লেখক যখন সম্পাদক
লেখক ও সম্পাদক -- প্রদীপ্ত খাটুয়া |
নয়ের দশকের শুরুতে
যখন কবিতা লেখা
ও কবিতা পাঠের
অদ্ভুত এক নেশায়
পাগল, পড়াশুনো, সামাজিক
লোকাচার, আত্মীয়-স্বজন
সবই একপ্রকার যখন
শিকেয় ওঠার উপক্রম,
একের পর এক কবিতার
নতুন অনুষ্ঠান, নতুন
নতুন কবিবন্ধুর সঙ্গে
আলাপচারিতা, আড্ডা জমে
উঠছে, চায়ের দোকান
যখন জীবনের অভিষ্ট
স্বপ্ন মনে হয়েছে,
ঠিক সেসময়ে কয়েকজন
কবিবন্ধু মিলে শুরু
করি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার কাজ।
জেলা বইমেলায় প্রথম
পত্রিকা প্রকাশিত হবে।
লেখা সংগ্রহের জন্য
কবি-লেখকদের বাড়ি
বাড়ি বারবার যাতায়াত। টিউশন প্রায়
বন্ধ। রাত
জেগে তৈরি প্রচ্ছদ। ধারে কেনা
ডবল ক্রাউন কাগজ।
মাস শেষে টিউশন-পেমেন্ট
পেলে পরিশোধের প্রতিশ্রুতি এবং শেষমেষ
বেরোলো বহু প্রতিক্ষীত কাগজ। বন্ধুদের লেখা কবিতা
গল্প। উত্তেজনায় রাতের
ঘুম গেছে। তারপর প্রকাশ
অনুষ্ঠান। খরচ
কে দেবে? কিভাবে
আসবে? জেলা গ্রন্থাগার ভবনে অনুষ্ঠান হলো। ক্যামেরায় ছবি তোলা
হলো। সে সব অতীত।
শুধু ,স্মৃতির তাড়নায় কিছু ছবি
এখনো প্রোজ্জ্বল। অবশিষ্ট
জীবনের সম্বল।
সবাই মিলে সম্পাদনার এমন আনন্দ
জীবনের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তার কয়েক বছর
পর হাজার ১৯৯৬
(বাংলা ১৪০৪) সালে
আমার নিজের সম্পাদনায় প্রথম পথ চলা
শুরু করলো শব্দ
পথ। কাঁথি প্রভাতকুমার কলেজের অধ্যাপক
খগেশ্বর দাস "শব্দপথ"
-এর নামকরণ করেছিলেন। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা থেকে
শব্দপথ প্রথম অফসেটে
ছাপা পত্রিকা। প্রচ্ছদ
কবি প্রদীপ সামন্ত।
সম্পাদকের এত কাজ,
এত দায়িত্ব, এত পরিশ্রম
আগে বুঝিনি। টিউশন
শেষ করে রাত
নটায় তমলুক থেকে
১৮ কিলোমিটার সাইকেল
চালিয়ে গেছি সাহিত্যিক মালীবুড়োর বাড়ি।
লেখা সংগ্রহ করতে।
এভাবে অনেকটা সময়
গেছে। এখনো যাচ্ছে,
সম্পাদনার নানান ঝক্কি
সামলাতে। শব্দপথ-এর বয়স
এখন ২৪ বছর।
নিয়মিত বেরোচ্ছে ছাপার
অক্ষরে। বর্তমান সময়ে
সারা দেশ তথা
সারা বিশ্বে চলছে
অতিমারীর COVID-19 আবহ। সেই
আবহে যেহেতু আমরা
সবাই গৃহবন্দী, তাই
শব্দপথ এখন ওয়েব
ম্যাগাজিন।
জুন ২০২০ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
মাত্র ২০ দিনে
ভিউয়ার্স পাঁচ হাজার
ছাড়িয়েছে। ধক্কি যেমন
আছে লিটিল ম্যাগাজিন সম্পাদনায়, আবার
আনন্দও আছে। সে আনন্দ
সমস্ত কবি-লেখকদের
মধ্যে ভাগ করে
নেওয়া যায়। ছাপাঅক্ষরের কাগজের গন্ধে
ম-ম করে সারা
ঘর প্রেস থেকে
পত্রিকা আনার দিন।
কিন্তু একটা লিটল
ম্যাগাজিন দীর্ঘমেয়াদে চালাতে
গেলে যে আর্থিক
দায়বদ্ধতার প্রয়োজন হয়,
আমার মনে হয়
রাষ্ট্র বা সরকার
আংশিক হলেও কিছুটা
আর্থিক সাহায্য করলে,
বিজ্ঞাপন বাবদ, ছোট
পত্রিকাগুলি রক্ষা পায়।
মুখ তুলে দাঁড়াতে পারে।
এক একজন প্রান্তিক শহরের সম্পাদক
যেভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম
করেন তাঁর কাগজকে
বাঁচিয়ে রাখতে, কাগজের
সম্ভ্রম বাড়াতে প্রাণ
ওষ্ঠাগত করেন, তাঁরা
অন্তত শ্রমের কদর
পাবেন।
লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনার ক্ষেত্রে একটা
কাজ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে আমার
মনে হয়েছে। এবং
বেশীরভাগ লিটল ম্যাগ
তাই করে। তা হল লেখা
নির্বাচন। প্রত্যন্ত গ্রামের
একজন কবিতা লেখকের
লেখা চোখ কপালে
উঠিয়ে দেয়। তিনি
অনামী হতে পারেন।
হয়তো তরুন লেখক।
কিন্তু লেখাটা এক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য। বাংলার দুরদুরান্তের জেলাগুলো থেকে
প্রায়শই এরকম লেখা
ডাকে আসে। আমার
পত্রিকার ক্ষেত্রে এরকম
হয়েছে। পরবর্তীকালে তিনি
নামী কবিতা লেখক
হয়েছেন। বিভিন্ন লিটল
ম্যাগাজিনে তাঁর লেখা
নিয়মিত প্রকাশিত হয়।
এবং এখানেই একজন
সম্পাদকের আসল দায়ীত্ব
এবং কর্তব্য। একজন
সম্পাদক আসলে কষ্টিপাথরের মতো। তিনি
আসল রত্নটি চিনে
ফেলবেন। এবং তা দিয়ে
বাংলা সাহিত্যের সম্ভার
সাজিয়ে তুলবেন। পত্রিকা
দপ্তরে অনেক লেখাই
আসবে। কিংবা অনেক
পরিচিত মুখের কবিতা
লেখকই লেখা পাঠাবেন। কিন্তু আপনাকে
অর্থাৎ একজন সম্পাদককে সেরা লেখাগুলো নির্বাচন করে
নিতে হবে। নাহলে
পাঠক বঞ্চিত হন।
আমরা সম্পাদকরা নিজেদের
পত্রিকা পাঠককুল কে বিনষ্ট
হতে দিতে পারিনা।
কারন, অনেক মেহনত
করে পাঠক তৈরী
করতে হয়। সম্পাদকের আরও একটি
গুরুত্বপুর্ণ কাজ- প্রতিভাবান লেখক আবিষ্কার করা। এবং
তাঁকে দিয়ে সেরা
লেখাটি লিখিয়ে নেওয়া।
সময়ের সঙ্গে নিজেকে
আপডেট রাখতে পারেন
বলেই প্রত্যেক দশকে
দু-চারজন কৃতী
সম্পাদক আমরা উপহার
পাই। সবাই জানেন।
তাই আমি এখানে
নামগুলি উল্লেখ করলাম
না।
তবে এটুকু ঠিক,
সম্পাদক যদি নিজেই
লেখক-কবি হন, সেক্ষেত্রে সম্পাদনার নানান
নিয়মকানুন, প্রচার, বিজ্ঞাপন সংগ্রহের মতো
ঝামেলা লেখকসত্বার স্বাভাবিক গতি কোন
কোন সময় রুদ্ধ
করে। এসময়ের বিখ্যাত
কবিদের অনেকেই ভালো
ভালো লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন।
আসলে আমার মনে
হয়, লিটল ম্যাগাজিন হল একটি
হাতিয়ার, যার সাহায্যে একজন নতুন
কবি তাঁর চারপাশের অজস্র কবি
বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগের সেতু গড়ে
তুলতে পারেন অনায়াসে। এক কপি
নতুন পত্রিকা কাঁধের ঝোলা
থেকে বার করে
পাশে বসা সদ্য
পরিচিত কবি বন্ধুকে
দিয়ে বলতে পারেন-
আমি এই কাগজটি
সম্পাদনা করি। কাগজটি
পড়ে দেখবেন। আর কাগজের
ঠিকানায় আপনার লেখা
পাঠাবেন। এই যে আন্তরিক
উক্তি, এ উক্তির মূলে
মনে হয় এই পত্রিকা। ছোট একটি
পত্রিকা। পত্রিকাটি অনেক
ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য কবিদের
সঙ্গেও সম্পর্কের সেতু
হিসেবে কাজ করে।
পত্রিকায় ছাপা লেখাটির
মাধ্যমে প্রতিভাধর কবি
তাঁর লেখা ছড়িয়ে
দিতে পারেন বাংলার
এক প্রান্ত থেকে
অপর প্রান্তে। বাংলাভাষায় সাহিত্যচর্চাকারী সুধীজনের মধ্যে। ফলে
এক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা এবং
লেখালেখি, উভয় উভয়ের
পরিপূরক।
কাজের প্রতি একনিষ্ঠ
হলে, কাজের প্রতি
দায়বদ্ধ হলে, প্রচুর
পড়াশুনা, প্রচুর লেখালেখির পাশাপাশি ছোট
পত্রিকা অবশ্যই সম্পাদনা করা যায।
তা সে় নিয়মিত
না হোক, অনিয়মিত। যখন ভাল
লেখা সংগ্রহ করা
যাবে, তখন। খুব
বড় না হোক,
রুচিসম্মত, নির্ভুল বানান,
ঝকঝকে বাঁধাই, ছিপছিপে
চেহারার লিটল ম্যাগাজিন। বেশিরভাগ কবি-লেখকই
যার প্রাণ, যার
অতিন্দ্রীয় পাঠক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন