় ঘোরাতে দেখা যায় না।চোখ কিন্তু ঘোরে তার অনবরত।কাঁধে একখানা কালো ব্যাগ  ঝোলে ।কোনদিন তিনি ঘরে ফেরেন,কোনদিন  ফেরেন না।সংসারী হয়েও আপাত উদাসীন নির্লিপ্ত এই যুবক,একই ছন্দে হাঁটতে থাকেন শহরের রাস্তায়।তিনিই কবি দুর্জয় দাস।
কবি সত্যম ভট্টাচার্য

এখন বাংলা কবিতার কাগজ থেকে কবি দুর্জয় দাসের সাম্প্রতিক প্রকাশিত হওয়া কাব্যগ্রন্থ লন্ঠনগ্রাম পড়লাম।সঙ্গীতের ক্ষেত্রে যেমন কেউ বিশারদ হলেই তার গান শুনতে ভালো লাগে না ,ঠিক তেমনই কবিতার ক্ষেত্রেও।ব্যাকরণ জানলেই যে কেউ মুগ্ধ করার মতো লিখতে পারবেন এমনটা নয়।ব্যাকরণটা জানা হয়তো দরকার,কিন্তু তার সাথে ভালো লিখতে পারার সম্পর্কটা আপেক্ষিক।আবার কখোনো এমনও হয় যে কারুর লেখা পড়ে কোন কবির খুব ভালো লেগে গেলে তিনি যখন নিজে লিখতে বসেন কবিতাটা অনেকটাই প্রথমজনের মতো হয়ে যায়,অনেক শব্দ বা লেখার ধরণ মিলে যায় হুবহু।কিন্তু কবি দুর্জয় দাস এই সমস্ত প্রভাব থেকে একেবারে মুক্ত।তাই শূন্য দশকের দ্বিতীয়ার্ধে লিখতে আসা এই কবি বরাবরই লিখে যান তার নিজের মতো করে।কারুর সামান্য প্রভাবও তার লেখায় দেখা যায় না।কবির থেকে জানতে ইচ্ছে করে কিভাবে তিনি সকল লেখকের এই অভিষ্ট লক্ষ্যে এত অনায়াসে পৌঁছলেন।


তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ লন্ঠনগ্রামের একদম প্রথম দিকের সংসার কবিতায় কবি লিখছেন-
হাঁড়িতে ভাত রাধছি
     চাল ফুটালে ভাত হয় জানি
     একটু একটু করে ভাত হতে থাকি

লক্ষ্য করুন পাঠক, সম্পূর্ণ স্বকীয় এখানে কবির উচ্চারণ।অতি সাধারণ কথা বলতে বলতে তৃতীয় লাইনে কবি তার কবিতাকে পৌঁছে দিয়েছেন এক অসাধারণ উচ্চতায়।এখানেই কবি দুর্জয় দাসের সার্থকতা।আবার রাতভোরের কবিতা, এই সিরিজের ১২ নম্বর কবিতায় কবি লিখছেন-

ছাই ফেলে হাতের গোপন বোঝে সিগারেট

প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন সৃষ্টি হচ্ছে এমন এক নতুন  অনুসঙ্গ যার সাথে আপনি হয়তো অদ্যাবধি অপরিচিত।

কবি দুর্জয় দাসকে প্রথম দেখেছিলাম জলপাইগুড়ির শ্যামলছায়াতে এখন বাংলা কবিতার কাগজের রবিবারের আড্ডাতে।সকল হৈ চৈ কোলাহলের মধ্যে থেকেও তিনি যেন সব কিছুর থেকে আলাদা।কখোনোই উচ্চ কন্ঠে তিনি কথা বলেন না নিজের বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি যে খুব একটা উদগ্রীব এমনটাও নয়।অথচ নিজের পরিমন্ডলে কবি কিন্তু যথেষ্টই আড্ডাবাজ। নিজের বক্তব্য বা বিশ্বাস সকলের সামনে জোর গলায় ব্যক্ত না করলেও কবিতায় তিনি কিন্তু যা বিশ্বাস করেন তাই করেন।কখোনোই সেখান থেকে তিনি সরে আসেন না।তাই তো এত বছর পার করেও তার কবিতা নিজের জায়গা থেকে একচুলও সরে নি। তার দিনবদল কবিতায় তিনি লিখতে পারেন এরকম পংক্তি-

যদিদং হৃদয়ং ক্ষণে কনসার্ট সাজিয়ে রাখছে ফুলরং
আলোআশা অন্তর্লীন মনখামে

এখানে দেখা যাচ্ছে যে কবি যা বলতে চাইছেন তা পাঠকের কাছে সম্পূর্ণ স্পষ্ট না হলেও পাঠক কিন্তু নিজের মতো করে একটা ছবি এঁকে নিচ্ছেন।হতে পারে সে ছবি পুরোপুরি স্পষ্ট নয়,খানিক ভাঙা ভাঙা।খানিক ধরা যায়,খানিকযায় না।আবার আকাশমণি কবিতায় কবি লিখেছেন-

রোদের পরিযায়ী সুইং করছে
       জলপথের সব তাকানো নিয়ে-

এখানে দেখা যাচ্ছে রোদ এবং সুইং এই শব্দদুটোর মাঝে পরিযায়ী শব্দটি বসে এক নতুন জায়গায় পাঠককে পৌঁছে দিচ্ছে।পরিচিত চির চেনা ছবি খানখান হয়ে ভেঙে পড়ে এক নতুন ছবির জন্ম দিচ্ছে,যা একদম অচেনা।  
বাজারের হাজারো প্রলোভন আর চমকদমকে যখন অধিকাংশ প্রতিভাবান কবি সেদিকে ঝুঁকে পড়ে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেন,কবি দুর্জয় দাস কিন্তু সেখানে অবিচল।আর তাই তো বাংলার এক নামী লিটল ম্যাগাজিন থেকে বিনামূল্যে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ডাককেও তিনি হেলায় সরিয়ে রাখতে পারেন।আবার এটাও বলা যায় যে কবিতার দুনিয়ায় এতবছর কাটানোর পরও দুর্জয় দাসকে কিন্তু খুব একটা বেশী কাগজে লিখতে দেখা যায় না।কারণ লেখা পাঠানোর চাইতে অনেক বেশী তিনি আগ্রহী কবিতায় নতুন পথ খুঁজতে।

নিষিদ্ধ কবিতা সিরিজের ১৫ নং কবিতায় কবি লিখছেন-

দুপুর পোহাচ্ছে আনমনে।কমলার গা বেয়ে রস বিষয়ক।কোয়া খুলে হলুদ গড়ালে ধরে নেবো।

আহা কি অসাধারণ বর্ণময় চিত্রিত অথচ খন্ডিত অনুভূতি।

৫৬ পাতার এই বইটিতে কবি দুর্জয় ৪২ পাতা অব্দি কবিতা লিখেছেন আধুনিক কবিতার ঢঙেই,পংক্তিতে।তারপর ৪৩ পাতা থেকে তার বাকি সব কবিতাগুলোই লেখা হয়েছে টানা অর্থাৎ কবি সেখানে লাইন ভাঙেন নি।কিন্তু লেখার প্রকরণ বা স্টাইলে বইএর পাতায় পাতায় নিজেকে উন্নীত করার ছাপ স্পষ্ট।তাই কবি দুর্জয় দাসের কাছে এই সামান্য পাঠকের অনুরোধ-আপনি নিজের ট্রাম লাইনেই হাঁটুন,বাংলা কবিতা একদিন ঠিক আপনাকে খুঁজে নেবে।     


লন্ঠনগ্রাম
দুর্জয় দাস
প্রকাশক-এখন বাংলা কবিতার কাগজ
বিনিময় আশি টাকা





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বনিক

  উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বণিক উৎসবের আর মাত্র কয়েকটা দিন, একদম হাতে গোনা।  আর উৎসব  সংখ্যা ছাড়া উৎ...