তিতির এক উড়ানের নাম
লেখক ও সম্পাদক সঞ্জয় সাহা
|
প্রায় কুড়ি বছর আগে যেদিন এর বীজ বুনে ছিলাম কালিতে, অক্ষরে সেদিন কি ভেবেছিলাম সম্পূর্ণটা ! যে এটা চলবে মাইলের পর মাইল, নাকি অগ্রজ কাগজগুলোর মত তিন - চার -পাঁচ -সাত বছর চলেই মুখ থুবরে পড়বে l একটা জেদ ছিল ভেতরে বা কোথাও একটা নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার তাগাদা l কোথাও বা কেন শুধু, কারো কাছেও তো বটে l. তারপর অভিজ্ঞতা, অর্জন আর অপমানের রানওয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে আজ হয়তো কিঞ্চিৎ ব্যক্তিত্ব, পরিচিতি ও স্বাবলম্বন হয়েছে কাগজটিরl.. স্থানীয় ভূগোলের বাইরেও এর কিঞ্চিৎ বিস্তার l.. এর সমস্যার কথা লিখব না এখানে কারণ সমস্যাগুলো তো অনেকটাই বাইরের, এবং সমাধানযোগ্যতো বটেই l. আর অনুজ বন্ধু কবি সম্পাদক শৌভিক তা চায়ওনি আমার কাছে l.. বরং বলি সম্পাদক ও লেখক এর দ্বন্দ্ব, বরং বলি কবি ও প্রাবন্ধিক এর দ্বন্দ্ব, লেখা ও না লেখার দ্বন্দ্ব, বরং বলি 'টু বি অর নট টু বি' l বরং বলি একেবারে নিজের আঁতের, .. " একমাত্র শুধু যাহা নিতান্ত আমার আপনার কথা l"
.... যদি ডাউন মেমোরিলেনে রেট্রোস্পেকটিভ - এ যাই, সেই ক্লাস ফাইভে প্রথম নিজের নাম ছাপার অক্ষরে দেখার পর কি একবারও ভেবেছিলাম যে সম্পাদক হব ! ভেবেছিলাম লেখক হব, কবি হব lএরকম প্রচুর নাম বের হবে l. কিন্তু তারপর সুটুঙ্গা মানসাই তোর্ষা কালজানি দিয়ে প্রচুর জল বয়ে গেল আমার কবি হওয়া হলো না সেভাবে, লেখক হওয়াও হলো না সেভাবে, সম্পাদক হয়তো কিছুটা হয়েছি l প্রায় আড়াই দশক নিয়মিত লেখাপড়া লেখালেখি করেও কেন সেরকমটা হলো না আজ যদি ভাবতে যাই তাহলে যে কারণগুলি উঠে আসবে তা কিছুটা আত্মজিজ্ঞাসা মূলক এবং কিছুটা যান্ত্রিক ও বটে অন্তত তার উপস্থাপনাতে l
"I accuse, না, কারোরই না l" শৌভিকের কথায় লেখাটা লিখতে গিয়ে প্রথমে নিজেকেই এক ইউজ করতে হয় l. এবং নিজের অহংকে এবং তার সাথে মিশে থাকে নিজের অলসতা l শুরুর দিকে দু-তিনবার 'দৈনিক বসুমতী' ছাড়া আজ পর্যন্ত কোথাও নিজের থেকে লেখা পাঠাইনি ফলে লিখতে লিখতে লেখক হওয়া বা লিখে লিখে পরিচিতি ও পাঠক বাড়তে বাড়তে তাদের সমালোচনা ও উৎসাহতে আরো একটু এগিয়ে যাওয়া... আমার কখনো সেভাবে হয়ে ওঠেনি l অথচ আমি আশীর্বাদপুষ্ট ঈর্ষণীয় সাহচর্যে থেকেছি দশকের পর দশক l. যেখানে নিত্য মালাকারের মত কবি, সন্তোষ সিংহ অনুভব সরকারের মত কবি- শিক্ষক, সুব্রত রায়ের মতো প্রতিভাধর অগ্রজ কবি নাট্যব্যক্তিত্ব আর সর্বোপরি ছাত্রজীবন থেকে অরুণেশ ঘোষকে দেখা ও কাছে পাওয়ার সৌভাগ্য l প্রায় বছর কুড়ি আগে অরুনেশদা আমার কয়েকটি কবিতা এদিক-ওদিক পাঠিয়েছিলেন নিজেই ভালোবেসে l আর তার অনেক পরে কবি সুবীর সরকার যখন মাথাভাঙ্গায় তখন সুবীরদা
ওই ফুল ফোটে বনে /যাই মধু আহরণে /দাঁড়াবার সময় তো নাই l আসলে বিষয়ভিত্তিক পত্রিকা করবার জন্যই সমস্যাটা আরেকটু বেশি l কেননা ধরুন, আমি যখন চা-বাগান নিয়ে কাজ করছি তখন আমার মাথায়, সিটিসি, অর্থোডক্স, ফ্যাক্টরির ধোয়া আর মৃত্যুর সাথে শ্রমিকদের চু কিত্ কিত্ খেলা l. আমাকে পড়তে হচ্ছে মিনিমাম ওয়েজেস আইন, ভারতীয় কারখানা আইন, কিংবা গরু খোঁজা খুঁজতে হচ্ছে 'চা কর দর্পণ' l মাসের পর মাস লেগে যাচ্ছে এটা জানতে যে চা বাগান নিয়ে কি কি ভালো ছোটগল্প হয়েছে বা কে কে ভালো ছোট গল্প লিখতে পারবেন এবং তাদের পূর্ববর্তী লেখা গুলোর সাথে আমার পত্রিকার মানের সাথে মেলে কিনা l. আসামের প্রত্যন্ত চা বাগান এলাকার কাজল দেম তাকে খুঁজে বের করতেই তো আমার কয়েক মাস লেগে গেছে l কিংবা যখন ডাইরি নিয়ে কাজ করছি, কি করে জানবো যে 1911তে মোহনবাগান এর সাথে থুরি ভারতের ইংরেজদের প্রথম ফুটবল মাঠে যে জাতীয় লড়াইটা হয়েছিল তার রাইট আউটে খেলতেন কানু রায় আর তিনি ডায়েরী লিখতেন l. কি করে জানবো যে সমাজসেবী সঞ্জয় ঘোষ ঠিকাদার ও স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে যাবেন বলে একদিন তার দেহ টুকরো টুকরো করে ভেসে উঠবে ব্রম্মপুত্রের জলে আর সেই লোকটিও মারা যাবার আগে ডায়েরী লিখতেন l বা কমিউনিস্ট শাসিত আগরতলার মেয়র শংকর দাস ডায়েরী লিখতেন যিনি "সব প্রশ্নের উত্তর মার্কসে নন, পেয়ে যান রবীন্দ্রনাথ -এ "l এই সব আবিষ্কার করতে ট্রাস বা সহকারি হিসেবে আরো কত বই, পিড়িয়ডিক্যালস, বা তথ্য নিয়ে যে ঘাটাঘাটি করতে হয়েছে বা হয় তার ইয়ত্তা নেই l এক ডাইরি সংখ্যা করতেই আমি ন'বার কলকাতায় গেছিলাম l আবার দেশভাগ নিয়ে যখন কাজ করি তখন তো একদিকে যেমন দেশভাগের উপর কি কি সাহিত্য হয়েছে তা নিয়েই বছর দুয়েক চলল সাগ্রহে ও সানন্দে অনুসন্ধান ও পড়াশোনা, ঠিক তেমনি ফিল্ড স্টাডি করেছিলাম চা-বাগানের মতোই l মোদ্দা কথাটা হলো এই সমস্ত করতে গিয়ে নিজের আত্মাকে তৃপ্তি দেওয়ার মতো কোন সময় থাকে না হাতে l কেননা পত্রিকা অবশ্যই নাম যশ প্রতিপত্তি পরিচিতি সব এনে দেয় কিন্তু নিজের আত্মার পুষ্টিতে কোথায় যেন একটু কমতি থেকে যায় l বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমার হাতে তাদের চিহ্ন সম্মাননা তুলে দিয়ে বলেছিলেন.. মেথডিক্যালি সাবমিট করলে এটার ( ডায়েরি সংখ্যা) জন্য পিএইচডি হতেই পারত..l.. কিংবা চা বাগান সংখ্যা হাতে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা
একাডেমির সচিব মৃদু হেসে বলেছিলেন.." আমরাতো গতবারই আপনাকে একাডেমি আওয়ার্ড দিয়ে দিয়েছি l" দেখুন পাঠক আত্মতুষ্টির এই কথাগুলো কিভাবে আপনাকেও শুনিয়ে ফেললাম l.আসলে এই স্তোক বাক্যগুলি যেমন উদ্দীপকের কাজ করে তেমনি লোভ ও তো হয় ভেতরে ভেতরে খুব l সম্পাদনার কাজে খুব বেশি সম্পৃক্ত হওয়ায় আরো যেটা হয় সেটা হল ভেতরে ভেতরে যুক্তিবোধ এত বেড়ে যায় যে কিছুতেই আর আবেগের জায়গায় সহজে ফেরা যায়না l. বা আরও স্বচ্ছ করে বললে বলতে হয়, কল্পনার জায়গা থেকে সরে যেতে থাকি আমি l আর যুক্তির পৃথিবীতে দৃশ্যের জন্ম হয় না l
লেখা না পাঠাবার পেছনে বা চাইলেও লেখা না দেওয়ার পেছনে বা সোজা কথায় নিজের কবিসত্তাকে সংগোপনে লুকিয়ে রাখার পেছনে আরও যেটা কাজ করে তা এক প্রকারের ভয় l কেননা কুড়ি বছরের বা তার বেশি সম্পাদনার জীবনে কত লেখাকে যে রিজেক্ট করেছি তার ইয়ত্তা নেই l এমনকি চেয়ে নিয়েও ছাপিনি সে সংখ্যাটাও প্রচুর l এই অসৌজন্যতা দেখিয়েছি একটাই কারণে যে লেখক বা কবি তাঁর লেখা জমা দিচ্ছেন একজন সম্পাদককে যার কাজ শুধু ছাপা নয়, মনোনয়ন করা, নির্বাচন করা এবং প্রয়োজনে সম্পাদনা করাও l সুতরাং আমার নিজের লেখাও যে সেই এসিড টেস্ট এর ভেতর দিয়ে যাবে তা আমি জানি, তাই মাঠে নামার আগেই এক ধরনের ঘাম বের হতে থাকে l
এ তো গেল নিজের কথা নিজের দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, অহমিকা , অসৌজন্যতার কথা l. কিন্তু বাইরের পৃথিবী আমাদের সম্পাদকদের কিন্তু সম্পাদক হিসেবেই দেখতে চায় l সেদিন আমার বন্ধু স্বনামধন্য পত্রিকা 'ঐহিক 'এর সম্পাদক তমাল বলছিল..." লোকে তো ভুলেই গেছে যে আমিও একটু আধটু লিখি l" 'দাহপত্র' র সম্পাদক কমল কুমার দত্ত যে কত শক্তিশালী কবি, তা তার "মাদারির মায়াবাক্সের সামনে" যারা পড়েছেন একমাত্র তারাই জানেন l এমনকি লেখক সম্পাদকের দ্বৈরথে কত সহজেই না স্মৃতির অন্তরালে চলে যান 'গল্প-কবিতা'র কৃষ্ণগোপাল মল্লিক l
কিন্তু এসব সত্ত্বেও আমি বিশ্বাস করি অন্য কেউ নয় একজন লেখকের লেখক না হওয়ার পেছনেও সেই লেখকই দায়ী l সম্পাদক তার সম্পাদকীয় সত্তাকে যতটা আদর-যত্ন দেন ততটা যত্ন করেন না তিনি তার লেখক সত্তাকে l বরঞ্চ কিছুটা অবহেলাই করেন l কেননা বঙ্কিমচন্দ্র, বুদ্ধদেব বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, গৌরকিশোর ঘোষ, সুধীর চক্রবর্তী বা হাল আমলের অজিত রায়, প্রণব চট্টোপাধ্যায়, প্রণব চক্রবর্তী, রিমি দে, মিতুল দত্ত, গৌতম গুহ রায়, অতনু বন্দ্যোপাধ্যায় এরা এদের দুটো সত্তাই সমানভাবে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন বা পেরেছেন l আমার অক্ষমতা নিতান্তই আমার, ব্যক্তিগত l
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন