দ্বৈত সত্তা – কবি ও সম্পাদক
লেখক ও সম্পাদক উত্তম চৌধুরী |
সৃজনশীলতাই একজন লেখকের ধর্ম। কিছু লেখার একটি অভ্যাস তৈরি হলে এবং নিয়মিত চর্চায় ক্ষেত্রটি দীর্ঘায়িত হলে, স্বভাবতই একটি পত্রিকা প্রকাশের অদম্য তাগিদ মনের মধ্যে অনুভূত হয়। আর তখনই জন্ম নেয় একজন নতুন সম্পাদক। দৃশ্যমুখের সম্পাদক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা ঠিক সে রকমই। শব্দের সঙ্গে নেহাত খেলাচ্ছলে বা নিজস্ব মনোজগতের আড়াল তৈরির অভিপ্রায়ে যার কবিতা লেখা শুরু ১৯৭৮ সাল থেকে, সে আরো এক গুরু দায়িত্ব তুলে নেয় ঘাড়ে ১৯৯১ সালে। অবশ্য এর বেশ কিছুদিন আগে ‘চেতনা’ নামে একটি পত্রিকার যথাক্রমে সহ-সম্পাদক পরবর্তীতে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলাম। তবে সাহিত্বচর্চার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র হওয়ার মানসিকতা এবং পত্রিকাকে তালিকাভুক্তকরনের জন্যই দৃশ্যমুখের উজ্জ্বল প্রকাশ। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয়তে এমনই লিখেছিলাম, ‘যুক্তিনির্ভর পরিবর্তনশীলতা, পরিবর্তিত সাহিত্য পরিবেশ ও প্রত্যয় এবং মার্জিত রুচির প্রশ্ন স্বভাবতই এ মূহুর্তে হানা দেয়। এসবেরই অবিচ্ছিন্ন ও পূর্বকল্পিত রূপ দৃশ্যমুখ। সাময়িক সম্পাদক হিসেবে আরো দুটি পত্রিকা ‘নোনাই’ এবং’ মাদল’-এর সঙ্গেও জড়িত ছিলাম ।
প্রথম প্রকাশিত দৃশ্যমুখ শারদ সংখ্যার (১৯৯১)
মূল্য ছিল মাত্র পাঁচ টাকা। মূদ্রিত হয়েছিল ভবানী চক্রবর্তীর বীণাপানি প্রিন্টিং প্রেস
থেকে। সিসার তৈরি হরফের কাজ, পা দিয়ে চালানো মেশিনের শব্দ, তেলকালির চিহ্ন এখানে সেখানে
বেশ মনে পড়ে। লেখকসূচীতে বেশ উল্লেখযোগ্য ছিলেন বেনু দত্তরায়, সমীর চক্রবর্তী, হরেন
ঘোষ, সুধাংশু কর্মকার, তুষার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। দক্ষিণ আফ্রিকার কলোম্বিয়ার বিশিষ্ট
সাংবাদিক এবং গল্পকার হারনান্দো টেলেজ-এর একটি গল্পের ভাষান্তর করেন অনুবাদক বনবিহারী
দত্ত। গল্পটির নাম ছিল ‘শুধু ফেনরাশি’। গুনটার গ্রাসের কবিতার অনুবাদ করেন অধ্যাপক
অর্ণব সেন। উল্লেখ্য অম্লান জ্যোতি মজুমদার দ্বারা অনুবাদিত অকতাভিও পাজ এর একটি কবিতা,
“নীলগিরি পাহাড়ে
দেখেছি টোডাদের
ওদের মন্দিরগুলো শঙ্কুর আকার
হাড়সার, দাড়িওলা, দুর্জ্ঞেয়
ওরা পবিত্র মেঘগুলোকে দোয়ায়
হিজিবিজি মন্তর আউড়ে”
দৃশ্যমুখের প্রথম সংখ্যায় ছোট ছোট অনেক বিজ্ঞাপণ ছিল । কোনোটা ত্রিশ টাকার, কোনোটা পঞ্চাশ টাকার । কেউ সহযোগিতা করেছেন , কেউ অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন । বিচিত্র সেই বিজ্ঞাপন যেমন – জে.জি.ইলেকট্রনিক্স, প্রভাবতী জুয়েলার্স, রাজদ্বীপ সু মার্ট, টপ ফ্যাশন টেইলার্স, মিত্র সোপ ফ্যাক্টরি, দে সাইকেল মার্ট, আরোগ্য হোমিও হল, পেপার সিন্ডিকেট,পপুলার ব্রিক ফিল্ড, জয় কিষাণ ব্যাগ ফ্যাক্টরি প্রভৃতি ।প্রচ্ছদ ছাপিয়ে আনা হয়েছিল শিলিগুড়ি থেকে। তখনও আলপুরদুয়ারে ছাপার জগতে স্ক্রিন প্রিন্ট আসেনি। আপসেট ছিল দূরের কথা। কভারে সাধারণত ছাপা হত লিনোকাট বাঁ কাঠের প্রচ্ছদ। অথবা মেটাল ব্লক। কিংবা কোথাও প্রচ্ছদে ছিল শুধু অক্ষরের কারুকাজ।
প্রথম সংখ্যার সম্পর্কে কামাক্ষাগুড়ির দেবশিস
ভট্টাচার্জ লিখলেন, ‘ শারদীয় দৃশ্যমুখ সৌভাগ্যক্রমে আমার হাতে এসেছে । আপনারা আলিপুরদুয়ার
থেকে এত সুন্দর পত্রিকা করেছেন, মহকুমার বাসিন্দা হিসেবে আমার গর্ব হচ্ছ ...‘ (০৩.১১.৯১)
। নদীয়া থেকে জয়নাল আবেদিন লিখলেন ...দৃশ্যমুখ আজই হাতে পেলাম। ভালো কাগজ । এখনো পড়া
হয়নি। পড়ে মতামত জানাব। তবে নিশ্চই ভালো হবে। কোন সম্পাদককে বলবো আলোচনা করতে ...”
( ১২.১১.৯১) । দৃশ্যমুখের দ্বিতীয় (১৯৯২) সংখ্যা সম্পর্কে আনন্দগোপাল ঘোষ লিখলেন , ‘ঁ বিজয়ার শুভেচ্ছা
নেবেন। দৃশ্যমুখ শারদ সংখ্যা পাঠানোর জন্য ধন্যবাদ। খুব সুন্দর সংখ্যা হয়েছে ,। কাগজ
,প্রচ্ছদ, লেখা নির্বাচন, - তিনটি দায়িত্বই যথার্থভাবে পালন করেছেন সম্পাদক। অনেকদিন
দেখা হয় না ।
নোনাইতেও আপনি আছেন ? ছবি চর্চার খবর কি? আপনার
প্রদর্শনী করার কথা ছিল, জলপাইগুড়িতে । তার খবর কি ?’ (২০.১০.৯২)
অর্থসঙ্কট পত্রিকা প্রকাশের অন্তরায়। দু-বছর এর কারনেই পত্রিকা প্রকাশ সম্ভব হয়নি। কারও কারও
মন্তব্য, ‘ কেমন আয় হয় ?’ বিস্মিত হয়েছি। আমি পারিনি। হয়তো কেউ কেউ পেরেছে। কিছুটা
কুন্ঠা, কিছুটা আত্মসম্মানবোধের কারনে বিজ্ঞাপণ নিয়ে অত ভাবিনি। দৃশ্যমুখের এমন সংখ্যাও
আছে যেখানে কোনও বিজ্ঞাপণ নেই। ১৯৯৫ সালে বের
হয়েছিল তৃতীয় সংখ্যা পুরোপুরি গাঁটের পয়সা খরচ করে। এ সংখ্যার উল্লেখযোগ্য লেখকরা ছিলেন
– কেদার ভাদুড়ি, অর্ধেন্দু চক্রবর্তী, কমল চক্রবর্তী, দেবী রায় ,ভাস্বতী রায়চৌধুরী
অরুনেশ ঘোষ প্রমুখ ।
১১.১০.৯৫-এ অর্ধেন্দু চক্রবর্তী
লিখলেন ; লজ্জা কেন ? লেখা ছেপেছেন আমি কৃতজ্ঞ। ছোট কাগজের কত সমস্যা, তা যদি না বুঝি
তাহলে নিজেকে অপরাধী মনে হবে ।
সাধারণ সংখ্যার পাশাপাশি দৃশ্যমুখের
বিশেষ সংখ্যাও বের হত । ১৯৯৮ সালে বের হল দৃশ্য মুখের অনুবাদ সংখ্যা । কলেবরের দিক
থেকে ক্ষীণ হলেও সংখ্যাটি ছিল যথেষ্ট সমৃদ্ধ। সম্পাদকের টেবিল থেকে লিখেছিলাম, ‘সময়ের
দড়ি ধরেছি - ঝুলে থাকার জন্য নয় বরং একালীন কিছু বিজ্ঞাপণ ঝুলিয়ে রাখার জন্য যে অধিকাংশের
গড্ডালিকা প্রবাহে নেই- সেই বশীকরণ বা বশংবদে। নেই মেরুকরণ বা স্বীকৃত রঙে – জেলাওয়ারি
– দশকওয়ারি ভ্রান্ত। মর্ডানিজম – পোস্টমর্ডানিজম অবান্তর। প্রকৃতপক্ষে সময়ের চালচিত্রই
সাহিত্য। তার ইতিবৃত্ত - চরিত্র - চিন্তন – জীবনযাপন – সময়াভিমুখি দুরন্ত ছোটা অনস্বীকার্য
। ‘ লেখকসূচীতে ছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী, রাম বসু, প্রীতীশ নন্দী - অনুবাদ ; শক্তি চট্টোপাধ্যায়
– ত্রিযতান জারা -অনুবাদ মলয় রায় চৌধুরী, নিত্য মালাকার প্রমুখ । আমি অনুবাদ করেছিলাম
উইলিয়াম ব্লেক, আলেকজান্ডার পুশকিন এবং রাশিয়ান কবি ল্যারিসা ভেসিলেভার কবিতা ।
আরও উল্লেখযোগ্য বিশেষ সংখ্যা
যেমন বইমেলা সংখ্যা । আঞ্চলিক ভাষায় বিশেষ কবিতা সংখ্যা , সহস্রাব্দ সংখ্যা, জীবনানন্দ
দাশ সংখ্যা প্রভৃতি। দৃশ্যমুখের উদ্যোগেই বেরিয়েছে ‘দৃশ্যমুখ কবিতা সংকলন ‘ (১০০ জনের
কবিতা)। এছাড়া স্থানীয় অনেক লেখকদের লেখা সম্পাদনা করে বই প্রকাশ করে দিয়েছি । উৎসাহিত
করেছি সাহিতচর্চা চালিয়ে যেতে কিংবা সম্ভব হলে পত্রিকা প্রকাশ করতে ।
ত্রিশ বছরে পদার্পণ করল দৃশ্যমুখ
। অনেক নামি, অনামি স্থানীয় এবং বাইরের লেখায় ভরে উঠেছে তার শরীর । আমন্ত্রণ বা বিনা
আমন্ত্রণেই চলে আসত অনেক লেখা । অনেকের মান, অভিমান দৃশ্যমুখে লেখা নেওয়া হয়না বলে।
লেখাগুলো বাছাই করা , প্রেসে দেওয়া, প্রুফ দেখা, প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ এর কাজ, সর্বোপরি
বিলি ও বিক্রির ব্যবস্থা এই সম্পাদককেই নিতে হয়েছে । পত্রিকা প্রকাশনার এই দীর্ঘ সময়ে
দৃশ্যমুখ বিচিত্র ও অনেক শক্তিশালী লেখনীর সংস্পর্শে এসেছে । নানা অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ হয়েছে
সে দিনদিন । মননশীল সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধ দৃশ্যমুখ । যা পাঠককে ভাবায় না, নাড়িয়ে
দেয় না তেমন সাহিত্যকর্মে বিরত থেকেছে ।
হঠাৎ করে একজন সম্পাদকের জন্ম
হতে পারে কিন্তু সম্পাদনার কাজ চালিয়ে যাওয়া ভীষণ কঠিন। সম্পাদক সত্তা ও লেখক সত্তার
মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এখানেই উল্লেখ্য টি.এস. এলিয়টের বিতর্কিত উক্তিটি – “
Some editors are failed writers, but so are most writers.” দৃশ্যমুখের যাত্রাপথ যে
খুব মসৃণ হয়েছে – এমনটি নয় । অনেক চড়াই, উৎরাই, গ্রহণ – বর্জন, ভালোবাসা-বিরহের মধ্য
দিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে তাকে । যতদিন কবি কাম সম্পাদক বাঁচবে, দৃশ্যমুখও বেঁচে থাকার
স্বপ্ন দেখবে। সচেষ্ট থাকবে একটি রুচিশীল, নিজস্ব কন্ঠস্বর এবং এক অনন্য সত্তাকে টিকিয়ে
রাখতে ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন