বুধবার, ৫ আগস্ট, ২০২০

লেখক যখন সম্পাদক -- অরুণ পাঠক


           
                                                   আমার সম্পাদনা, আমার লেখা 

লেখক ও সম্পাদক অরুণ পাঠক 
একজন সম্পাদক ও কবিকে যে সব ভয়ংকর পরিস্থিতি ও পরিবেশের সম্মুখীন হতে হয়, একজন কবি, যিনি কোনও পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁকে সে সব পরিস্থিতিও পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয় ন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার কবি ও সম্পাদকের প্রতি এই ধারণা বর্ষিত হয় যে তিনি সম্পাদনাসূত্রে কবি, অর্থাৎ তিনি নিজের কবিতা প্রোমোট করার জন্যই পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। অন্য দিকে একজন শুধুমাত্র কবি কলঙ্কহীন লিখে চলেন সেইসব পত্রিকায় ও বিশুদ্ধ স্বার্থহীন এক অহংকারে চলাফেরা করেন। শুরুতেই এই তুলনামূলক কথাগুলো বলে ফেললাম এই কারণে যে পঁচিশ বছর পত্রিকা সম্পাদনাসূত্রে মাঝে-মধ্যেই অনেক শুধুমাত্র কবির কাছ থেকে " ওহ্বেলাভূমি ", কিংবা "ও একটা পত্রিকা করে"--- এই জাতীয় মন্তব্যে পরিচিত হয়েছি । "ও যে কবিতা লেখে"--- সেটাকে গৌন বা ভ্যানিশ করে দেওয়ার একটা সহজ রাস্তা তাঁরা খুঁজে নেন ওই দ্বিতীয় সত্তাটিকে কাজে লাগিয়ে ।


আমরা যারা পঁচিশ বছর আগে কপর্দকশূন্য হাতে পত্রিকা সম্পাদনা করতে শুরু করেছিলাম তাতে অধুনান্তিক কোনও গোষ্ঠী বাজি ছিল না। নিতান্ত গ্রামে বাস করা সদ্য যুবক যুবতীর শুধু মাত্র লেখার স্বপ্নই ছিল পাতা জোড়া। পত্রিকা দিয়েছে নতুন নতুন বন্ধু । আবার বন্ধু বিচ্ছেদও ঘটিয়েছে। যাদের লেখা ছাপতে পারিনি তারা সরে গেছে অনেক দূরে। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা কটা জুড়ে একটা আদর্শ ও রুচিবোধ তৈরি হয়েছে । সেই রুচিবোধে অনেক কিছুই আটকে যায় । আবার অনেক কিছুই দিগন্তের বার্তা আনে। একটা পত্রিকা নিয়মিত সম্পাদনা করলে সম্পাদককে যেমন প্রভূত পড়াশোনা করতে হয়, খোঁজ খবর রাখতে হয় অতীত থেকে সমসাময়িক সাহিত্য চর্চার হাল


হকিকত, শুধুমাত্র সাহিত্য চর্চা কারীর অতখানি দায় নাও থাকতে পারে। যৌবনের সূচনা থেকেআজ পর্যন্ত যে শ্রম, সময় ও অর্থ পত্রিকার জন্য ব্যয় করেছি, এখন ভাবি সেটা না করলে কি জীবন অন্যরকম হতো? মাতৃভাষার বর্ণবিকাশে আমার মতো একজন সাধারণ মানুষের এই প্রচেষ্টা হয়ত পরোক্ষে কিছু অক্সিজেন দিয়েছে। বাংলা ভাষার বাঁক বদল, বাংলা কবিতার ইতিহাস বদলে দেওয়া পত্রিকার পেছনে যে প্রাতিষ্ঠানিক সত্তা থাকে তা গ্রাম বাংলার অসংখ্য লিটল ম্যাগাজিনের নেই। কিন্তু ভাষার প্রবহমানতাকে চলিষ্ণু রাখার মহাকালিকপণ্ডশ্রমে তাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি ।
পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে অনেক কিছু শিখেছি । অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে যা আমার ব্যক্তিগত কবিসত্তাকে অনেক বেশি ক্ষুরধার করেছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার আমরা যারা লিখি, দু-একজন বাদ দিলে প্রায় সবাই কোনও না কোনও পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত । পত্রিকা সম্পাদনা একজন কবিকে ব্যাপকভাবে সহযোগিতা করতে পারে। কারণ একজন কবিকে সর্বপ্রথম একজন সমালোচক হতে হয় । আর একজন সম্পাদককে সমালোচকের মন ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই পত্রিকা সম্পাদনা করতে হয় । তবে আমাদের অসংখ্য পত্রিকার মধ্যে কতজন সম্পাদকের এই দৃষ্টিভঙ্গি আছে সেটা একটা প্রশ্ন ।



বেশ কিছু পত্রিকা গোষ্ঠী বাজি ও সিন্ডিকেটের ক্ষুদ্র সংস্করণ হয়ে বসে আছে। আর এই সিণ্ডিকেট সফল সম্পাদকেরা গ্ল্যামারে ওজনে ও আয়তনে এক একটা পরোক্ষ প্রতিষ্ঠান । লিটল ম্যাগাজিনের নামে চলা এই সব শাখাপ্রতিষ্ঠানেপ্রাতিষ্ঠানিক বিষয়ই মূল আলোচ্য। ফলে প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকেরা গ্রাম্যতা দোষে দুষ্ট হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন। সেখানে চিরকালীন মেঘ ও রৌদ্রের খেলা। সেই খেলায় একজন প্রকৃত কবি ও একজন প্রকৃত সম্পাদক কখনও হারে না। তাদের পুরস্কার তোলা থাকে একটা ভাষা ভিত্তিক জাতির কাছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।



পত্রিকা সম্পাদনা আমাকে  শিখিয়েছে সৌজন্য ও সদ্ব্যবহার, সহিষ্ণুতা ও সহমর্মিতা, সংগ্রাম ও সৎসঙ্গের বিবেচনা শক্তি । মেরুদণ্ড সোজা রেখে রগ ফোলানোআপোসহীনতা । আর তার প্রভাব আমার কবিতায় পড়তে বাধ্য । একটি কবিতা,একটি কবিতা কেন্দ্রিক আলোচনা,প্রবন্ধ -নিবন্ধ পড়লেই বুঝতে পারি তাতে কত শতাংশ অরিজিনিলিটি আছে আর কত শতাংশ চালাকি । বলা বাহুল্য অন্ধ আনুগত্য, নির্বাক ও অন্ধ সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করার জন্য লেখা যখন হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তখন খারাপ লাগে। নিজের সাধনা ও শ্রমের দিকে তাকিয়ে থাকি। মনে হয় লিটল ম্যাগাজিন ও কবিতা লেখাকে কেন্দ্র করে যা আড়ম্বর ও উন্মাদনা সবই লোক দেখানো । বলতে বাধ্য হচ্ছি প্রায় সব কবিতার অনুষ্ঠানেই অসংখ্য ভালো কবিদের তুলনায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় একজন চতুর্থ শ্রেণীর সংগীত শিল্পী অথবা একজন তৃতীয় শ্রেণীর আবৃত্তিকারকে। বর্তমান সমাজে ছবি আঁকিয়ে থেকে শুরু করে আর সকল শিল্পীই দাবি করেন তাদের শিল্প মূল্যের, শুধু কবিদের কোনও অর্থের দাবি থাকে না। এইসব পরিস্থিতি সত্ত্বেও কবিরা লিখছেন। আমিও লিখছি। আমি জানি আমাদের লেখার ওপরেই বেশির ভাগ শিল্প নির্ভরশীল । তাই একজন কবি ও সম্পাদক হিসেবে বলব, কবি ও সম্পাদকগন আগে আত্মমর্যাদার দিকে তাকান। তারপর খ্যাতি, ক্ষমতা, আধিপত্য । আর আত্মমর্যাদাবিসর্জিত হলে বাকিগুলো চুন কালি ছাড়া আর কিছুই নয় ।
 





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বনিক

  উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বণিক উৎসবের আর মাত্র কয়েকটা দিন, একদম হাতে গোনা।  আর উৎসব  সংখ্যা ছাড়া উৎ...