আমার অস্তিত্ব ও যাপনকথার তানাবানা
লেখক ও সম্পাদক গৌতম গুহ রায় |
‘দ্যোতনা’র কথা প্রসঙ্গে আসে নানা কথার নক্সিকাথা । বিষয়টা যখন লিটল ম্যাগাজিন, তখন এক ভিন্নধারার সৃজনের বেগবান স্রোতের কথাই হবে প্রাথমিক উচ্চারণ। এই উচ্চারণের সূচনায় জীবনানন্দকে স্মরণ করা যাক, তাঁর কথায়, “... কিন্তু আসলে প্রশ্ন হচ্ছে ভিড়ের হৃদয় পরিবর্তন হওয়া দরকার, কিন্তু সেই পরিবর্তন হবে কি কোনো দিন ? ... যখন দেখি তথাকথিত সভ্যতা কোনো এক দারুণ হস্তীজননীর মতো যেন বুদ্ধিস্খলিত দাঁতাল সন্তানদের প্রসবে প্রসবে পৃথিবীর ফুটপাথ ও ময়দান ভরে ফেলছে তখন মনে হয় যে কোনো সূক্ষ্ণতা, পুরোনো মেদ ও ইন্দ্রলুপ্তির বিরুদ্ধে যা, পুরোনো প্রদীপকে যে অদৃশ্য হাত নতুন সংস্থানের ভিতর নিয়ে গিয়ে প্রদীপকেই যেন পরিবর্তন করে ফেলে; তার এই সাময়িকতা ও সময়হীনতার গভীর ব্যবহার যেন মুষ্টিমেয় দীক্ষিতের জন্য শুধু, সকলের জন্য নয় – অনেকের জন্য নয়”। কবির এই আর্তি শুধু কবিতার জগৎ নয় সাহিত্যের সমগ্রতার কাছেই এক ধ্রুব সত্য । এই চেতনার আলোড়ন থেকেই জন্ম নেয় স্বতন্ত্র ও আপোষহীন এক সৃষ্টির শতজল ঝর্না, লিটল ম্যাগাজিন সেই ঝর্নার ধ্বনি ।
হিমালয় সন্নিহিত এই বাংলার এক লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক তাঁর সম্পাদকী লিখে ফেলেন, “স্বাধীনতার সুরই প্রকৃত লিটল ম্যাগাজিনের সুর। প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের সুরের সে আত্মীয়”। এই শ্বাশত ঘোষণাই সূচিত করে আর এক যুদ্ধের । এভাবেই সটান ও ঋজু বাঁশের মাথায় সে ঝুলিয়ে দেয় লিটল ম্যাগাজিনের অবিনশ্বর ঝান্ডা । ওই ঝান্ডার প্রতি অনুগত থেকেই আমাদের পথচলা । এই চলতে চলতে আসা। আমাদের এই যৌথ পথচলার আজ চার দশক অতিক্রান্ত । আমরা চেতনায় ও ঐতিহ্যে আমাদের এই তিস্তা বঙ্গের প্রতিবাদী ও স্বাতন্ত্রের ঐতিহ্য । ১৮৯৫-৯৬, প্রায় একই সময়ে কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি থেকে দূটো সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিলো । কোচবিহার থেকে ‘কাঙ্গাল’ আর জলপাইগুড়ি থেকে ‘ভিক্ষুক’ । দুটোই দ্রুত বন্ধ হয়ে যায়, রাষ্ট্র ও পুঁজির সাথে পেরে ওঠা সহজ ছিলো না । ‘রাষ্ট্র’ নামের প্রবল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে, ক্ষমতা নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিরোধের এই পরম্পরা আমরা শ্রদ্ধায় স্মরণ রাখি। আমরা জানি ও মান্যকরি লিটল ম্যাগাজিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তার প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা। সেই পারে আত্মসম্মানকে আয়ুধ করে গতানুগতিকতাকে আক্রমণ করতে ।
আমার প্রসঙ্গে আসি এবার। শৈশবে আমাদের যৌথ পরিবারের পরিবেশ আমাকে সাহিত্য চর্চার দিকে টেনে নিয়ে যায় । আমার জ্যাঠতুতো দাদা সেই সময় ‘অজানা’ বলে একটি সাময়িক পত্র প্রকাশ করতেন, আমাদের বাড়ি থেকেই । ১৯৭২-৭৩ থেকে পঞ্চাশ বছরের বেশী টানা সেটি চালু ছিলো, এখনও বেরুচ্ছে । সেখানেই আমার কবিতা, ছড়া লেখা প্রথম, ১৯৭৪ । তারপর ‘দৈনিক বসুমতী’র ছোটদের পাতায় । কিন্তু সেই আধো-আধো ব্যাপার থেকে ছিটকে এসে কাগজ করা ১৯৭৯ । সেই সময় জলপাইগুড়ি শহর সাহিত্য, কবিতা নিয়ে একটু ভিন্ন ধারায় ভাবছিলো । ছিলেন শামসের আনোয়ার, সমর রায়চৌধুরী ও ‘ক্রুশেড’, বিজয় দে ও ‘পাগলঘোড়া’। আমরা, গয়েরকাঁটার বিকাশ সরকার, কোচবিহারের নকুল মন্ডল, মাথাভাংগার সুব্রত রায়, আলিপুরদুয়ারের তনুময় সরকার, শিলিগুড়ির কিশোর সাহা-র মতো কয়েকজন কবিতা ও লিটলম্যাগাজিন নিয়ে উন্মাদনায় জড়িয়ে থাকা সমবয়সী কাঁধে কাঁধ রাখালাম । আমাদের সামনে অরুনেশ ঘোষ, সমর-বিজয়-শ্যামল, বন্ধুর মতো সঙ্গে পেলাম মনোজ রাউত, দিবাকর ভট্টাচার্য, রাজা সরকার, শিশির রায়নাথ, সমীরণ ঘোষ, পূণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত প্রমুখদের । মতের মিল-অমিল অতিক্রম করেও প্রশ্রয় পেয়েছি হরেন ঘোষ, তুষার বন্দ্যোপাধায়, সমীর চক্রবর্তী, অজিতেশ ভট্টাচার্য-র মতো অগ্রজদের । লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের উন্মাদনায় আমার কবিতা যাপন মিলেমিশে যায় । এর কিছুদিনের এদিক ওদিক, এই অঞ্চল থেকে তারুণ্যের সম্পাদনায় প্রাতিষ্ঠনিক স্থিতাবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে প্রকাশিত হচ্ছিলো, বিকাশের ‘যখন তখন’, ‘থাবা’, আমাদের ‘দ্যোতনা’, সুশান্তের ‘যুদ্দগযাত্রা’। শোভনের ‘সময়সূত্র’, তনুময়ের অকবিতার কাগজ’, কিশোরদের ‘কনসেন্ট্রেশান ক্যাম্প’ মনোজদার ‘ধৃতরাষ্ট্র’, দিবাকরের ‘সময়গুরু’, কৃষ্ণপ্রিয়র ‘তিস্তা বাজার’, কিছুদিন পরে শুভময় সরকার এলো, প্রকাশ করলো ‘মল্লার’ । ব্যাক্তি আমি তখন অপ্রাসঙ্গিক, আমাদের সামনে জ্বলজ্বলে পোস্টারে লেখা কমল মজুমদারের কথা ‘ভাষাকে যে আক্রমণ করে সেই ভাষাকে বাঁচায়’, ফকনারের কথা, ‘হাতেতে হাত কাঁধেতে কাঁধ লাগুক, না হয় এই হাত চেপে বসুক টুঁটিতে তোমার’ বা ‘একদিন অসময়ে তোর বুকের হাড়, চোখ মুখ ফেটে বেড়িয়ে আসুক” । আমাদের সবল ঘোষণা ছিলো ‘আমরা পণ্যসংস্কৃতি, নেকা সংস্কৃতির বিপক্ষে, আমরা চাই পাঠক উপলব্ধির সেই স্তরে পৌঁছবেন যখন তিনি নিজেই নিজের অবস্থানকে ভাঙতে শুরু করবেন । যখন ভাড়াটে কলমজীবিদের মাধ্যমে সর্বস্তরে গণমাধ্যম ও সাহিত্যপত্রগুলো শোষণ ও শাসন বজায় রাখার যন্ত্র হয়ে উঠছে, তখন, এই শ্বাসরোধকারী অবরুদ্ধ অবস্থার বিরুদ্ধে আমরা । সেই সময়, এই সময়, আমাদের মতো যারা এই অবস্থার সাথে কম্প্রোমাইস করতে চায় নি তাঁদের অনেক প্রতিবন্ধকতা এসেছে, অসুবিধা হয়েছে । বিজ্ঞাপন বিমুখ, জন-ক্রেতা বিমুখ একটি লিটল ম্যাগাজিন বাঁচিয়ে রাখাটাও ছিলো যুদ্ধ, ঘাম-রক্ত দিয়ে সেই যুদ্ধযাত্রা । আমরা একবার রক্ত বিক্রি করে ছিলাম, একবার আমার এক বন্ধু হাতের আংটি বিক্রি করে দিলো, প্রেসের বিল মিটাতে । বাসে, বাস স্ট্যান্ডে, বইমেলার মাঠে চিৎকার করে পত্রিকা বিক্রি করাটাও সেই সময় ছিলো আমাদের এই যুদ্ধ যাত্রার অংশ । আজ যা নিছকই কেবল স্মৃতি ।
আজ অন্তর থেকে একটা কথা কই, সেই সময়ের কথা ভাবলে মনটা বিষন্ন হয়ে পরে, স্বপ্নের আকাশটা মিথ্যা ছিলো মনে হয়, আপোষকামী দূর্বত্ত আমাদের আকাশ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে ।
‘দ্যোতনা’ এই ৪২ বছরে এসে বৃদ্ধের মত, লোল চর্মসার, আর সেই আগের মত চিৎকার করে ভাঙ্গনের পাল্টা রুখে দাঁড়ানোর তেজ খুঁজে পায় না । তাই পুরোনো দিনের স্মৃতিতেই বুঁদ হয়ে থাকতে চাই । পুরোনো সংখ্যার সম্পাদকীয় থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি ঃ
ক) যুদ্ধের-হত্যার-ধর্ষণের এক প্রায় ভৌতিক ও সীমাহীন অন্ধকারের শতক অতিক্রমণের পথে আমরা, রাজপথে যুবকের পচাগলা লাশ, অদ্ভূত বেয়নেট ও বমন-উতসব, অতিক্রম ক’রে চলেছি শহর সত্যতার নামে এক কুচ্ছিত বেশ্যা প্রজন্ম আর অতিক্রম করে চলেছি, খুব শ্লথ, আমরা নিজেদেরই... (১০৮৩)
ক) চারপাশে লোলুপ নিয়ন, কলরোলময় যুবতীর চলাফেরা, খুনী ও লম্পট, আপাদমস্তক লুম্পেন, পুলিশ ও কুকুর, ধর্মের নামে অনন্ত জোচ্চুরি, অনুপম হিজরেমি, দপ দপ করে জ্বলে ওঠা নিরোধের বিজ্ঞাপন... এ সমস্তই, হঠাৎ, এই প্রখর গ্রীষ্মে, ঢুকে পড়ে আমাদের ঘিলুর মধ্যে... যেমন ইনডং চা বাগানে হঠাৎ বেজে ওঠে গভীর মাদল, তার দ্রিম দ্রিম ... মানসাইতে বিক্ষুব্ধ জলপতনের শব্দ ও জেলেদের গান... যেমন দিনবাজারে- বেগুনটারিতে আম, কলা , লিচুর খোসার সাথে জেগে ওঠা জারজ শিশুর কান্না- আর্তচিৎকার ... যেমন নাগ্রাকাটা থেকে কিনে আনা মুর্গির শেষ কণ্ঠস্বরের সাথে মিশে যাওয়া একদল পিকনিক মুখর ছাগলের ম্যা ম্যা ... তেমনি আমরা আজ অনায়াস আক্রান্ত- আক্রান্ত সেই নৈরাজ্য দ্বারা... পাঠক, সেই চারপাশে লোলুপ নিয়ন, কলরোলময়...
