সদ্যপ্রয়াত দেবেশ রায় আমার কাছে ঈশ্বর। প্রত্যক্ষ পরিচয় ঘটে ওঠেনি কখনও, কেন, কে জানে! বিয়াত্রিচের সঙ্গে কি কখনও মুখোমুখি হতে পেরেছিলেন দান্তে ? না, তার প্রয়োজনই বা কী। তবু প্রেম অনন্ত নশ্বরতার দিগন্তে চিরউদ্ভাসিত হতে বাধা পায়নি। জড় সত্ত্বার কাছে প্রত্যক্ষ যে স্থির জাড্য রচনা করতে পারে অজড় সত্ত্বা তারচেয়ে অনেক তীব্রতায় বোধহয় গতির সূচনা করতে সক্ষম। সেকারণেই হয়তো স্রেফ বিশ্বাসের শক্তিতে ভক্তের অসীম উচ্চতায় দিব্য উড্ডয়ন। সেই ঈশ্বরের অবস্থান বিশ্বাসীর মনে, মস্তিষ্কে।
১৯৮০। তখন ঐতিহাসিক অসম আন্দোলনে উত্তাল পরিস্থিতি। আমি বলা চলে গাঁয়ের ছেলে। কোচবিহারের জেনকিন্স স্কুল থেকে মাধ্যমিক পেরিয়ে উচ্চমাধ্যমিকের পড়ুয়া। তখনও শহরের বাইরে কোথাও পদার্পণ ঘটেনি।
পরিচিতির খুবই সংকীর্ণ এক গন্ডির মধ্যেই সীমায়িত জীবনের পরিধি। আর যা কিছু সবই মানসভ্রমণ মাত্র। প্রিয় বন্ধুর দিদি শহরের সুনীতি অ্যাকাডেমির পড়ুয়া, আমারও দিদি। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে এনে আমাকে নিয়মিত নানা বই সরবরাহ করতো। সেই সূত্রে বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্কর, রমেশচন্দ্র দত্ত (মনে পড়ছে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের পালামৌ) থেকে শুরু করে অসংখ্য উপন্যাস, গল্প গোগ্রাসে গিলেছি সেই জেনকিন্সে ভর্তি হবার থেকেই। সেসব পড়া নিশ্চয়ই বয়সোচিত ছিল না। এমনকি, স্কুলের পড়ুয়া থাকাকালেই বিবর, প্রজাপতির মতো ‘নিষিদ্ধ’ বইও দিব্যি গিলেছি! আমার বাস্তবিকই কিছুই করার ছিল না বলে বইয়ে মুখ গুঁজে থাকতে বাধ্য হতাম। সমবয়সীরা যখন উদ্দাম উল্লাসে খেলাধুলোয় অনন্ত জীবনীশক্তি ঢেলে দিচ্ছে তখন লিকলিকে, দুর্বল শরীরে আমার পক্ষে সেই আনন্দযজ্ঞে সামিল হওয়া অসম্ভব ছিল। আর ছিল বিচিত্র শাসন ও তার প্রণালী! সেই শ্বাসরুদ্ধকর এক পরিস্থিতিতে বই আমাকে সমস্ত পুষ্টি জুগিয়েছিল। জীবনের সমস্ত রসদ সে দিয়ে গেছে অকৃপণ উদার হাতে। এই জীবনের জন্য বইয়ের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।
|
লেখক সমর দেব |
আমার এক দিদি সংস্কৃত কলেজে পড়তো। তারই সিলেবাসের বই, তার বজ্র আঁটুনি থেকে প্রায় অনায়াসে ‘চুরি’ করে পড়েছি কঠোপনিষদ, কেনোপিনষদ। মাধ্যমিকের অংক পরীক্ষার আগের রাতে পড়ছিলাম মার্চেন্ট অব ভেনিস। সুবিধে ছিল এই যে, সে বইয়ে মূল নাটকের সঙ্গে সঙ্গে ছিল তার ঝরঝরে অনুবাদ, সঙ্গে নোটস। পোর্সিয়ার পাত্র বাছাই প্রসঙ্গে তার বাবার কঠোর অবস্থানের জায়গাটায় এসে ভদ্রলোকের উদ্ধত বক্তব্য ছিল, আমার মেয়ে আমার সম্পত্তি, সে কাকে বিয়ে করবে সেটা স্থির করবো আমি। এই জায়গাটা পড়তে গিয়ে বিচিত্র লেগেছিল। মেয়ে তার বাপের সম্পত্তি! মনে আছে, জব্বর হোঁচট খেয়েছিলাম। আর, হঠাৎ করেই মেজদি এসে আমাকে ওই বই পড়তে দেখে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে তুলেছিল। তারপর গালে যেন এক বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়। জীবনে মার খেয়েছি অনেক, অসংখ্যবার। শুধু প্রহারের বিবরণ লিখলেই আস্ত একটা মহাভারত হয়ে যাবে নিশ্চিত। এগারো ভাইবোনের সকলের ছোট। প্রবল দারিদ্রে জেরবার। তো, কারণে অকারণে ভর্ৎসনা, চড়-থাপ্পড় নিত্যদিনের ঘটনা মাত্র। সেইসঙ্গে পিঠোপিঠি ভাইবোনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ঈর্ষাও হয়তো। টিকে থাকার কঠিন লড়াই। এই পরিণত বয়সে এসে সেই সব নির্যাতন, প্রহার, লাঞ্ছনা, ভর্ৎসনার প্রতি নিদারুণ ভালোবাসা অনুভব করি। হ্যানসেনের অসুখের রোগীর মতো, বেঁচে থাকার একমাত্র অনুভব ধরা দেয় গভীর যৌনতায়! তখন সূক্ষ্ম পেলব অনুভবগুলো বোধের সীমানায় ধরা দেয় না, দেয়নি। মানসিক নয়, স্থূল যৌনতার প্রকৃত আস্বাদ অস্তিত্বের অনুভবের মতো, বেঁচে থাকার মতো প্রত্যক্ষ প্রমাণে পর্যবসিত হতে পারে হ্যানসেনের অসুখে সম্পূর্ণ অসাড় হয়ে পড়া ক্ষয়াটে শরীরে। দারিদ্রও কি আরেক রকমের কুষ্ঠরোগ, যে রোগে অসাড় হয়ে পড়ে জীবনের সমস্ত মাধুর্য, প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ, দয়া-মায়া? এবং সেই জীবনহীন বেঁচে থাকায় সম্পূর্ণ লুপ্ত মানবিক বোধ, অনুভবগুলো নির্ঘুম রাতের মতো জেগে থাকে প্রহারে, নির্যাতনে, লাঞ্ছনায়, ভর্ৎসনায় এবং সুতীব্র অপমানে। তাহলে, অস্তিত্বকে চিনে নেবার প্রকৃষ্টতম উপায়ও তো সেই বেঁচে থাকাই! সেই বেঁচে থাকার কাছে বড় বেশি ঋণী হয়ে আছি। খুব কম মানুষের জীবনেই বোধহয় এমন সৌভাগ্য ঘটে থাকে। নইলে বইয়ের প্রতি আমার এমন হৃদয় নিংড়ানো প্রেম জন্মাতো না বোধহয়। জীবন সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো বইয়ের পাতায় পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধানের প্রয়োজনই হয়তো উঠে আসতো না। আর, সেই সূত্রে জীবনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অনন্ত এই জীবনকে উপলব্ধির সুযোগও আসতো না। অনন্ত জীবনের অমৃত হয়তো অধরাই থেকে যেতো। ‘যেনাহং নামৃতাস্যাম কিমহং তেন কুর্যাম’। জন্মসূত্রে প্রাপ্ত পরিস্থিতির কাছে আমি যারপরনাই কৃতজ্ঞ।
আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিতেও ছিল অজস্র বইয়ের সংগ্রহ। তবে সেখানে আমাদের পড়তে দেওয়া হতো স্রেফ ভূতের গল্প, দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ইত্যাদি। তাতে মন ভরার প্রশ্নই ছিলো না। পাড়ার ক্লাবে পেয়েছিলাম বিমল মিত্রের কড়ি দিয়ে কিনলাম, রক্তের বদলে স্বাধীনতার মতো অনেক বই। আর, ছিল দাদা-দিদিদের সিলেবাসের সমস্ত বই মায়, আইনের বইপত্রও! শুধু বাদ পড়েছে অংকের বইগুলো! ওসবে কখনও দাঁত ফোটাতে পারিনি। কিন্তু এতসব করেও নিত্যনতুন প্রশ্নের জবাব মিলছিলো না। মনে হচ্ছিলো যেন আমারও কিছু বলার আছে! কিন্তু কীই বা বলার আছে, আর বলার উপায়ই বা কী? তবু নিরন্তর পথ খুঁজে যাওয়া। সে যেন এক অনন্ত অভিযাত্রা, জানা ছিলো না গন্তব্য। সেই এক চরম অসহায়তা। তখনই কবিতা লেখার চেষ্টা। জেনকিন্সের ছাত্রজীবনে কিন্তু স্কুলের ম্যাগাজিনে কখনই আমার একটি লেখাও প্রকাশিত হয়নি। প্রতিবার ম্যাগাজিনের দায়িত্বপ্রাপ্ত স্যরের কাছে কখনও কবিতা, কখনও গল্প আবার কখনও দুটোই জমা দিলেও ম্যাগাজিন প্রকাশের পর প্রতিবারই হতাশ হয়েছি। সেসব লেখার বেশ কিছু স্রেফ মায়াবশতই ফেলেও দিতে পারিনি (বিস্ময়কর ঘটনা যে, স্কুল জীবন শেষ হবার অন্তত আট-দশ বছর পর সেসব লেখার অধিকাংশই একেবারে অসম্পাদিত অবস্থায়ই ভালো পত্রপত্রিকায় সসম্মানে প্রকাশিত হয়েছে! আমার কোনও কোনও সংকলনেও আছে সেসব লেখা। অবহেলিত, অবজ্ঞাত হলেও আত্মবিশ্বাস প্রবল ছিল বলেই সেসব লেখা ফেলে দেবার মতো ঔদার্য লাভ করতে পারিনি!)। কিন্তু তখনও গন্তব্যের কোনও হদিশ আমি পাইনি। সেজন্য নিজের অজান্তেই আরেকটু অপেক্ষা করতে হয়েছে।
একসময় স্কুলজীবন শেষ হয়েছে। তারপরই উদার বিশ্বের সিংহদুয়ার খুলে যায় আমার কাছে। উজান অসমের যোরহাটে আমার দাদা একটি কলেজে পড়ান তখন। আর, বউদি পড়ান মরিয়নি কলেজে। বাড়ির কনিষ্ঠতম সদস্যটিকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো এবং ভর্তি করে দেওয়া হলো মরিয়নি কলেজে। সেখানে অনেক বিচিত্র অভিজ্ঞতা ঘটেছে। অনেক অম্ল ও মধুর স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে সেই প্রবাস জীবনে। তবে, এখানে সেসব বলার প্রয়োজন নেই, অন্য কোনও সময় সেসব বলা যাবে। তো, কলেজে কয়েকদিন ক্লাস করতে করতেই শুরু হয়ে গেল বিদেশী বিতাড়ন আন্দোলন। সেও আমার সোভাগ্য। ঘরে হাজার হাজার বই, পত্রপত্রিকা! আন্দোলনের জেরে কলেজ বন্ধ। অতএব বাড়িতেই সারাদিন। আমাকে আর পায় কে। ততদিনে শৃঙ্খলও অনেকটাই টুটে গেছে। দুই হাতে বই ছানাছানি করি আর পড়ি। আগের সমস্ত পড়া ছিল এলোমেলো, যখন যেমন পাওয়া তেমনি। এখন একেবারে প্রণালীবদ্ধ পড়ার সুযোগ। আর তাতে পরোক্ষে প্ররোচনা ছিল স্বয়ং দাদার। নিজস্ব সংগ্রহে না থাকলেও চাইলেই পাওয়া যায় যে-কোনও বই। এরকম এক দিনেই আবিষ্কার করেছিলাম গড় শ্রীখণ্ড। আবিষ্কার করেছিলাম কমলকুমার মজুমদার! এখনও মনে আছে অন্তর্জলী যাত্রার লালচে মলাটের, আয়তনে বেশ ছোট চেহারাটা। পাওয়া গেল কৃত্তিবাস, পূর্বাশা, এক্ষণ পত্রিকার বহু সংখ্যা। আর, আকস্মিক আবিষ্কার হলো, তখনও আমার কাছে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত এক লেখক দেবেশ রায়। বইটা ছিল যযাতি। সবজে রঙের মলাটে একটি পুরুষের মুখ।
দ্রুত পড়ে শেষ করতে বেশি সময় লাগেনি। লেখার কায়দাটা আমাকে খুব আকর্ষণ করেছিল। একেকটি চরিত্র নিজের বক্তব্য পেশ করে চলেছে (হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও তখনও চার অধ্যায় পড়ে ফেলা হয়নি)। বিবরের কথা মনে ছিল, কিন্তু সেখানে একজনই সমগ্র কাহিনির কথক। যযাতি আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেললো। দিনের পর দিন মাথার ভেতরে ঘুরপাক খেতে লাগলো নায়কের সঙ্কট। কোথাও কি আত্মদর্শন ঘটে গিয়েছিল? কী জানি। সেই সময় অবধি কত উপন্যাস পড়ে ফেলেছি, অথচ ওরকম আলোড়িত হইনি। অসম আন্দোলনের মধ্যেই পরীক্ষা হলো। অসমের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবারে আমার ভাগ্য নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নিলো। বাড়িতে প্রশ্ন উঠলো আমার নিরাপত্তা নিয়ে। দাদা-বউদিও চিন্তিত আমাকে নিয়ে। ফলে, ব্যাক টু প্যাভিলিয়ন। যত সহজে বলা গেলো, এই গল্প মোটেই তেমন সিধেসাধা গল্প নয়। সেসব এখানে বলার প্রয়োজনও নেই। কিন্তু ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেও যযাতির ঘোর কাটাতে পারছিল না। পিতা-পুত্রের বিরোধ তার মনপ্রাণ জুড়ে ব্যাপক ও গভীর বিস্তার পেয়ে গেছে।
সময়টা ১৯৮১ সালের মে। একদিন জেদের বশেই মনে হলো, আমাকেও লিখতে হবে। তীব্র আবেগে এক সন্ধ্যায় বসে গেলাম কলম নিয়ে। আর, কী বিস্ময়কর ঘটনা যে কলম ভাবনার সঙ্গে সঙ্গত করতে পারছিল না। অসম্ভব দ্রুততায় ছুটছিল ভাবনা, আর কলম তারসঙ্গে তাল সামলাতে পারছিল না। ফলে, হাতের লেখা নিয়ে সমস্ত গর্ববোধ ধুলোয় মিশে গেলো। আড়শোলাকে কালিতে বসিয়ে সাদা পাতায় ছেড়ে দিলে সে হেঁটে যেতে যেতে রেখে যাবে তার পদচিহ্ন। বাস্তবে সেটাই ঘটলো। বিচিত্র অক্ষরে শব্দে পাতার পর পাতা গড়িয়ে যেতে থাকলো। কলমের কালি শেষ হতেই ছুঁড়ে দিলাম সেটা। টেনে নিলাম দ্বিতীয় কলম। রাত দশটা নাগাদ ডিনারের ডাক পেয়ে উঠতেই হলো। দ্রুত ডিনার শেষ করে ফের খাতার ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়া। কলম ছুটছে। ভাবনা ছুটছে তার দ্বিগুণ গতিতে। দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে সময়। গলা শুকিয়ে আসছে। উঠে একবার জল খেতে হলো। লেখা এগোচ্ছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মাঝে মাঝে কপাল থেকে ঘামের বিন্দু এসে ঝরে পড়ছে খাতার পাতায়। কব্জিতে, বাহুতে, কাঁধে যন্ত্রণা হচ্ছে। ছোট্ট ঘরটায় টেবিল ফ্যান আছে, তবে নিথর দাঁড়িয়ে। গরম বোধ হচ্ছে না। বাস্তবিকই কোনও অসুবিধে, কোনও কষ্টবোধ হচ্ছে না। আহ, অদ্ভুত প্রশান্তি আমাকে ঘিরে রেখেছে। লেখা এগোচ্ছে। লেখা এগোচ্ছে। বিচিত্র এক উন্মাদনায় যেন ছুটে চলেছি আমি। কোথায় চলেছি কে জানে!
শেষ শব্দটা লিখে একটা আড়াআড়ি দাগ টেনে দিলাম। লেখা শেষ। তখন আমি হাঁফাচ্ছি। তখন সকাল সাতটা পেরিয়ে গেছে। বাড়ি শুদ্ধ সবাই উঠে পড়েছে। দাদার ঘরে গিয়ে খাতাটা এগিয়ে দিলাম। দাদা বললঃ কী?
একটা উপন্যাস লিখলাম! পড়ে দেখবি একটু ?
দাদা বসেছিল। অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে খাতাটা নিয়ে বলেঃ উপন্যাস ?
আমি বললামঃ হ্যাঁ।
দাদা বললোঃ কবে লিখলি ? কিন্তু উপন্যাস ????? তার চোখে প্রবল অবিশ্বাস। আমি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।
সকাল দশটার দিকে ডাক পড়লো। জীবনে এই প্রথম আমার দাদা আমাকে জাপটে ধরলো বেশ শক্ত করে! প্রবল রাগী মানুষ, আমরা বাঘের মতো ভয় করতাম তাকে, বিপুল পাণ্ডিত্য, বিরল সৎ মানুষ, আদর্শবাদী, প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দাদা আমাকে জড়িয়ে ধরে কিছু একটা বলেছিল। আমি সেকথা শুনতে পাইনি। তখন আমি থরথর করে কাঁপছি।
জীবনে উপন্যাস লেখার সেই প্রচেষ্টা পরে ১৯৮৬ সালে শিলিগুড়ির সাপ্তাহিক বিচিত্রবিশ্ব পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল। যযাতির সঙ্কটকেই সেই উপন্যাসে মূর্ত করে তুলেছিলাম। সঙ্কটটা আসলেই পিতা-পুত্রের ব্যক্তিত্বের বিরোধ সঞ্জাত। নিজের উপন্যাস রচনার সেই প্রথম প্রয়াস সম্ভব হতো কি যদি দেবেশ রায়ের যযাতির সঙ্গে ওরকম পরিচয় ঘটে না উঠতো ! আমি আজও বিস্মিত হই যে, কী অদ্ভুত সংযোগ ঘটে গিয়েছিল সেদিন, যা আমাকে উপন্যাস রচনায় প্ররোচিত করেছিল। ভুলতে পারি না, পরিপ্রেক্ষিত নামের সেই উপন্যাসে তো দেবেশ রায়ের যযাতিকেই অনুসরণ করেছিলাম!
পরবর্তীতে, ১৯৮৬ সালে আমার প্রথম কবিতার বই বেরিয়েছিল। তার নাম? সেই যযাতি! আমার শিল্পচেতনায় কীভাবে যেন ঢুকে পড়েছেন দেবেশ রায়, আমার ঈশ্বর। পরিণত বয়সে তিস্তাপারের বৃত্তান্ত বা মফস্বলি বৃত্তান্ত, বরিশালের যোগেন মণ্ডল, মানুষ খুন করে কেন....দীর্ঘ তালিকায় মাথা উঁচিয়ে আমাকে অমোঘ ডাকে, ডাকতেই থাকে যযাতি। যেন অহল্যার শাপমুক্তি ঘটিয়ে দিয়েছেন পুরাণপুরুষ দেবেশ রায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন