এও তো এক ব্যালেন্সেরই খেলা
লেখক ও সম্পাদক শুভময় সরকার |
শুরুতেই বলে নিই একটু দ্বিধার মধ্যেই রয়েছি এ লেখা লিখতে গিয়ে। আমি কি সম্পাদকের মন দিয়ে ভাবব নাকি লেখকের মনন দিয়ে ! কোন ঘরে কত শতাংশ সত্ত্বা আমার? নাকি দুটোতেই সমানভাবে? যদি তাই হয়, সেটা কতটা সম্ভব বা বাস্তবসম্মত? দুটোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান কতটা কাল্পনিক?
হয়তো সম্ভব কিংবা সম্ভব নয়, ভাবতে গেলে দুটোই সত্যি এবং তা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তিতে আলাদা আলাদা। সেই কবে স্কুলবেলায় আমাদের অংকস্যার বাদলবাবু জ্যামিতি বোঝাতে বোঝাতে বলেছিলেন - সবই ব্যালান্সের খেলা, বুঝলে! এমনভাবে ব্যালান্স রেখে চলতে হবে যে শেষপর্যন্ত সব যেনো মিলে যায়। সেটা জীবনের ক্ষেত্রেও সত্যি...! তো সেই বাদলবাবু আর নেই কিন্তু স্যারের কথাগুলো আজও আমি মেনে চলি। জীবনের সব কিছুতেই আসলে ব্যালান্স করে চলতে হয় -সংসার, পেশা, কিংবা নেশা, যাই হোক না কেন।
ধান ভাঙতে শিবের গীত ছেড়ে বরং এবার মূল কথায় আসা যাক। প্রথম প্রশ্ন,আমি লেখকসত্তা এবং সম্পাদকসত্তার মধ্যে কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দিই! আমার উত্তর খুব সরাসরি এবং স্পষ্ট। স্বেচ্ছায় যখন দুটোকে বেছে নিয়েছি জীবনে, তখন কম আর বেশি বলে কিছু থাকা উচিৎ নয়। দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। এবং এটাও বিশ্বাস করি, আমার ক্ষেত্রে দুটো পারস্পরিক পরিপূরক। সম্পাদনা করতে গিয়ে আমার লেখা প্রভাবিত হয়েছে এবং লিখতে গিয়ে সম্পাদনাও অনিবার্যভাবে। এটা আমার পক্ষে লাভ ছাড়া ক্ষতি হয়নি। নানাভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পেরেছি, শিখতে পেরেছি এবং সর্বোপরি এক নিরন্তর পদ্ধতির মধ্যে নিজেকে জড়িয়ে নিতে পেরেছি।
বরং কিঞ্চিৎ বিস্তারে বলা যাক। কলেজ জীবনের শুরুর দিনগুলো তখন। লেখার ভাবনা সামান্য হলেও মাথায় খেলা করছে। যাদের সাথে আড্ডায় মশগুল থাকছি, তাদের মধ্যে অনেকেই তখন লেখক হিসেবে রীতিমত পরিচিত। মনের ভেতর নানানরকম প্রশ্ন কিলবিল করছে সে'সময়। পয়েন্ট -কাউন্টার পয়েন্টে নিজের মধ্যে দ্বন্দ্ব অহর্নিশ। ইতিমধ্যে পড়ে ফেলেছি অনেক কিছুই। মূলত বাংলাসাহিত্য হলেও কিছু কিছু আন্তর্জাতিক সাহিত্যও বটে। থমাসম্যানের Magic Mountain আর মিলারে Tropic of Cancer নিয়ে মেতে রয়েছি বন্ধুর দল। গদ্য নয়, লেখা শুরু করলাম কবিতা। শয়নে সপনে তখন কবিতা। এর অনেক অনেক পর গল্প নিয়ে কাজ। এখন লেখক হিসেবে সামান্য যা পরিচিতি, তা অবশ্যই গদ্যকার বা গল্পকার হিসেবেই।
এ তো গেল লেখক হিসেবে শুরুর কথা। আর সম্পাদনা করার ভাবনা কিন্তু ইউনিভারসিটি ক্যাম্পাসজীবনের সময় থেকে। দেওয়াল পত্রিকা 'ক্যাম্পাস'এবং 'প্যারাসাইট' দিয়েই শুরু। সে এক অদ্ভুত উন্মাদনার সময়...! একদিন সময়ের নিয়মে শেষ হলো ক্যাম্পাসজীবন এবং তার ঠিক পর পরই সম্পাদনার সেই প্রবল ইচ্ছেটা জোরদার চেপে বসল। বলাইবাহুল্য,তারপর 'মল্লার'-এর হাত ধরেই সেই ইচ্ছের বাস্তবায়ন। সত্যি বলতে কী, এই এতটা পথ পেরিয়ে এসে আজ আমার লেখকসত্ত্বা এবং সম্পাদকসত্ত্বা মিলেমিশে একাকার।
শুরুতেই যে কথা বলছিলাম, সে কথাতেই বরং ফিরে যাই আবার। বলি সামান্য অন্যরকম কিছু কথাও, মানে বাস্তব সমস্যার কিছু কথা, টানাপোড়নের কিছু কথা, দ্বিধা-দ্বন্দ্বের কিছু কথা। যেহেতু লেখালেখি এবং সম্পাদনা দুটোতেই সমগুরুত্ব আরোপ করেছি, তো সেক্ষেত্রে দুটোতেই মনোযোগ দিতে গিয়ে কিছু বাস্তব সমস্যা হয় অনিবার্যভাবেই। একজন লেখকের তার লেখার প্রতি যতোটা মনোনিবেশ করা প্রয়োজন, ততোটা না করতে পারলে সেটা লেখার প্রতি এবং লেখক হিসেবে নিজের প্রতি সুবিচার নয়। সেই সুবিচারটা বোধহয় অনেক ক্ষেত্রেই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, কারণ সঠিকভাবে, নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় যদি একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতে হয়, সেক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় দেওয়া জরুরি, নইলে কেবলমাত্র পত্রিকা করার জন্য একটি পত্রিকা করা অর্থহীন। দু'মলাটে চেয়েচিন্তে নেওয়া কিছু লেখা পিন-আপ করাকে সম্পাদনা বলতে আমি রাজি নই। সম্পাদকের এবং সম্পাদকমন্ডলীর কিছু ভাবনা, পরিকল্পনা থাকে। সে ভাবনায় এগোতে হলে অনেকটাই সময় দেওয়া জরুরি। লুজ ভাবে কিছু হয়না, কমিটমেন্ট খুব জরুরি। তাই সেই ইংরেজি কথাটা বলতেই হয়, Both ends meet, মানে সেই ব্যালেন্সটা রাখা খুব খুব কঠিন। এটাই সবচেয়ে প্রধান সমস্যা।
তবু আমি প্রথমদিনের মতো আজও বিশ্বাস করি-ভালোবাসা এবং টান যদি অমোঘ হয়, তাড়না যদি অন্তর্গত রক্তের ভেতর খেলা করে, তবে ব্যালেন্স করা সম্ভব। অসম্ভব বলে কিছু নেই, সব সম্ভব।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন