আবাহন
আড্ডা ভালই জমে উঠেছে। সব মশগুল। সোমনাথ রায় বেশ হাসিখুশি মানুষ। তবে চায়ের নেশাটা বড্ড বেশি। সকলেই তাঁকে এটা নিয়ে বলে। উলটে তাঁদেরই আবার চা খাইয়ে ছাড়েন তিনি। "এই যে ক'গ্লাস চা হল কত্তা?" গিন্নির প্রশ্নে বেশ বিব্রত হয়ে যাওয়া
মুহুর্তগুলো ভেসে ওঠে অলস সকাল। আড্ডায় বাকিরা যে যার মতো ব্যস্ত কাজে। মাঝেমাঝে সবার মুখে হাসির ফোয়ারা ফোটে। আহা কী দৃশ্য! দেখেও মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকেন সোমনাথ। গিন্নির ব্যবহার দিনদিন কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে বলে তিনি বিরক্ত হন। ঘড়িতে এগারোটা বাজলেই একটু লেখেন, এই নিয়ে চলছে দিনে মানে।
আর কয়েকদিন বাদেই দোল। রঙের খেলায় মাতবে সব। রুমেলা সকাল থেকে ভেবে চলেছে কী শাড়ি পড়বে। সঙ্গে কী রঙের ব্লাউজ থাকবে। রুমেলার সঙ্গে খুব সম্প্রতি আলাপ। বয়স হলেও মনের স্ফূর্তি
দেখার মতোই। কে না চায় নতুন বন্ধু। বিজয়া আর সমীরণ চলেই এলো। সোজা প্রশ্নে,
"তুমি করেই বলছি ভাই। কেমন আছো? এই নাও একটা বই দিলাম। নতুন বন্ধু পেয়ে উপহার। জানিও কেমন লাগলো। " রুমেলা অবাক হয়ে
তাকিয়ে থাকে। এত সুন্দর মানুষ পৃথিবীতে আছে তাহলে!
সোমনাথ চায়ের আসরে ভুলুকেও সঙ্গে নেয়। কী অস্বস্তিতেই না পড়ে যায় ভুলু। ওর চা বানাতেই ভাললাগে। তবে খুব দুর্বল ছেলেটা। "মাঝে একটু আড্ডাও দিতে হয়নইলে মানুষ আর রোবটে তফাত কই।" কথাটা বলেই উদাস হয়ে গেলেন সোমনাথ। সঞ্জয় বড়ুয়া সবে এলেন। সেদিন জমিয়ে গল্প হল সঞ্জয়ের সঙ্গে। একেবারে জমে যাওয়া আড্ডায় নতুন অতিথি এলেন একজন। রূপালিকে ঘর ছেড়ে নিজে সোমনাথের ঘরে এসে উঠলেন সঞ্জয় অনেক কথা তবে ঠিক কতদিন রূপালি থাকবেন তা জানে না
সঞ্জয়। তবে এখন আর সে দায় নেই কারও। ব্রিজেশ প্যাটেল গুজরাটি হলেও বাংলা ভালই বলেন। সবার কথাবার্তা শুনে হাসছেন। একটু এলোমেলো সাজগোজে থাকে সঞ্জয় তাও লক্ষ্য করেছেন তিনি। দুপুরে লাঞ্চ ভুলে বেমালুম খোশ গল্পে মেতে আছে সঞ্জয়-সোমনাথ। প্রাণবন্ত হলেও বয়স বলে যে একটা বস্তু আছে তা অস্বীকার করবে কে? ক্লান্ত হয়ে লাঞ্চ ছাড়াই একেবারে ঘুমে কাদা। সোমনাথ বিকেলে চায়ের জন্যে তাড়া দিতেই ব্রিজেশ এসে জানাল আজ চা হবে না। ভুলু চলে গেছে। শুনেই চমকে উঠলেন। কীকরে সম্ভব! কালই যে ভুলুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। কত স্বপ্নের কথাও বলেছে। আর আজ চলে গেল!
"ঠিকানা জানতে চাইলে বাইরে আসুন।" বলে পিছন ফিরে চলে গেলেন ব্রিজেশ। বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে। সামনে এম্বুলেন্স। সোমনাথ বুঝতে পারলেন ভুলুর মুখ ঢেকে নিয়ে যাচ্ছে।
নিজের প্রস্টেট ক্যান্সার জেনেও ভুলু চা আর লাজুক আড্ডা দিয়ে গেছে সবাইকে। সোমনাথের দুই ছেলে ভুলুর চেয়ে বড়। ওদের মুখ ভেসে উঠলো। কেমন আছে ওরা! আশেপাশে তাকিয়ে মনে হল সবাই নিজেদের সন্তানদের কথা ভাবছে। এম্বুলেন্সের সঙ্গ দিল, কিন্ত সদর দরজার বাইরে যাওয়া নিষেধ। বাঁশি শুনতে চেয়েছিল ভুলু। একটু একটু করে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে এম্বুলেন্স। পিছনে লেখা 'আবাহন বৃদ্ধালয়'। কাল থেকে আড্ডাটা বদলে যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন