বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৯

ব্যক্তিগত গদ্য --নীলাদ্রি দেব




                                পথ পথিকের লিরিক                                         



এক 
জীবন তো সুতোর মতো. চারপাশে এত সূঁচ.  কখনো গলে যেতে যেতেও ফাঁক 'লে বেরিয়ে আসে পরিযায়ী ঘুমের মত. নীল রং নিয়ে তবু কেন এত মায়া, জানি না. আদিখ্যেতা সবখানে থাকে. থাকাটাও খুব একটা মন্দ নয়. কিন্তু ওই যে সূঁচ সুতো অন্যান্য আলোর নিচে কর্পূরবাতি জ্বলছে, জীবাণুমুক্ত রাখার চেষ্টা চলছে ধারাবাহিকভাবে, তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে ইচ্ছে করে খুব. বিরোধী শব্দটি অশ্লীল নয় কখনোই. নিজের অস্তিত্বের মতোই. আয়না যেমন ঠিক করে দেয় চুলের ভাঁজ, বা একান্তই তোয়ালের রং, ঠিক তেমনি. এসমস্ত শিবির বিষয়ক আলোচনা আমার থেকে আমাদের আবার আমাদের থেকে আমার- নিয়ে আসতে পারে যাবতীয় আবহাওয়াকে. তাই এসব অপেক্ষার পরিবর্তে উপেক্ষাতে জড়িয়ে নেওয়াই স্বাস্থ্যসম্মত বলে মনে হয়.
যখনই কেউ মঞ্চে কথা বলতে ওঠে প্রথম, আমারই মত হাটু থেকে ঘাড়ের চুল কেঁপে ওঠে প্রায়. এটা শুরুতেই সম্ভব. কিন্তু যদি সে বারবার না উঠেও ভেতরের সুপ্ত ইচ্ছে চারমিনারের ফিল্টারের মত শুষে নিতে পারে, একদিন ব্যাটের দু'পাশ দিয়ে ছয় মারতে পারবে. পারবেই. বিশ্বাস করতে হবে পর্বে এসে যে, ব্যাটের পিছন দিয়ে ছয় কিংবা চার মারলে সবসময় কর্তৃপক্ষ আউট নাও মানতে পারে. আর কে- বা কর্তৃপক্ষ? কেনই বা? এখানে কোন থার্ড আম্পায়ার নেই. থাকবে না. কোন জায়ান্ট স্ক্রিনে লেখা ফুটে উঠবে না ডিসিশন পেন্ডিং. তবুও, এত এত কথার শেষে ইচ্ছে পুষে রাখা কেউ বা কারা কোন না কোন দিন অভিজ্ঞতায় পুষ্ট হবেন, তিনিও জমিয়ে রাখবেন টকশো' মাঠ. আলো মেখে নেবেন প্রিয় পোশাকে. যে পোশাক তার নিজেরই হতে হবে, এমন কোনো মাথাব্যথা নেই. আজকাল অধিক সৌজন্যতা দেখাচ্ছে বিশেষ বিশেষ ব্রান্ড. পাড়ালু তাঁতিও. এরই মাঝে মাননীয় অভ্যস্ত মুদ্রায় স্বাগত জানিয়ে অনুষ্ঠান শুরুর পর এবং নিজের কথার মূল অংশের আগে বেঁধে রাখা পাবলিকের দিকে ছুঁড়ে দেবেন খেপলা জাল. পরে হয়তো সেই জাল ধরে তুলে আনবেন বা আনতে চাইবেন প্রিয় জলার প্রিয়তম ওভারটিকে. যা ছয়ের ডবল হ্যাট্রিক দিয়ে সাজানো. তাই বন্দনা গীত. তাই কথা শুরুর আগে এমন সূচনা(সূঁচ'না). কথায় কথায় প্রবেশ তো করেই ফেলেছি. এবার আসুন, আসল কথায় আসি.


দুই
দেখি আমাদের চারপাশ. দেখি, কীভাবে পাল্লা দিয়ে বদলে যাচ্ছে আমি আমাদের মধ্যবর্তী শূন্যতা. আমরা শব্দটি কতটা অসহায় হয়ে পড়ছে একা আয়নার সামনে. একটা বাতাস ক্রমে গ্রাস করছে যাবতীয় সুস্থতা. আসলে সুস্থতা বলেও কি কিছু আছে? আমরা তো সকলেই সুস্থতার ভান করছি শুধু! আর বহন করছি একটা ইচ্ছে, যা মানুষ ভেদে আলাদা হলেও কোথাও যেন এক সুতোতে গাঁথা. জীবন দাঁড়িয়ে আছে খসড়া খাতার ওপর. নির্মীয়মান নির্মিত গদ্যের মাঝে জন্ম পরজন্মের অনন্ত লিরিক. এসবের মাঝে বিরোধী কিছু যুক্তি,মেনে বা না মেনে নেয়া ইস্তেহার পেরিয়ে একটু নরম আলো. আলোই দুর্বল করে মন. একটা অবলম্বনের আশায় খুঁজতে থাকি সত্য. প্রতিটি মানুষের সামনে এসে দাঁড়ায় নিজস্ব অথচ অপরিচিত অবয়ব. গলে যেতে দিলে গলে যায় মুখোশ. উঠে আসতে থাকে প্রশ্নের ঢেউ. সময়. সময়ের গায়ে চিহ্ন. কোনোভাবেই আর ঢেউ ফিরে যায় না উৎসের দিকে. মৃত্যু উঠে আসে প্রশ্ন, যুক্তি অন্যান্য অধ্যায়ে. রহস্য ঘেরা চেনা একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে. এবার দাঁড়াতে হয় একা. নদীর মত. উড়ে আসা ঢেউ থিতিয়ে যায় দুপাশের পলিতে. নিজের ভেতরে ঢুকে গেলে যে ক্ষরণ, তাতে ভেসে আসা পানাগাছ মৃত্যু বিষয়ক রহস্য গাঁথা হয়ে ওঠে. আকাশ কালো হতে থাকে. মেঘ থেকে মেঘে গানের শেষ স্তবক অপেক্ষা করে. জড়িয়ে যাই নিভে আসা আলোয়.


তিন
তুরতুরিখণ্ড চা বাগানের কথা মনে পড়ে. পড়ছে. মনে পড়ছে ছেত্রী পরিবার. পাহাড়ের গায়ে তখন কুয়াশা ছিল খুব. বনমোরগের পালকে শীত. হেঁটে গেছিলাম নদীর মত. স্রোত কখনো বেশী, কখনো কম.
পথ বেঁকেছিল. পথ জুড়ে গেছিল নিজেদের সাথেএকা জামরং যুবক হেঁটে বেড়াচ্ছিল ফার্ণের পাশ দিয়ে. ওর হাঁটাগুলো বিক্ষিপ্ত. আমি পাশ বরাবর গেলেও কোনো ভ্রূক্ষেপ দেখিনি. শুধু সময়ের কথা মনে হচ্ছিল.
তীব্র মন কেমনের মত আজ বৃষ্টি. ডেয়ারি ফার্মের দরজা দিয়ে সরু কোনো আলো এসে পড়ে. মাকড়সার মত লেপ্টে আছি. জলের ওপর বর্ষা. হাওয়া এলে দুলে উঠি. দুলে উঠি আঘাতে আঘাতে. তবু ছায়াগাছ ঘনত্ব হারালে জ্বর আসে আমাদের. জ্বর এলে আজকাল খুব মায়ের কথা মনে পড়ে. উত্তাপ থার্মোমিটারে আর ধরা পড়ে না. অকার ইয়েলো মেখে নিই সুতোর চাদরে. গাছেদের ছায়া বৃত্ত পথে ঘুরলে বারবার পোশাক বদলায় চিন্তাশীল কেউ/কারা. ওদের কোনো ধর্ম নেই, জাতি নেই. নাম ছিল. ভাঙাচোরা কিছু উচ্চারণ আজও লেগে আছে সিগেরেট চায়ের সিপের মাঝে. হঠাৎই ওদের পরিচয়পত্র বাজেয়াপ্ত করেছে মেঘলা দিন. শামুক শেয়ালের গর্তে জল. ওরাও বেরিয়ে পড়ছে. নাম শুষে নিলাম ভোটারদের. নাম ছাড়া সকলেই ভোটার. কামান কামান খেলছে বন্য বন্ধুত্ব.
ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে আবারও ঘর. বাইরে বেরোলেও ঘর. চারপাশে সেলাই সুতো. খণ্ড অনেক হলেও দুটো করে খণ্ডই তুলে নিতে হয়. তুলে নিই. দেখি, সীমান্ত. সীমান্ত জুড়ে দিলেই এলোমেলো সোয়েটার. সোয়েটার খুলে সমুদ্রের দিকে এগোতে ইচ্ছে করে. ইচ্ছে একটা অসুখ. অসুখ জড়িয়ে মৃত্যুবার্তা চিতা. চিতার জন্য কাঠ কিনতে গিয়েও ফিরে আসি. কেউ কেউ হাসে. কফিন কোনোদিনই ভাল লাগেনি. ভেবেছি, দম বন্ধ হয়ে আসবে. আমার ঘুম পাচ্ছে খুব. ঘুমোতে পারছি না. অজানা কিছু চিন্তা করছি. তবু ভয়.
আমি মানুষ. সে মানুষ. তুমিও.
তবু ভয়.


চার
আসলে একটা সিস্টেম চলছে.
ডানে বামে সামনে পেছনে ওপরে নিচে... সিস্টেম চলছে.
আপাতত ভুলে যেতে ইচ্ছে করছে কোথায় আছি, কেন কীভাবে. বিশ্বাস করুন, ভুলে গেলাম. এবার একটা অবাস্তব গল্প ভাবব. অঢেল সময়ের গল্প নয়, ফেসবুক স্ট্যাটাসে মেরেকেটে মিনিট চার. ছোট, অণু, পরমাণু এসব নেই. কোন ট্যাগ নেই, চাপ নেই. পড়লে ভাবতে ভাবতে... ভাবলে পড়তে পড়তে... কিন্তু কি ! নিয়ম? এত বড় স্পর্ধা? ছি:!
এটা বাজে অভ্যাস মাত্র. ভূমিকা. শেষ পাতেও ভূমিকা গুঁজে দেওয়ার চেষ্টা. জাস্ট ইগনোর. আসুন. একসাথে ভাবি. যদি গল্প এমন হয় ...
... আঙুল রক্তচোখের বিপরীতে বরাবরই দাঁড়িয়ে থাকে অনন্ত বিপ্লব. দাঁড়িয়ে আছে. ভাবতে কষ্ট হয়, 'দাবিয়ে দেওয়া' একটি ভ্রান্ত শব্দ জেনেও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শেষ আঁচড় দিচ্ছে কেউ/কারা. আপনার আজ মলম নিয়ে আসার কথা ছিল. এলেন না. আপনি বরফ আনবেন আশা করেছিলাম. এলেন না.
যে সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠে এলেন, খসিয়ে ফেলেছে ঘনিষ্ঠ বৃত্ত. এরপর যে ছাদ, তাতে উঠবার আগে ভিত দেখে নেওয়া প্রয়োজন. ঝুলন্ত দড়ি দিয়ে যাতায়াত বিপজ্জনক. আপনি চিন্তা করবেন না. ঘামবেন না এসময়. হাত পিছলে যেতে পারে. কিন্তু এক ছাদের কাজ শেষ না হতেই কেন সবাই পরবর্তী ফ্লোরের কথা ভাবছে. এই ছাদে কত শার্ট, কত শাড়ি, কত বেবিফুডের প্যাকেট. তাও ট্রাফিক কন্ট্রোলড নয়. ট্রোলড. ছেঁড়ে দিন যানজটের কথা, গালাগালের কথা বা মাখন মাখানো পাউরুটির কথা. বৃষ্টি হচ্ছে. চশমা অস্পষ্ট দেখাচ্ছে. মুছে পড়ুন. সবটা দেখাবে. স্বপ্নও তখন অনেকটা ঝকঝকে. বঞ্চনা লিখতে গিয়ে বানানে যে ভুল হয়েছিল, রাবার দিয়ে মুছে ঠিক করে নিতে পারবেন. করে নিন.
পৃষ্ঠা উড়ে গেলে গল্প ভেস্তে যাবে.


পাঁচ
এমন অনেক প্রশ্ন থাকে যার হয়তো সঠিক কোন উত্তর দেওয়া যায় না. বা সঠিক কোন উত্তর হয় না. এই প্রশ্ন উত্তরের মাঝে দ্রবণীয় বিষাদলিপি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অজস্র খুঁজে চলা. এই খুঁজে খুঁড়ে  চলাগুলোকেই বেসক্যাম্প ভাবতে ইচ্ছে করে. খুঁজতে খুঁজতে কোন এক পথ. পথ ধরে এগোলে নির্দিষ্ট কোন স্থান. আর এরপর পরবর্তী পর্যায়ের জন্য নিজেকে তৈরি করা. কারণ দীর্ঘ হেঁটে যেতে একটা প্রস্তুতির প্রয়োজন হয়. প্রস্তুতি পর্বের শেষে সেই মায়াপথ. এবার সামনে অজস্র মানুষ. তার মাঝে পায়ের প্রতিটি চিহ্ন রেখে গেলে, বেঁচে থাকা. অন্তহীন পথে, যে কোন অংশে ঝোড়ো হাওয়া. তীব্র হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে যে কেউ. এছাড়াও অক্সিজেনের অভাব. আর পথ তো সরলরেখা নয়. সরলরেখায় পাহাড় ডিঙোনো অসম্ভব. তাই উঁচু-নিচু ঢাল, আঁকা-বাঁকা রাস্তার পাশে পাথরের ঢিবি. খসে আসা পাথরের ভয়. খাদ. এসবকে পাশে রেখে হেঁটে যাবার ইচ্ছে. হেঁটে যাওয়া.
হয়তো এভাবেই দেখি জীবনকে. কবিতাকেও.
বিষয়কেন্দ্রিক খুচরো জীবনের পরই একটা সময় বাস্তব জীবনের কাছাকাছি চলে আসে মানুষ. সেটা কখন, তা সঠিক ভাবে মনে থাকে না. মনে থাকতে নেই, সেসব সাল মাস তারিখ. যেভাবে চুম্বকের কাছে এলে ধাতু বুঝে ওঠার সময় পায় না, চৌম্বকক্ষেত্রেই সে আছে. ঠিক সেভাবেই  অদ্ভুত এক ভালোবাসা ঘেরা মায়া জগতে ঢুকে যাওয়া. একবার জীবনে জড়িয়ে গেলে, আর কি এর থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব? আপাত বেরিয়ে আসাও কি স্বাভাবিক থাকতে দেবে/ দেয়? জানি না. এতসব ভাবতে গেলে আজকাল শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে. কমে আসে জল. জলস্তর এর পাশে কবিতার বীজ. গাছ নয়, হয়তো বৃক্ষ হয়ে ওঠে. উঠবে একদিন. দেখি. স্পর্শে ছায়া পাই. ছায়া. ভালমন্দে আনন্দকষ্টে ব্রেকিংনিউজের আগেপরে বইয়ের কাছে ফিরে আসি. ফিরে আসি মানুষের কাছে. আমার চারপাশ, উত্তরবঙ্গের কাছে. প্রকৃতির কাছে. তোর্সার কাছে. মাটি ফাঁকা মাঠের কাছে. শীতের রাতে জীর্ণ স্ট্রিটলাইট অপরিচিত নেড়ির কাছে. ওরা আমাকে জড়িয়ে নেয়. অসম্ভব কুয়াশার মাঝে এরা ঘিরে ধরে. গোল ঘন হয়ে আসে.
কিন্তু তারপরও মনে হয়, ভাগফল মিলে গেলেই যে অংক সঠিক, এমন নয়. মনে হয়, হই হই থাকতে থাকতে কখন যেন শুধু নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি. স্থির হয়ে আছে সময়. সময়ের দাগগুলো আঙুলের ছোঁয়ায় আরও ভীষণ রকম জীবন্ত হয়ে ওঠে. যার কাছে এলে, ফেলে আসা পথকেই সবচেয়ে বড় শিক্ষক বলে ভেবে নিতে বাধ্য হই. পথ সরু রেখা. ঘাসওঠা জমি. ফিতের মত জমি. চারপাশে ঋণ. ঋণ. ঋণ বেড়ে যায়. মনে হয়, নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে একক খুঁজে দেখা ছাড়া আর কিছু নেই. আর কিছু থাকতে পারে না আমাদের জন্য.



                                                                                                                                                                   


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বনিক

  উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বণিক উৎসবের আর মাত্র কয়েকটা দিন, একদম হাতে গোনা।  আর উৎসব  সংখ্যা ছাড়া উৎ...