সুতরাং, হে পাঠক , এইবার আমাদের এই রক্ত বমন ( যা কিনা একসাথে কুচ্ছিত, যন্ত্রণাদায়ক ও আস্বস্তিকর...) আপনি লক্ষ্য করুন – (১৯৮৪)
৩) ... এক ভৌতিক বিষাদ আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছে ।.. এখানে জরুরী অবস্থা আবার বাহবা পায়। সামরিক খাতে ব্যয় বারে, এখানে বছরের পর বছর ধরে আন্দোলন চলে স্বদেশের বাসিন্দাদের ‘বিদেশী’ প্রমাণের, ভাইয়ের রক্তে হাত রাঙিয়ে আর এক ভাই করে পৈচাশিক উল্লাস, ‘বন্দে...’ । তবুও আমরা কবিতা লিখি, গল্প লিখি । এই ভৌতিক বিষাদেও আমরা পুনঃ পুনঃ সত্যর মুখোমুখি হই । (১৯৮৫)
৪) ... শয়তান ও ভন্ডের খাবার টেবিলে আমাদের দেশ ও দেহ । আমরাই ব্যবহৃত হচ্ছি জ্বালানি হিসাবে, মশলা হিসাবে, পরিচারক আমরাই । আমাদের ব্যবহার করা হচ্ছে নিষ্টুর যন্ত্রের থেকেও ব্যাপক ভাবে । এক নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, অবশ্যম্ভাবী এই এগিয়ে যাওয়া । নেলী বা ভূপালের গণহত্যার বর্ষপূর্তি হয় আবির ও পায়রা উড়িয়ে । লাল কার্পেট পেতে আবাহন করি, পোপ আসেন, প্রসাদ দেন, লক্ষ টাকার বাঁজী পুড়ে... ভাত শিকারে ব্যস্ত তোমাকে কুরেকুরে নিঃশেষ করুক এই সময়... । (১৯৮৬)
৫) ...এক দগ্ধ প্রান্তরের ভেতর দিয়ে ছুটছি আমরা, ত্রস্ত অশ্বারোহী, এই সময় চারদিকে উড়ছে ভস্ম ছাই, দৃষ্টিপথেও প্রতিবন্ধকতার ধূসর পর্দা। এর মধ্যে দিয়েই আমাদের আলোর পথে যাত্রা। আমরা এই যাত্রায় পাঠকের সাহচর্য চাই, আসুন এক আলোকিত ভোরের ছবি আঁকি।(২০১৬)
লিটল ম্যাগাজিন কর্মী আর একজন কবির সত্তার মাঝে কি বিরোধ থাকে? আসল ব্যাপারটা দৃষ্টিভঙ্গির । আমরা এই ‘সংস্কৃতি চর্চা’কে কিভাবে দেখি । যখন আমি নার্সিসাস হয়ে তাকাই নিজের সৃষ্ঠির দিকে তখন শুরু হয় আত্মপ্রবঞ্চনার সমাপ্তীহীন যাত্রা । কিন্তু যদি একজন সামাজিক মানুষ হয়ে মানুষের কান্না–হাসি, তাঁর দৈনন্দিনের অপমান, অসহায়তা, এবং আমার শেকড়ের আর্তনাদ, রূপ গন্ধ সবকিছু নিয়ে এই যে আমার পরিমন্ডল তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকলেই কোনো আত্মপ্রবঞ্চনা থাকে না । এই অবস্থান থেকেই একজন কবি, একজন চিত্রশিল্পী, একজন নাট্যকর্মী, একজন লিটল ম্যাগাজিন কর্মীর অন্তঃসম্পর্কের সূচনা হয় । এই সম্পর্কের সুতোতেই বাঁধা থাকতে চাই, তাতে একটা দুটো কবিতা লিখলাম কি লিখলাম না কিচ্ছু যায় আসে না ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন