লেখক যখন সম্পাদক ...
লেখক ও সম্পাদক মনোনীতা চক্রর্বতী
|
অলৌকিক এক সৌন্দর্য এবং বিষাদ নিয়েই শুরু থেকে চলা। মধ্যবর্তী সবটুকু অর্জন। আর শুরুর একটা অন্য ঐশ্বর্য থাকে, তাই না? বেশ কয়েকবছর আগের কথা, তনুশ্রী'দি তাঁর পত্রিকা তিস্তা নন্দিনী-তে ঠিক প্রায় এরকমই একটা লেখা লিখতে বলেছিলেন। লিখেছিলাম। তবে, এখানে যেটা বাড়তি পাওনা তা-হল সম্পাদক এবং লেখক যখন একই ব্যক্তি তখন সেই দুই সত্তার যে পারস্পরিক বৈপরীত্য; তা-নিয়ে বলার জায়গা। কাজেই আমি এটা নিয়েই আগে বলবো; তার আগে আমি এখানে যে-সকল অগ্রজ এবং অনুজ লেখক-সম্পাদকেরা লিখছেন এবং যাঁরা লিখছেন না , তাঁদের প্রত্যেককে জানাই আমার সশ্রদ্ধ শুভেচ্ছা! আসলে, প্রথমেই আপনারা তথা পাঠকেরা বলবেন আদৌ আমার কাজগুলো কাজ হচ্ছে কিনা। তা সেটা নিজস্ব লেখাই হোক বা সম্পাদনা। প্রথমত, আমার এখন পর্যন্ত কোনও নিজস্ব বই নেই। যেটুকু লেখা সেই ১৯৯৭-৯৮ থেকে তা ওই ক্ষুদ্র পত্রপত্রিকায়
ছাপা বা বিভিন্ন সংবাদপত্রে। অল্পবিস্তর বাণিজ্যিক কাগজেও। যদিও কেন জানি না আমার এই 'বাণিজ্যিক'-শব্দটি ব্যবহার করতে ভালোলাগে না; তবু করলাম।
আমি আমার মতো করে লেখাটা লিখি। যখন-যেভাবে শব্দেরা ধরা দেয়; ঠিক সেভাবেই। একেবারে সাংঘাতিকরকম পরিকল্পনা করে লেখালেখি আমার ধাতে নেই। ঠিক দিনের এই সময় আমি কলম ধরবো, ভুল বললাম কি-প্যাডে আঙুল রাখবো লেখার জন্য এমন ব্যাপার নেই। কত সময় এমনও হয়েছে যে ভিতরে হুহু করে শব্দরা আসছে; কথারা আসছে, অথচ পরে লিখবো করে না-লেখাই থেকে যায়। যাইহোক, আমি সত্যিই জানি না যে আমি লেখক কিনা! তবে প্রচুর মানুষ আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন, ভালোবাসা বা প্রশ্রয় যা-ই বলি-না কেন সেসব নিজস্ব কোনও বই না-থেকেও আমি পেয়েছি। আর-কী চাই! তাই সম্পাদনার সাথে তার কোনও বিরোধ আমি খুঁজে পাই না অন্তত। এমনও হয়েছে যে সম্পাদনা করতে গিয়েও কোনও লেখা ভিতরে এসেছে, আমি লিখে ফেলেছি। আবার কখনও বলেছি নিজেকেই, 'এখন সময় নেই..'! আসলে, সম্পাদনা তো বটেই আমি যখন যে-কাজ করি খুব মন দিয়ে করার চেষ্টা করি, নিজের ভালোবাসার কাজের সাথে কোনও আপোশ করি না কখনও। সম্পাদনা তো বটেই! তাই, ' সময় কোথায় সময় নষ্ট করবার'- লেখাদের চেয়েও যে বড্ড বেশি আদরের, যত্নের আমার সম্পাদনার কাজ! তাই ওদের সরিয়ে রাখি আলগোছে। এ তো আমাদের নিজস্ব বোঝাপড়া; হ্যাঁ, দুই সত্তার। যদিও সত্তার ভিতর কত সত্তা, তবুও বলবো যে সম্পাদক মনোনীতা এবং লেখক মনোনীতার কোনও বিরোধ নেই, বৈপরীত্য থাকলেও।
এবারে আসি সম্পাদনা করতে এসে কী-কী সমস্যা বা বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েছি, সে-কথায়। আসলে, লিটল ম্যাগাজিন নিজেই
একটা স্বাধীন সুর। এখানে সবটুকুই যেন পবিত্র জলোচ্ছ্বাসের
শব্দ; তার মতো করে রয়েছে তার এক নিজস্ব কণ্ঠস্বর। বোহেমিয়ান ছন্দ। আসলে প্রতিযোগিতায়
নেমে তো কেউ ছোটো-কাগজ করেন না বা লাভের ঘরে গ্ল্যাডিওলাস
আর রজনীগন্ধা মিলিয়ে-মিশিয়ে রাখবেন আর সেই অর্থ আসবে লিটল-ম্যাগ বিক্রি করে; তাও নয়। বেস্ট-সেলর হতে এখানে কেউই আসেন না। অতএব, কষ্ট আছে; ঘাম আছে, রক্ত আছে তার পাশাপাশি তুমুল এক আনন্দ আছে! তাই, বিশ্বাস করুন সবটুকুই অর্জন আর সঞ্চয়! কিছু পেতে তো আসিনি। তাই হারাবার ভয়ও নেই। শুধু কাজ করতে-করতে বা কাজ সংক্রান্ত কোনও কারণে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লে চোখ বুজে চুপ করে থাকি। রবি ঠাকুরের ওই গানটি মনে-মনে গাই, ' ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু...'। পথে এগোলাম না পিছিয়ে পড়লাম এই নিয়ে শুধু সম্পাদনা কেন, কোনও ক্ষেত্রেই আমার কখনও মাথা ব্যথা নেই কোনও কালেই... কিন্তু অবসন্নতা এলে ওই ক্লান্তিটুকুর
জন্য ক্ষমা চেয়ে নিই। সম্পর্কে কী সম্পাদনায়; ঠিক একইরকমভাবে।
পত্রিকার প্রচ্ছদ
|
পত্রিকার প্রচ্ছদ
|
আমার দুটো পত্রিকা। দাগ এবং শেষের ৪৮ পাতা থেকে। যেহেতু দাগ আমার প্রথম কাগজ এবং যাঁরা ইতিমধ্যে দাগ-এর সঙ্গে পরিচিত তাঁরা জানেনই যে দাগ-এর ট্যাগ-লাইন কী। "শব্দ শিল্পের নান্দনিক আয়োজন..'' অগ্রজ কবি শ্রদ্ধেয় সুবীর সরকারের দেওয়া এই ট্যাগ-লাইনটি। কাজেই অক্ষর তো নিজেই এক বৃহত্তর শিল্প; এছাড়াও শিল্প-সংস্কৃতির এক আয়োজনও সেখানে রয়েছে। অতএব, সমস্ত দিক সামলে এ কাজ খুব সহজ নয়। পারিবারিক-জীবন, কর্ম-জীবন এসব সামলে কষ্ট হয় বইকি, অস্বীকার করার জায়গা নেই! গত দু'বছর রোজ শিলিগুড়ি-ইসলামপুর বাস-জার্নি করে স্কুল করে বাড়ি ফিরে রান্না করে বিধ্বস্ত অবস্থায় কাজে বসেছি। শরীর সাথ দিচ্ছে না, তবুও। ইসলামপুরে থেকে যে কাজটা করবো সে-উপায় নেই, কারণ আমার মেয়ে ক্লাস ইলেভেন থেকেই এক ভালোরকম অসুস্থতায় ভুগছে, এখনও। এই নিয়ে টুয়েলভ-এর বোর্ড দেওয়া। আসলে, প্রসঙ্গক্রমে
ব্যক্তি জীবন ঢুকে পড়লো ইচ্ছের বিরুদ্ধে, কারণ সম্পাদনার সমস্যা যখন বিষয়, তখন তো স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠেই আসবে, তাই না! সে-বার প্রথম তিনটে ভাষা নিয়ে দাগ-এ কাজ হল। বাংলা, ইংরেজি এবং হিন্দি। কত যে ঘুমহীন রাত পার করেছি তা লিখে বোঝাতে পারবো না! আবার তাঁকেই ধার করে বলতে হয়, "তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে..."
কিন্তু কাগজকে ঘিরে রয়েছে আরও কথা। অনেক-অনেক জমা যন্ত্রণা দেয় অভিমানের জন্ম। কেউ-কেউ কীভাবে যেন দেখে ফেলে সেই জন্ম-জড়ুলের কুৎসিত দাগ! মুখ থেকে মুখোশ খুলে যায়। যখন দেখি সামান্য প্রাপ্তি-স্বীকারটুকুও
করেন না, আমাকেই ফোন করে জেনে নিতে হয় যে তাঁরা কুরিয়ার করে পাঠানো পত্রিকা পেয়েছেন কিনা! সবার কথা বলছি না কিন্তু; অথবা বলেন যে শুধু তাঁদের পৃষ্ঠাটুকুর ছবি করে যেন পাঠিয়ে দিই কিংবা ধরুণ দুই সম্পাদক। আমি এবং এক্স। এক্স আমার কবিতা চাইলেন, আমি কিছুদিনের মধ্যে দিলাম। এক্স আমায় ওঁর একটি লেখা হাতে ধরিয়ে বললেন যে আমি যেন ছাপি। যেইমাত্র, বললাম, 'পরে পড়ে দেখবো, মনোনীত হলে থাকবে।" সঙ্গে-সঙ্গে একশ আশি ডিগ্রি ঘুরে গেলেন! এমনও হয়! আবার কেউ যখন ঘামরক্তে জন্ম দেওয়া তীব্র ভালোবাসার জন্য রেখে যান যে আছে প্রচুর টাকা তাই ইটের থান করে রেখেছে আর-কী! বিশ্বাস করুন, চুপ হয়ে যাই। চুপ করে থাকি না! কখনও অনেক সত্যিও বলা যায় না, সত্যি হলেও। কেমন ম'ম করে নিজের ঢাক পেটানো মনে হয়! আর ঢাক পেটানোর সুযোগ পেলে খুব কম মানুষই আছেন যাঁরা না-
পত্রিকার প্রচ্ছদ
|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন