লেখক-সম্পাদক-লেখক : এক রঙীন অভিযাত্রা
লেখক ও সম্পাদক
প্রণব চক্রবর্তী
|
১। ধুলো পায়ে বহুদূর যাওয়ার কথা ছিলো। কতদূর জানা না থাকলেও কাদাপায়ে সামনের স্পষ্ট সব ছাপ দেখতে দেখতে আরও জোর, আরও ব্যতিক্রমী ছাপ ও ছোপ্পড় রেখে বাল্মীকি যেহেতু হওয়ার সুযোগ নেই, ভেবেছিলুম অন্তত বাংলাভাষার শেষ কবিতাটা লিখে রেখে কালোত্তীর্ণ হিরো হব অন্য কোনও সভ্যতা সমীপে। ধ্যুর, সব ঢপ । পেছনেই দেখলাম পিলপিল করে নতুন কবিদের মিছিল উঠে আসছে, শুধু তাই নয় তারও পেছনে নতুনতমদের আরও এক তরংগ ইত্যাদী। প্রবহমান এক ঢেউযাত্রা।অতএব শেষ কবিতা লেখার অধিকার থেকেও স্পষ্টত প্রতারিত হতে হচ্ছে প্রাকৃতিক নিয়মতান্ত্রিকতারই অবধারিত ফলশ্রুতি বিবেচনায়। কারণ আমি ফুটে যাবার পরেও এই কাব্যরচনার প্রবহমানতা আপাতত সংরক্ষিত চোখের ওপরেই দেখতে পাচ্ছি ওই পেছনের, তার পেছনের, তারও পেছনের মিছিলের কাব্যফুর্তিতে ডগমগ পরবর্তী কবিদের নবীন চিবুকের ভাঙাচোরা দাগ ও দাম্ভিকতায়, যা কিনা আমারই স্বভাবের প্রতিলিপি। অতএব মিশন শেষ কবিতা নির্মাণে ঢ্যাড়া। এই সুযোগেরও বহু মালিকানা, চিৎকার ও কোলাহল দুইই বেশ সুচারু, সুলক্ষ্মণা, গৃহকর্মে নিপুণা নব নব অংশীদারিত্বের সমারোহে উজ্জ্বল। সুতরাং চলো গোসাই অন্য ডালে ফুটি।
২। এই ফুটিত হইবার বাসনা হইতে আটের দশকেই কবিতা চর্চার পাশাপাশি সবাই মিলে একটা পত্রিকা করবার বাসনাও তীব্র হয়ে উঠেছিলো। সাল ১৯৮৫ । কৃষ্ণনগর থেকে নবদ্বীপ ফেরার পথে বাসে বসেই আমি আর কবি সোমেন ভট্টাচার্য কবিতা বিষয়ক আলোচনার মধ্যেই পত্রিকা প্রকাশের এক বিশেষ বাসনায় ঘণীভূত হয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম পত্রিকা করতে হবে। আর শুধু ভাবাই নয়, একেবারে একটা নামও ঠিক করে ফেলা হলো--- ঋদ্ধ। অতঃপর নবদ্বীপ ফিরে প্রথমেই হাতের কাছে যাকে পাওয়া গেল সে গৌতম হেঁস। পরবর্তী দু-তিন দিন ধরে নবদ্বীপ শহরের আমাদের সমবয়সী বন্ধুবান্ধব যারা কবিতা লেখে, ছবি আঁকে একসাথে বসে পত্রিকা প্রকল্পটি
আমরা প্রকাশ্যে আলোচনা করলাম। সবাই রাজী কিন্তু কারোরই দেবার মতো টাকা নেই। যাদের আছে তাদের না দেবার সপক্ষে লম্বা যুক্তি। আমাদের টীম তখন চমকানোর মত। ছোট শহরের এই তরুণেরা একেকটা লকেট যেন। লড়াইয়ের অংশীদার বর-বউ উভয় শিক্ষক কবি চন্দন দত্ত। ইনি অরুণ বসু সম্পাদিত অজ্ঞাতবাস পত্রিকার সৈনিক ছিলেন, স্কুলের মাইনে পেয়ে সব নাকি বউয়ের হাতে তুলে দেন। টাকা দিতে না পারলেও শ্রম দিতে জুড়ী নেই । পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে হিসেবি মানুষকে ধরে ধরে সস্তার কবিতা পত্রিকা বেচে দেবার বালক-আত্মা এতটাই কবিতা-প্রবণ। আমাদের সাথে বন্ধুত্বেও তাই দাদাত্ব উবু হয়ে বন্ধুত্বটাই প্রাধান্য পেয়েছিলো। চন্দন দত্তের গল্প পরে করা যাবে। অন্য বন্ধুরা ছিলো জয়মংগল সাহা উকিল সম্প্রতি প্রয়াত , মৃণালেন্দু দাস ছবি আঁকিয়ে ও স্কুল শিক্ষক, প্রদীপ আচার্য চিত্রশিল্পী ও কবি বেশ কিছুদিন হলো নিজেকে নির্বাপিত করেছে কড়িবর্গায়, মদন গোপাল সাহা চিত্রশিল্পী, তারকেশ্বর ভাদুড়ী চিত্রশিল্পী, প্রদীপ রায় প্রথম জীবনে সৈনিক পরে উকিল তারওপর জীবনবীমা নিগমের এক্স-সার্ভিসম্যান চাকরি। অর্থাৎ, ঋদ্ধ পত্রিকার প্রকাশকালে নবদ্বীপের যে কবিজনেরা সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন--- চন্দন দত্ত, গৌতম হেঁস, সোমেন ভট্টাচার্য, প্রদীপ আচার্য, প্রণব চক্রবর্তী এবং কখনও কখনও লিখতেন মৃণালেন্দু দাস ও জয়মংগল সাহা। পত্রিকা চালাতে গেলে যেহেতু একজন সম্পাদক এবং প্রকাশকের নাম প্রয়োজন হয়, শর্তসাপেক্ষে সোমেন ভট্টাচার্য সম্পাদক এবং প্রণব চক্রবর্তী প্রকাশক হিসেবে নাম ব্যবহারে সম্মত হওয়ায় প্রথম সংখ্যা থেকেই সে কাগজ রুচি ও নির্বাচনে আদ্যন্ত এক ভালো লিটল ম্যাগাজিনের প্রশংসা পেতে শুরু করেছিলো। উল্লেখযোগ্য একটি চিঠির কথা না বললে, তথ্যপ্রদান অসম্পূর্ণ থাকবে, সমর সেন তখনও জীবিত, আমাদের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সমর সেন-এর লেখা আমরা ছাপব। সম্পাদক হিসেবে সোমেনের দায়িত্ব চিঠি দেওয়া, চিঠি দিল, তার কয়েকদিন পরেই সোমেন একটি খাম হাতে নিয়ে আমাদের সান্ধ্য আড্ডায় এলো, ওর হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিয়েই পড়তে শুরু করলাম সেই চিঠি। হ্যাণ্ডমেড কাগজের কবির নামখোদাই প্যাডে নিব পেনের কালিতে লেখা তিন-চারটি পংক্তির সেই মূল্যবান পত্রের দুটি লাইন এখনও ভুলতে পারিনি, যেখানে তিনি স্পষ্ট বাংলায় লিখছেন--- "আমি এখন কবিতা লিখতে পারছি না। হয় কবিতা আমাকে ছেড়ে গেছে কিংবা আমি কবিতাকে ছাড়িয়ে চলে এসেছি ।" এ প্রসংগে একটা তথ্য দিয়ে রাখি, জীবনের শেষদিকে এসে আমৃত্যু ইংরিজী ভাষায় 'Frontier'পত্রিকাটি কিন্তু তিনি সম্পাদনা করে গেছেন। পত্রিকাটি ভারতবর্ষের চারদিকে ঘনিয়ে ওঠা অর্থনৈতিক স্বাধীনতার লক্ষ্যে যে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড শুরু হয়েছিল, সেই কর্মকাণ্ডেরই এক বিশ্লেষণাত্মক স্বাধীন মুখপ্ত্র। যাই হোক, আমাদের সেই চিঠি পর্বের বছর খানেকের মধ্যেই সমর সেন প্রয়াত হন। ব্যতিক্রমী গদ্যকার উদয়ন ঘোষের বেশ কয়েক্টি লেখাও আমরা সেই সময় পত্রিকায় সংযুক্ত করতে পেরেছিলাম, তিনি আমাদের গ্রহণ করেছিলেন আন্তরিক ভাবেই। তার প্রমাণ পেয়েছিলাম, একটি সংখ্যা প্রকাশের আগে হঠাৎ হাতে পৌছলো উদয়ন বাবুর একটি এনভেলপ, খুলতেই একটি চিঠি ও দুটি কবিতা। প্রসংগটি উল্লেখ করছি চিঠির একটি পংক্তি পাঠকের সংগে শেয়ার করতেই। চিঠির একটি অংশে উনি লিখছেন--- "গদ্যটাই আমি লিখি কিন্তু মাঝে মাঝে গাণিতিক হবার জন্য কবিতা লিখতে হয়"। প্রসংগত সে সংখ্যয় উদয়ন ঘোষের পাঠানো দুটি কবিতাই আমাদের ছাপতে হয়েছিল বিখ্যাত মানুষের ব্যক্তিত্বের চাপে নত হয়ে নয়, তার লেখা দুটির নান্দনিক উৎকর্ষের স্বীকৃতি হিসেবেই । তো সে ছিল আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে পত্রিকা সম্পাদনার এক যুদ্ধক্ষেত্র । যে যেখান থেকেই লেখা পাঠাক না কেন আমাদের সান্ধ্য আড্ডায় প্রবল তর্ক বিতর্ক, পছন্দ অপছন্দের তীব্র কাটাছেড়ার শেষে সবায়ের সম্মতিক্রমে নির্বাচিত হত একটি লেখা। সে অমিতাভ দাশগুপ্তই হোক বা অমিতাভ গুপ্ত কিংবা বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত কবি দাউদ হায়দার যাকে সত্যজিৎ রায় নিজে তার বাড়িতে থাকবার আমন্ত্রণ জানিয়ে ছিলেন-- সব কবিতা ধরে ধরে কী তীব্র উথালপাথাল কয়েকজন যুবকের মধ্যে, এখন ভাবলেও কেমন শিহরণ লাগে। মনে আছে আমাদের ঋদ্ধ পত্রিকাতেই প্রকাশিত দাঊদ হায়দারের কবিতার একটি অমোঘ পংক্তি-- "আমি বলব না অরুণ/বরং সম্পাদনা করো নিজেকেই"।
আমাদের মধ্যে যারা ছবি আঁকার কলেজে তখন পড়তো, পরপর দুটো সংখ্যার তিনশো করে প্রচ্ছদ সারা রাত বসে এঁকে ফেললো, আমরা সবাই জেগে তাদের সাথে কবিতা উদযাপন করেছি সেইসব দীর্ঘ দিন রাত। তারপর একটি সংখ্যায় একজন সে সময়ের আলোচিত মহিলা কবির একটি লেখাকে কেন্দ্র করে আমাদের পত্রিকা সম্পাদনার গণতান্ত্রিক বা যৌথযাত্রার অহংকার ভেঙে চৌচির হয়ে গেল। বিষয়টা বলেই ফেলি। আমাদের নিজস্ব ঢঙের কবিতা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সেই মহিলা কবির লেখাটি অত্যন্ত দুর্বল লেখা বিবেচনায় বাতিল হয়ে যায়। এক্ষেত্রে একটা কথা বলে রাখা দরকার যে, সম্পাদক হিসেবে সোমেনের বা সোমেন ভট্টাচার্যের নাম ব্যাবহারের একমাত্র প্রয়োজনিয়তা ও শর্ত ছিলো সে প্রেসের কাজ দেখাশোনা করবে । মূলত লেখা প্রেসে জমা দেওয়া, প্রুফ দেখা ও পত্রিকা সময় মতো বার করে নিয়ে আসা এবং পরবর্তীতে কবিদের ঠিকানায় পত্রিকা পোস্ট করা। ব্যাস। কিন্তু যে ব্যতিক্রমী সংখ্যাটির কথা বলা হচ্ছে, অর্থাৎ সেই মহিলা কবির বাতিল লেখাটি পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়ে যখন বেরুলো, অমনি জ্বলে উঠলো যৌথতার ঘরে আগুন। আমাদের সবায়ের স্বতন্ত্র অহংকারগুলোকে চূড়মার করে দিয়েছে সোমেনের এই সিদ্ধান্ত। কিন্তু কেন হলো এমন! সোমেনের কৈফিয়ৎ এই শহরের অগ্রজ "অনুশাসন ব্যতীত আজ" কাব্যগ্রন্থের কবি ও অজ্ঞাতবাস পত্রিকার সম্পাদক অরুণ বসু কোন এক চায়ের দোকানের আড্ডায় তাকে একান্তে বুঝিয়েছেন এঈ কবিতাটা নাকি ১০০ বছর পর তার গুরুত্ব বোঝা যাবে । সুতরাং সেটা ছেপে দেওয়া দরকার । আর তাই সোমেন আমাদের মিলিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে এ কাজ করেছে। এইসব বোকাবোকা কথা শুনে আমিতো প্রচণ্ড মারমুখি হয়ে পড়লাম। মধ্যরাতে আমাদের শহরের প্রধান রাস্তার চৌমাথায় দাঁড়িয়ে সে এক খুনোখুনির উপক্রম। আমাদের এত জনের অহংকারকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অধিকার তাকে কে দিয়েছে ! খুনটুন শেষ পর্যন্ত হলো না, কিন্তু পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেল। পরবর্তীতে অরুণ বসু বা আমাদের দাদা-কাম-বন্ধু অরুণদা বারেবারেই বলেছেন, সোমেনের সাথে সেদিন তিনি মজা করে ওই কথা বলেছিলেন। এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, ১০০ বছর পর কোন লেখা কবিতা হয়ে উঠতে পারে ভেবে আজকে আমার চাঁদা তোলা পয়সায় পৃষ্ঠা নষ্ট করব ছেপে !... আসলে সোমেনটা আদ্যোপান্ত একজন কবি। তাই এত সহজ বিস্ময়ে অরুণদার কথার মধ্যেও এক মানে খুঁড়ে তুলেছে। যাইহোক জীবনের প্রয়োজনে আমরা তারপর নানা দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ায়, দীর্ঘ বছর পত্রিকা বন্ধই ছিলো। অতঃপর পরবর্তী সময়ে কবি চন্দন দত্তের উৎসাহেই দ্বিতীয় পর্যায়ে পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তাব বাস্তবায়িত হবার কালে আমি ও সোমেন দুজনেই পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশকের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে অস্বীকার করি। তখন কবি সুব্রত পালও আমাদের সংগে এসে ভিড়েছে। আমরা সবাই মিলে সুব্রতকেই দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করায় সেও রাজি হয়ে যায়। অর্থাৎ যৌথ সম্পাদনার পরিবর্তে একক সম্পাদনার হাতে অর্পিত হলো দায়িত্ব এবং দায়িত্ব পেয়ে সুব্রতও পরপর ঋদ্ধ-র কয়েকটি ভালো সংখ্যা প্রকাশ করে তার ব্যক্তিগত রুচি ও যোগ্যতা প্রমাণ করেছে পত্রিকা সম্পাদনায়। তারপর স্বাভাবিকভাবেই লিটল ম্যাগাজিনের নিয়ম অনুযায়ী দু-এক বছরের মধ্যেই সে পত্রিকার ভবিষ্যৎও ডুবে যায় বিস্মৃতির অন্ধকারে।
আমার লেখালিখি জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ সংবাদপত্রের কাজ ছেড়ে দিয়ে নিজের শহরে ফিরে একটি ধারদেনা করে ছোট ছাপাখানা করে কিছুটা থিতু হবার চেষ্টা করলাম। একই সাথে বেশ কিছুদিন ঝুলে থাকা একটা সম্পর্ক টেনে নামানো গেলো গার্হস্থ্য গণ্ডীর চৌহদ্দীতে। কবি ও সরকারী আধিকারীক এই বান্ধবীর সাথেই শুরু হলো বৈবাহিক উদযাপন। ছোট প্রেস, সু্তরাং মালিক-কাম-শ্রমিক না হলে লাভ গলে যাবে হাতের তালু দিয়ে। শুরু হলো কবির তেল-কালির শ্রমিক জীবন । এতকিছুর মধ্যেও একটা ভালো পত্রিকা করবার তীব্র ইচ্ছে সুপ্ত হয়েই ছিলো। তবে একেবারে নিজস্ব সম্পাদনায় এবং নিজস্ব পছন্দের পত্রিকা প্রকাশের প্রকল্পটি ছিলো আরও পরের । ২০০০ সালের পরবর্তী সময়ের এক সুপরিকল্পিত কর্মসূচী। এক্ষেত্রে লেখাটির সাথে কিছু তথ্য সংযুক্তি অপরিহার্য হয়ে উঠছে, যেমন, ২০০০ সালের অ-ভূতপূর্ব বন্যায় আমাদের নবনির্মিত বছর চারেকের সংসারের প্রায় সবকিছু ভেসে গেল দরজার আগল ভাঙা জলের তোড়ের মুখে। পোষাক-পরিচ্ছদ, বালিশ-বিছানা, হাঁড়িকুড়ি, বাসন-কোসন, ফোন-টিভি-গ্যাস ওভেন। বই আলমারী, ফ্রীজ মুখ থুবড়ে ঘরজুড়ে জল খেলেছে উবুচুবু পলি ও পাঁকে। ভেসে গেছে লাট দিয়ে রেখে দেওয়া আমার কবিতার বই 'খোলা-হাট করে খোলা' জীবনের প্রথম কবিতার বই বোর্ড-বাইণ্ডিং ৫০০ কপি ছাপা হয়েছিল ভালোবাসার বিভিন্ন ব্যক্তিদের অর্থে । মনে আছে শ-তিনেক বই বিক্রী করে প্রত্যেকের টাকাও ফেরৎ দিয়েছিলাম অত্যন্ত যত্নে। বাকি কপিগুলো যা লাট করে রাখা ছিলো, প্লাবন তার উদ্দাম ডানায় লুঠে নিয়ে ছড়িয়ে দিয়েছে নগরীর দেবালয় বেশ্যালয়ের দরোজা থেকে দরোজায়, আছাড় খেতে খেতে মুদ্রিত অক্ষরেরা ছিন্নভিন্ন ছড়িয়ে পড়েছে অক্ষর থেকে বর্ণের, বর্ণ থেকে ধ্বনির এক অসীম চরাচরে। খোলা-হাট করে খোলা।
এই নির্মাণ ও ধ্বংসের ব্যক্ত পরিসরে যখন দেখলাম অনেক কিছুই নতুন করে গড়ে নিতে হচ্ছে, নিজের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন 'অবয়ব' নামের একটি ছাপাখানাও জলে হাবুডুবু খেয়ে প্রায় অসাড়, আমি ও আমার সহকারী এক প্রেসকর্মী দিনরাত এক করে তাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনবার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি, তখনই কোনও এক অবসরে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, একটা গদ্যপ্রধান কাগজ করব একা। যে কাগজ নতুন মেদহীন ব্যতিক্রমী গদ্যমুখের সন্ধানে থাকবে মুখর। যে সব লেখালিখি সময়ের অহংকার হয়েই প্রজ্জ্বলিত থাকে আড়ালে আবডালে। সেই স্বপ্নটাই বাস্তব হয়ে ওঠে ২০০৩ সালে প্রকাশিত "ইন্টার্যাকশন" পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়। যে সংখ্যাটির কভার ছবিটিও ছিলো জানালার শিকের ফাঁক দিয়ে ন্যাংটো এক শিশু বাইরের জলমগ্ন চরাচর দেখছে। এই শিশুটি রাজার চিঠির অপেক্ষায় অসুস্থ অমল নয়, বরং জল থেকে উঠে আসা মহাপৃথিবীর লড়াকু মানুষের আগামী প্রজন্ম, যারা প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করেই প্রতিদিন নিজেদের কাঁধে বয়ে নিয়ে যায় সভ্যতার অহংকার। তাদেরই শৈল্পিক ভাব ও ভাবনার, শব্দে অনূদিত উচ্চারণ সীমিত ক্ষমতাতেই সংগ্রথিত থাকবে এই পত্রিকার মলাটের গর্ভে। আজ ১৬ বছর ছেদহীন প্রকাশিত হয়ে চলেছে সেই কাগজ। চরিত্র হয়ত কিছু বদলে আজ হয়েছে গদ্য-পদ্য-প্রবন্ধের পত্রিকা। তবে ইন্টার্যাকশন যে একটু অন্যরকম সেটা এ পত্রিকার লেখক ও পাঠকেরা অবশ্যই স্বীকার করবেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন