সম্পাদক লেখক বা লেখক সম্পাদক
লেখক ও সম্পাদক তন্ময় বসাক
|
আমার সম্পাদনা জগতে আসা ২০০৯ সালে ডিসেম্বর মাস থেকে। শুরু করি
‘কবিস্টেশন’ পত্রিকার কাজ। সেই সম্পাদনা কাজ এবং সেইসব হাবিজাবি নিয়ে আমার বলার কিছুই
নেই। আসলে কথা তৈরি করতে পারিনি এখনও। বলতে চাইছি, ‘কবিস্টেশন’ কি এখন কোনো পাঠককে
সংরক্ষণ করার মতো সংখ্যা দিতে পেরেছে? পাঠকের উত্তর হবে, না। তবে এই গদ্য লেখা বা
‘সম্পাদক’ শব্দ ব্যবহার করা আমার জন্য সাজে না। কারণ, আমরা প্রত্যেকে সফল ব্যক্তিকেই
আদর্শ করি বা বাঁচিয়ে রাখি। আমার সম্পাদনা পরিবেশনের নেপথ্যে যতই প্রেম কাহিনি থাকুক
না কেন আমি অসফল এখনও। রাজনৈতিক চোরাগোপ্তা দিয়ে পত্রিকা বা লেখক নিজেকে দাঁড় করাতেই
পারে, বৈদ্যুতিক বুদ্ধির চালে এখন পাশা খেলায় নাম করাটা কোনো বড়ো ব্যাপার নয়।
লেখা শুরু করার আগে সম্পাদকের কাছে দু-টি প্রশ্ন আছে? তার আগে বলি
এই লেখাটি শৌভিক ছাড়া অন্য কোনো পত্রিকা বললে লিখতাম না, কারণ এ-যাবৎ শৌভিকই আমার লেখা
সর্বাধিক ছেপেছে বন্ধুত্বের জন্য হোক বা কাজের জন্য। আর কোনো পত্রিকা বা সম্পাদক খুব
একটা জানেও না যে, আমি লেখালেখি করে থাকি বা করেছি। তবে পত্রিকা হয়তো কিছু মানুষ চিনছে।
তবুও বন্ধু সম্পাদকের কাছে জিজ্ঞাসা, তাঁর কাছে আমার লেখা ও পত্রিকা কতটা গ্রহণযোগ্য?
সে উত্তরে হয়তো বলবে, না পড়লে বা গ্রহণযোগ্যতা না হলে এ-গদ্য লিখতে বলব কেন? কিন্তু
এই সহজ কথায় ছাড়ছি না বন্ধু সম্পাদককে, চাই যতজন সম্পাদকের লেখা তিনি প্রকাশ করছেন
প্রত্যেক আমন্ত্রিত লেখক ও সম্পাদক সত্তার আধার নিয়ে তিনি বলবেন...
শুরু করি ২০০৮ সাল থেকে। আমি সদ্য সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেছি। কবিতাই
লিখি। পরবর্তীতে পরিচয় হয় সুদীপ্ত দাস, পলাশ গঙ্গোপাধ্যায়, দিলীপ তলোয়ার এমন অনেকের
সঙ্গে। দিলীপদা একদিন বললেন, একটা পত্রিকা হোক, পরে পলাশদা বললেন— মালদায় এখন শুধু
কবিতার কাগজ নেই। শুধু কবিতার কাগজ হোক। সে-মতোই এগোনো হল। পত্রিকার নাম দিল সুদীপ্ত
দাস, ‘কবিস্টেশন’, ‘‘যেখানে কবিদের টাইম টেবল নেই’’। প্রথম সংখ্যা বেরোলো। আমি লিটল
ম্যাগাজিন দুনিয়ায় প্রবেশ করছি। যেভাবে একেরপর এক কবিতা লিখছি সঙ্গে চলছে পত্রিকা বোঝার
কাজ। প্রথম সংখ্যা বের করার পর থেকেই আমার কিছু ফোন কল, কিছু ভালোবাসার চিঠি আসতে লাগল,
বিশেষত পত্রিকার নামটির জন্য। আমি কাজে আরও মন দিলাম, সে-সময় কলেজের পড়াশুনা সিকেই
তুলে মনে হচ্ছিল এটিই সঠিক সময়। লিটল ম্যাগাজিন কী, কেন, তার ফ্রন্ট, তার প্রচ্ছদ,
তার পয়েন্ট এমন অনেক কিছু নিয়ে ঘোর হয়ে থাকতাম। রাতে আড্ডা মারতাম টাউন হলের বারান্দায়,
পলাশদা একদিন প্রশ্ন করলেন, “তন্ময়, তুমি কবি না সম্পাদক কোনটি হতে চাও সেটা আগে নির্বাচন
করো। দু-টি সত্তা একসাথে হয় না”। কিছুদিন ভেবে বলেছিলাম, “দাদা আমি সম্পাদকই হতে চাই”।
সেই থেকে কবিতা লেখা বা ভাবার প্রতি আমার চাহিদা কমতে থাকে। তারপর আসতে আসতে আজ হয়তো
কেউ জানেই না আমি লেখালেখিও করি বা করতাম।
আমার লেখার বিষয় বলা হয়েছে কী কী অসুবিধা হয়েছে লেখক সত্তাকে বাঁচিয়ে
রাখতে সম্পাদক সত্তায়। পরে বুঝেছিলাম সত্যি একা একটা মফসসল থেকে পত্রিকা করতে হলে লেখার
কলমটাকে নিহত করতে হবে। একসময় আমি কারো কাছে লেখা চাইলে বা কেউ আমার কাছে লেখা চাইলে
সেটা দেওয়ার সাথে সাথে তার একটি লেখা গুঁজে দিতেন বা আমার লেখা তার পত্রিকার জন্য আহ্বান
করে রাখতেন। যাতে আমি লেখাটি হাতে নেওয়ার পর নির্বাচন না করতে পারি। এমন বহু অভিজ্ঞাতার
পর নিজেই নিজের নাম দিলাম ‘সৃজন’। সৃজন নামে কলম চলতে থাকল। কিন্তু বাড়িতে আপত্তি দেখা দিল, মা-বাবার মনে
হতে লাগলে তাঁদের দেওয়া নামটার স্টিকার উঠিয়ে দিতে চাইছি। ব্যবহার স্থগীত রাখতে হল।
ক্রমশ পত্রিকার কাজ চলছে, সংখ্যার কলেবর ধীরে ধীরে বাড়ছে। বাড়িতে ঢুকলেই একটা দুটো
লেখার চিঠি বা রাতে মেল ভরে যাচ্ছে। আমার মধ্যে একটা ধরন কাজ করত যে, আমন্ত্রিত হোক
বা না হোক, লেখা নির্বাচন করার প্রবণতা, যার ফলে অনেকের কাছে দৃষ্টিকটু হলেও আদতে ক্ষতি
হল নিজের লেখার। একজন লেখক বা পাঠক শুধু নির্বাচিত লেখায় পড়ে থাকেন যা সম্পাদকের পক্ষে
হয় না, বহু খাদ্য অখাদ্য লেখা একজন পত্রিকাকর্মী পড়ার ফলে তার লেখার উপযুক্ত শব্দগুলি
থাকে না। কিংবা একটা সংখ্যায় হাত দেবার পর সে-সংখ্যা নিয়ে ভাবনা, লেখা আমন্ত্রণ, লেখককে
তাগাদা, তারপর সাজানো গোছানো, ছাপাছাপি, টাকা জোগাড়, প্রকাশ করা, অনুষ্ঠান, বিক্রি
করা, শেষে সংখ্যাটি নিয়ে পাঠকের প্রাপ্তির কথা ভাবতে ভাবতে সম্পাদকের নিজের লেখা ক্ষীণ
হয়ে যায়।
আমার কথার সাথে অনেকেই সহমত হবেন না হয়তো, হতেও বলিনি। কিন্তু আমাদের
পূর্বজ সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু লেখার চাইতে সম্পাদক হিসেবেই মনে রেখেচ্ছি বেশি, হ্যাঁ
সমালোচক হিসেবেও। কিন্তু কবি হিসেবে বুদ্ধদেববাবুকে আমরা ক-জন চিনি? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের
‘কৃত্তিবাস’-কে আমরা অনেকেই চিনি। ঠিক। কিন্তু পিনাকীদা সেই সময় কৃত্তিবাসের উত্থানের
জন্য অনেকটা দাবি রাখেন। ‘কবিসম্মেলন’-এর শ্যামলকান্তি দাশ একজন উল্লেখযোগ্য কবি হলেও
বেশি মনে থাকবে ‘কবিসম্মেলন’-কেই। সমসাময়িক বন্ধু সেলিম মণ্ডল একহাতে সম্পাদক, বিশিষ্ট
প্রকাশক ও কবিও। তাঁর এযাবৎ হয়তো ৩টি বইও রয়েছে। কিন্তু তবুও প্রয়াসের থেকে বেশি সেলিমকে
পাঠক চেনে কি?
আসলে একজন সম্পাদক বা লেখকের পত্রিকা খানিকটা যদি পরিচিতি পেয়ে
যায় তাকে লেখক হিসেবে দাঁড় করানো অসম্ভব হয়ে পরে। পরিচয় হয় তখন অমুখ পত্রিকার সম্পাদকের
লেখা। সম্পাদকের নিজেস্ব সত্তা ততদিনে দণ্ডায়মান বিভীষিকা মাত্র।
আমাদের এক বিশিষ্ট সাহিত্যিক দিদি আমাকে একদিন বললেন, “পত্রিকা,
কাজ অনেকটাই পরিচিতি হয়েছে এবার সমালোচনাধর্মী লেখা লেখ, তবে সম্পাদকের উপর পাঠকের
গাঢ়তা বাড়বে”। তিনি কিন্তু সেদিন আমাকে কবিতা লেখার কথা বা গদ্য বা গল্প, উপন্যাস লেখার
কথাও বলেননি। কারণ সম্পাদক পরিচয়ের মধ্যে এ-সব যায় না।
প্রথম থেকে লিটল ম্যাগাজিন যখন জানতে শিখলাম, বুঝলাম যখন থেকে অপ্রাতিষ্টানিক,
অবাণিজ্যিক কাজ লিটল ম্যাগাজিনের। একজন সম্পাদক সর্বোতভাবে নিজের লেখাকে সব জায়গায়
পৌঁছাতে পারে না। কারণ, অপ্রাতিষ্ঠানিক, অবাণিজ্যিক, বারুদ ঠাঁশা, মেনস্ট্রিম বা বাজারি
লেখার সাথে সাথে নিজের দূরত্ব থেকেই যায়। কারণ, একজন লিটল ম্যাগাজিনকর্মীর মধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিকতার
গন্ধ ছোঁয়াছে হয়ে থাকে। তাই এক উর্তিন্যমান লেখক লিটল ম্যাগাজিন থেকে লেখা শুরু করলেও
তার হাত পাকানো কলমের নিজেস্বতা আসার আগে থেকেই হয় সে বাজারি হয়ে পড়েন নচেত দামি পাবলিশারমুখী
হয়ে পড়েন। বলছি না তারা আর লিটল ম্যাগাজিনে লেখেন না, লেখেন কিন্তু একজন লিটল ম্যাগাজিন
চালকের এই উত্তীর্ণতা খুব কম আসে।
লিটল ম্যাগাজিনের সফলতা? ক্ষুদ্র পত্রিকার কর্মীর কাছে এ এক বেয়াক্কেলে
শব্দ। আমি এযাবৎ যা বুঝে এসেছি লিটল ম্যাগাজিন শুধু সাধনা আর সাধনা। সিদ্ধি লাভ কোনো
দিন হয়না। লিটল ম্যাগাজিন শুধু একটা কাজ, এর কোনো প্রাপ্তিযোগ বা কোনো অমোঘ বেঁচে থাকা
নেই। কাল পত্রিকা বন্ধ করে দিলে পরশু সক্কলে ভুলে যাবে। কিছু কালজয়ী পত্রিকা থাকে গবেষকদের
কাজের জন্য। এর থেকে বেশি একটা ক্ষুদ্র বারুদকে কেউ মনে রাখে না। তাই লেখক সত্তা হারিয়ে
ড্রাইভার বেঁচে থাকেন না।
একজন পত্রিকার সম্পাদক লেখা পঠনের সময় তাকে দশক, কাল, পাত্র, গোষ্ঠী,
সময়ের ধরন, মনে এবং মাথায় রাখতে হয়। যার ফলে একটা
লেখা সবসময় ক্রিটিসাইজ করেই সম্পাদকের সামনে ধরা দেয়। যার ফলে নিজে লেখার সময় সেই বাফারিং
গুলি থেকে সম্পাদক মুক্ত হতে পারেন না। আর সর্বোপরি তিনি বহু লেখা পড়ার ফলে তাঁর নিজের
লেখার বহমানতা ধরতে পারেন না। তাঁর কোনটা লেখা হচ্ছে, কোনটা হচ্ছে না সেটা বোঝার ক্ষমতা
নিজের লেখার ক্ষেত্রে হ্রাস পাই। আবার এও ঠিক যে, একজন সম্পাদকের লেখা খুব বেশি পরিবর্তনশীল।
শুধু একজন লেখকের কলমের একটা সিগনেচার তৈরি হয়, পাঠক তাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েন, কিন্তু
একজন সম্পাদকের লেখা অতিপরিবর্তনশীল বলে পাঠকের তা অধরা থেকে যায়, অনেক ক্ষেত্রে সম্পাদক
ভালো লেখা দিলেও সেটা সেই সিগনেচারি উত্তীর্ণতা পাই না।
আমাদের বাংলা কবিতায় বা পত্রিকাকেন্দ্রিক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। একজন
সম্পাদকের সাথে আরেকজন সম্পাদকের মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। যা এক লেখক হয়ে ওঠার
ব্যাপ্তিতে বাঁধা পাই।
ঠিক তেমনই সব সফল সম্পাদক আবার লেখক নন। সম্পাদকীয় অসাধারণ লিখলেও
তার লেখার বা কলমের জোড় কোনো দিনই থাকে না। চেষ্টা করেও তার হাত দিয়ে একটা ভালো লেখার
জন্ম হয় না।
এখন কার্যত প্রত্যেক লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদকই ছোটোখাটো প্রকাশকও
বটে। ফলে এক বিনিময় প্রথা হয় বা নিজের বই নিজে করে অন্য বইগুলি বের করার আগ্রহে নিজের
বই অন্ধকারেই থেকে যায় সম্পাদকের বা ১০০ কপি বই দিয়ে প্রকাশক মুক্ত মন হয়ে পড়েন।
আবার এখন সময়ের নিরিখে ভার্চুয়াল দুনিয়া এত সহজ হয়ে যাবার ফলে সবাই
সম্পাদক, সবাই কবি বা লেখক। আলাদা করে ক্লারিফিকেশন করাও খুব মুশকিল। একজনের এতকিছু
হয়ে ওঠাটা আদতে সাহিত্যের জন্মান্তরে কী পরিণতি অপেক্ষা করছে তা মহাকাল জানে।
শেষে আমার এটাই মনে হয়, একজন সম্পাদক প্রথমত সম্পাদক, দ্বিতীয়ত
তিনিই সম্পাদক, শেষেও তিনি শুধু লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক হয়েই থেকে যান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন