সংঘাতে সংযোগ : সম্পাদনা ও ব্যক্তিগত-লেখালিখি
এ কথা সত্যি
যে, পত্রিকা সম্পাদনার জন্য
বেশ কিছুটা সময়
যায়, কিন্তু সম্পাদনার জন্য
ব্যক্তিগত লেখালিখির ক্ষতি
হয়েছে এটা বলা
ঠিক নয় আমার
পক্ষে। আমার লেখালিখির সূচনা
এবং আমার সম্পাদিত বলাকা
পত্রিকার আত্মপ্রকাশ প্রায়ই
একই সময়ে, নব্বই-এর শুরুতে। সেই
সময়ে মূলত কবিতা
লেখা দিয়েই ব্যক্তিগত লেখালিখির সূচনা,
পত্রিকা প্রকাশ ও
সম্পাদনাও তখন চলছে।
তখন মনে হতো
না যে, সম্পাদনার জন্য
সময় চলে যাচ্ছে
বা সম্পাদনার সময়টি
নিজের লেখায় ব্যয়
করলে ভাল হতো।
কারণ, তখন লেখালিখি প্রায়
শখেই করা হতো,
দু-একটি পত্রিকায় পাঠানো
ছাড়া সে রকম
আর তেমন কোনো
কাজ ছিল না।
অবশ্য ওই সময়টাই
পড়ার সময়, সমকালের সাহিত্য সেই
সময়েই হাজির হয়েছিল
পড়ে নেবার জন্য।
অত্যন্ত সাদা-মাটা
পত্রিকা বের করতাম
তখন। ধীরে ধীরে
নিজের লেখালিখির পরিধি
সামান্য বড় হলো,
উপন্যাসে হাত দিয়েছিলাম, পরপর
বেশ কয়েকখানা উপন্যাস লিখেছিলাম, পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদনা। পত্রিকাটি তখন
ফর্মা তিন-চারেকের হতো
বড় জোর। কবিতা,
প্রবন্ধ, গল্পের কাগজ
ছিল বলাকা। পুশ
সেল করতে হতো,
পাতিরাম থেকে বিক্রি
হতো না বললেই
চলে।
২০০৫ থেকে বলাকা
পত্রিকার চরিত্র ক্রমশ
বদলাতে থাকে। বিশেষ
সংখ্যার দিকে ধীরে
ধীরে সরে যায়
ভাবনা। ২০০৭-এ
সম্পাদনা করলাম কাঙাল
হরিনাথ মজুমদারকে নিয়ে
বলাকার বিশেষ সংখ্যা। বলা
যায়, ওটাই বলাকার
টার্নিং পয়েন্ট। তারপর
থেকে গল্প-কবিতার
কাগজটি হয়ে গেল
বিশেষ সংখ্যার ক্ষেত্র। এবং
এটাও ঠিক করে
নিয়েছিলাম যে, যে-বিষয় নিয়ে
কাজ প্রায় হয়
নি, সেই ভাবনা
থেকেই কাগজ করতে
হবে। তার জন্য
চাই নিজের প্রস্তুতি। পড়তে
হবে প্রচুর। বিজ্ঞানের শাখা
থেকে সাহিত্যে এসেছি
বলে প্রায় সবটাই
পড়তে হয়েছে নিজের
উদ্যোগে। তাহলে সম্পাদনা করতে
এসে বা বিশেষ
সংখ্যা প্রকাশ করতে
গিয়ে প্রচুর সময়
চলে গেল অজানা
বিষয় জানতে। সম্পাদনা আমায়
ক্রমশ শিক্ষিত করে
তুললো। আর এই
সব পড়াশোনার প্রভাব
পড়লো নিজের লেখায়
বা সেই সব
অনুসন্ধান আমার নিজের
লেখার বিষয় হয়ে
চলে এল।
আমি এই অবকাশে
আমার সম্পাদনায় বলাকা
পত্রিকার বিশেষ বিশেষ
সংখ্যার একটি তালিকা
তুলে ধরতে চাই,
তাতে আপনারা বলাকা
সম্পর্কে একটা ধারণা
পাবেন হয়তো। কাঙাল
হরিনাথ সংখ্যার পর
একে একে বেরলো
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সংখ্যা,
বাংলা বই ও
ছাপাখানা, প্রাক-স্বাধীনতা কালখণ্ডে বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা, নাট্যব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ, প্রাক-স্বাধীনতা সময়সীমায় নবচেতনায় বঙ্গনারী, রবীন্দ্রোত্তর বাংলা
কবিতা, আমাদের রাষ্ট্রপতিঃ এক
অনন্য বাঙালি, প্রাক-স্বাধীনতা সময়ে
বাঙালির শিশু-সাহিত্য, রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র, বাঙালির লোকসাহিত্য, বিষয়
বাংলাদেশঃ সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতি।
একেবারে সব কিছু
নিমেষে পালটে গেল
হরিনাথকে নিয়ে করা
সংখ্যা থেকেই। যে-পাতিরাম থেকে
পত্রিকা প্রায় যেতই
না, সেই পাতিরাম থেকে
নিমেষে উড়ে যায়
কয়েকশো বলাকা। খুব
সংক্ষিপ্ত আকারে যখন
বলাকার নামটুকুই শুধু
উল্লেখ থাকতো দৈনিকের পত্রিকা আলোচনার কলামে,
সেই সব দৈনিকের আলোচনার সিংহভাগ জায়গায়
এসে গেল বলাকার
আলোচনা।
বুঝতেই পারছেন বিশেষ
সংখ্যার তালিকা ও
বিষয় থেকে যে,
বলাকার একটি সংখ্যা
প্রকাশের সঙ্গে কী
পরিমাণ সময় ও
পরিশ্রম ব্যয় করতে
হয় আমাকে, সেটা
প্রেস-ছাপা-প্রুফ
বা বিষয় অনুযায়ী উপযুক্ত লেখকের
সন্ধান করে লেখা
আদায় হোক বা
সেই বিষয় নিয়ে
নিজের পাঠজগতকে সম্পাদনা ভাবনার
আগে সমৃদ্ধ করাই
হোক।
হ্যাঁ, সময় যায়
এই কাজের জন্য
প্রচুর। তাই এখন
বছরে একটি সংখ্যাই বেরোয়।
আর সম্পাদনা আমায়
ফিরিয়ে দেয় অনেক
কিছু। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি
কথা জানাই, বলাকা
ভারত সরকারের CIIL গ্রান্ট পেয়েছে
দু-বছর। আর
বাঙালি রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে
নির্মিত সংখ্যাটির প্রকাশ
হয়েছিল রাইসিনা হিলসে
রাষ্ট্রপতি ভবনে মাননীয়
প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাতে
তুলে দিয়ে। এ
ঘটনা সম্পাদনার বিরলতম
প্রাপ্তি, এমনকী লিটিল
ম্যাগাজিন দুনিয়ায় অন্যরকম এক
খবরও বটে। তেমনই
যখন কলকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল
বা সাহিত্য অকাদেমির সঙ্গে
যৌথ ভাবনায় অনুষ্ঠান হয়,
তখন মনে হয়
চলে যাওয়া সম্পাদনার সময়
ফিরিয়ে দেন ভিন্ন
কিছু স্বাদ। বা
যখন উত্তরায়ণের ঐতিহ্যমণ্ডিত উদয়ন
সভাঘরে বিশ্বভারতী-র
সহযোগিতায় বলাকার প্রকাশ
ঘটে, তখন মনে
হয় আরও অনেক
সময় ব্যয় করা
যায়, এখনো অনেক
সময় ব্যয় করতে
হবে নতুন কাজের
জন্য।
সম্পাদনার পাশাপাশি নিজের
লেখা যেমন চলেছে,
তেমনি ভারত সরকারের সিনিয়র
ফেলোশিপ পেয়ে দু-বছর ধরে
বড় আকারে গবেষণাও শেষ
করেছি বেসরকারী সংস্থার কর্মী
হয়ে। তখনও বলাকা
বেরিয়েছে। সম্পাদনার ফাঁকে
দৈনিক নিউজ বাংলা
এবং সংবাদ নজর-এ বছর
দেড়েক সাপ্তাহিক কলাম
লিখেছি, সাধনা বাংলা
চ্যানেলে ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ অনুষ্ঠানেও বছর
খানেক আলোচক হিসেবে
থেকেছি প্রায় সপ্তাহেই, প্রচুর
শ্রুতিনাটক লিখেছি, শতাধিক
নাট্যদল সেই সব
নাটক নিয়মিত মঞ্চস্থ করে
চলেছে, নাটকের বই
বেরিয়েছে পরপর, আর
এর সঙ্গেই পরিবেশ
বিজ্ঞান নিয়ে বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
চর্চাও চলেছে সমান
তালে। তার সঙ্গে
প্রচুর আড্ডা, মদ
খাওয়া, উইকএন্ড করা।
আসলে যে কাজ
করে সে সময়
পায়, এটাই আমার
ধারণা।
সম্পাদনা ও নিজস্ব
লেখার ভিতর সংঘাত
নেই কোথাও, একে
অপরকে কাজের দিকে
ঠেলে দেয়। সম্পাদনা না
করলে লেখার জীবন
অসম্পূর্ণ থাকে বলেই
আমার মনে হয়।
বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ থেকে
সুনীল অবধি সবাই
প্রায় সম্পাদনা করেছেন
নিজস্ব সৃষ্টির পাশাপাশি।
এ সবই প্রাপ্তি। সম্পাদনা আসলে
একটা নেশার মতো।
নিজের টাকা চলে
যায়, লেখা নির্বাচন নিয়ে
ঝগড়া-ঝামেলা হয়ে
যায়, বাড়িতে অশান্তি হয়,
নিজের লেখার সময়
ঢুকে যাবার পর
একটি সংখ্যার প্রকাশের সময়
সব মুছে যায়,
মনে হয় পরের
সংখ্যা কী নিয়ে
হবে আর আমার
নিজের লেখার নতুন
ভাবনাই বা কী
হবে এবার...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন