আফসার আলির কথা
আফসার আলির সঙ্গে
আমারএকদিন দেখা হয়েছিল, আপনারও যে-কোনো দিন দেখা হয়ে যেতে পারে। একদুপুরে আফসার আলি আমারবাড়িরদরজায় ঠোকা
মারে দেখি, একজোড়া চোখ চশমার ওপর
দিয়ে উৎকণ্ঠার সঙ্গে উঁকি মারছে।
---দাদা, ঘর ভাড়া পাওয়া যাবে? বাইরে টু-লেট লাগানো দেখছি !
--- যাবে।
ভেতরে নিয়ে বসালাম।
- কে থাকবে?
- আমি, আমার স্ত্রী আর দু’বছরের মেয়ে।
- আপনি কী করেন?
- কলেজে পড়াই।
- পার্মানেন্ট?
- না?...পার্টটাইম।
- আপনার নাম?
- আফসার আলি।
- আচ্ছা। ফোন নম্বরটা রেখে যান দু’একদিনেইফোন করে জানিয়ে
দেব।
গল্পটুকু এইটুকুই। এর
আগের গল্পে আফসার আলির সঙ্গে যাদের দেখা হয়েছিল তাদের গল্পটা একটু অন্যরকম
খাওয়া প্রায় শেষের পথে। নাজরিন মাংসের গামেলাটা আবার সামনে আনে,
--- শুভেন্দু-দা, আরেকটু মাংস দেই?
--- না, না! অত খেতেই পারবো না বৌদি!
--- আরে…একটুখানি দেই?
নাজরিন হাতাতে মাংস
তুলে শুভেন্দুর থালার সামনে অপেক্ষামাণ। শুভেন্দু দু'হাত দিয়ে থালা ঢেকে
রেখেছে: না না এক পিসও না।
--- আরে পারবে। দাও তো..! আফসারও জোরাজুরি শুরু করে।
-- না, বৌদি এক পিসও না। মুকুন্দকে দাও। ও মাংস খুব ভালোবাসে।
-- আচ্ছা, আমার একটা অনুরোধ, এক পিস নাও, আর জোর করব না।
শুভেন্দু নিরুপায়। নাজরিন এক পিসের জায়গায় তিন পিস ঢেলে দিল। শুভেন্দুর মুখে: ইস,বৌদি কী যে করেন, খেতে পারব না!
তারপর মুকুন্দ, মিহির সকলকেই আবার
পুনরায় বাটি ভর্তি করে মাংস দিল।এরপর এল ক্ষীর দই, রসগোল্লা। আলিপুরদুয়ার থেকে স্পেশালি আনিয়েছে---সে এক জমপেশ খাওয়া দাওয়ার আয়োজন।মিহির মাংসের হাড়ের ভেতর তরলটুকু চুষতে চুষতে বলে: আফসার-দা মাঝে মাঝে এভাবে আমাদের নেমতন্ন করে
খায়িও!
এরপরখাওয়া-দাওয়ার পাট
চুকে গেলে আফসারের কলিগ-অতিথিরা বিদেয় হয়।
আফসার আলির আজ তৃতীয়
বিবাহ বার্ষিকী। তেমন কাওকেই নেমতন্ন করেনি। কেবল কলেজের এই তিন সহকর্মীকে ছাড়া ভাড়াটে বাড়ির মালিককে বলেছিল। মালিক-মালকিন এসেছিলেন উপহার নিয়ে। খেয়ে-দেয়ে আশীর্বাদ করে
পান চিবোতে চিবোতে আবার উপরে উঠে গেছেন।
আফসার আলির বয়স বত্রিশ, স্ত্রী নাজরিনের
পঁচিশ-ছাব্বিস হতে পারে। কলেজের সমাজবিদ্যার চুক্তিভিত্তিক অধ্যাপক। মাইনে কুঁড়ি হাজার কিংবা তারও কিছু অধিক। পাঁচ বছর ধরে এই বাড়ির ভাড়াটে তবে এই শহরটার সঙ্গে সম্পর্ক অনেক দিনের। শহর থেকেই মফসসলের কলেজে পড়াতে যায়। স্ত্রী সারাদিন একা থাকে দু'বছরের কন্যাকে নিয়ে, মাঝে স্কুল সার্ভিসের প্রস্তুতি নেয়।
নিচতলার দু'কামড়ার ঘরের হাজার
তিনেক টাকা ভাড়া দেয়। আজ ঘরটি সুন্দর করে
সাজিয়েছে। রঙিন আলো বেলুন আর খাটের চার
কোণায় ঝুলিয়ে দিয়েছে রজনীগন্ধা। স্ত্রীর জন্য পছন্দ করে
শাড়ি এনেছে, মেয়ের জন্য দু'সেট জামা প্যান্ট। নাজরিন আজ নিজে-কে সাজিয়েছে, শরীরে মেখেছে সুগন্ধী। যতই হোক আজ বিশেষ দিন বলে কথা! আফসার আলী এসবের মধ্যেই
স্ত্রীকে খুশি রাখতে চেষ্টা করে, বিয়ের আগে দেওয়া কথাগুলো
রাখতে চেষ্টা করে। ফুটফুটেমেয়েটিকে আদর।
সাত সকালে আফসার আলির
দরজায় ঘা পড়ল। ‘আফসার? আফসার’? বাইরে থেকে বাড়ির
মালিকের ডাক। আফসারের ঘুম ভেঙেছে
অনেক আগেই। বিছানায় শুয়ে শুয়েই
গতরাতে আপলোড করা হোয়াটস অ্যাপ স্টেটাসের রিপ্লাই গুলো দেখছিল।
দরজার ছিটকিনি খুলতেই
সূর্যের কিরণ তার মুখে ওপর এসে পড়ল। বেশ বেলা হয়ে গেছে। ‘শোন আফসার, ঘরটা ছেড়ে দিতে হবে দু’দিনের মধ্যে!’
আফসার এই কথাটি শোনার
জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলনা। কী বলবে সেটা গুছিয়ে ওঠার আগে বাড়ির মালিক
আবার বলল ‘দু’দিনের মধ্যে একটা বাড়ি দেখেনা ও!’ বাড়ির মালিক আবার সিড়ি
বেয়ে উপরে উঠে গেল।
আফসার এই কথা শুনতে
যেমন প্রস্তুত ছিলনা, তেমনি হ্যাঁ বা না বলার মতো তার কাছে কিছু ছিলনা।গতকাল রাত পর্যন্ত তো সব ঠিকই ছিল। হঠাৎ মালিক কেন ঘর ছাড়তে বলছে?---এসবের অনুসন্ধানে লেগেছে। নাই-নাই করে পাঁচ বছর এই
বাড়িতে, এই শহরেতো বারো চোদ্দ বছর হবেই। কোনো দিন ভাড়া নিয়েও
কোনো গোল বাঁধেনি, তবে হঠাৎ কেন উঠে যেতে হবে? এসব ভাবতে ভাবতে
টুথব্রাশে পেস্ট লাগিয়ে আফসার বাথরুমে ঢুকে পড়ল।তারপর কমোডের ওপর বসে অনুসন্ধান শুরু করল। কিছুটা পেস্ট মিশ্রিত থু-থু ফেলল তারপর আবার
কার্যকারণ খোঁজা শুরু। কারণ খুঁজতে খুঁজতে সে
ঢুকে পড়ল ক্ষীণ আলোর গলিতে। সেখানেএকদল লোক জমা হয়েছে। একটি লোক মাইকে চিৎকার
করে করে কিছু বলছে, মুহুর্মুহু হাততালি পড়ছে। আফসার শুধু আধোআধো শুনতে পায়: একটারেও রাখমুনা! সব তাড়ামু। এইবার শুধু আসতে দেন!’ লোকটা যে-দলে হয়েগলা ফাটাচ্ছিল, তারাই তো
কিছুদিনপরেইআবার ফিরে আসে ক্ষমতায়।উল্লাসে ফেটেপড়েছিল আকাশ-বাতাস-নদী-নর্দমা--সবকিছু। আফসার লোকটার মুখটা মনে
করার চেষ্টা করে। মুখ-টা খুব চেনা কিন্তু
চেনা নয়। এপাড়াতেই কিওর বাড়ি? আফসার কমোডের সুইচটি টিপে দেয়, সমস্ত কিছু ধুয়ে সাফ
হয়ে যায়।
কলেজ ও টিউশন পড়িয়ে আফসার
বাড়িফিরে নিজের ঘরেনা-ঢুকে সোজা ওপরে উঠে গেল। মালিকের দরজায় ঠোকা মারতেই ভেতর থেকে ছিটকিনি
খোলার শব্দ তারপর দরজা হাঁ-হয়ে ভেতরে যাবার ইশারা।আফসার লাল সোফায় বসে
ব্যাগটি নামিয়ে রাখে পাশে । মালিক এসে বসে অন্য একটি সোফায়। আফসার কোনো রকম ভনিতানা-করেই বলল,
--দাদা, বলুনতো…….!
আফসারের মুখের কথাটা
কেড়ে নিয়ে মালিক বলল: আফসার আমি সব জানি। সব বুঝি! ওরা না-হলে আমার চলাফেরা বন্ধ
করে দেবে, আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
--- ওরা কারা? আফসার জানতে চায়।
--- ওরা তোমার আমার মতোই
কতগুলো মানুষ!
আফসার কিছুক্ষণ চুপ করে
থাকে , তারপর উঠে আসে। শুধু বলে আসে: ঠিক আছে!
গল্পটা কিন্তু এখানেই
শেষ হতে পারত কিন্তু শেষ হল না।আফসার আলির গল্পটা চলতেই
থাকল।আমি পরদিন চিরকুট থেকে আফসার আলির নম্বরটা ডায়েল করি। আমার কথার জবারে ওপাশ
থেকে আফসার শুধু বলে: ঠিকআছে!এরপর থেকে আফসার আলির সঙ্গে রোজ দেখা হয়, মাঝে মাঝেই একসাথে বসে
চায়ের কাপে চুমুক দিই, বাড়িতে বাৎসরিক পুজা হলে, আফসার আলিকে ডেকে বলি : ‘চলো আফসার, প্রতিমাটা একটু ধরতে হবে। একা পারবো না।'
এরপর থেকে আফসার আলির সঙ্গে রোজ দেখা হয়, মাঝে মাঝেই একসাথে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিই, বাড়িতে বাৎসরিক পুজা হলে, আফসার আলিকে ডেকে বলি : ‘চলো আফসার, প্রতিমাটা একটু ধরতে হবে। একা পারবো না।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ ❤
পরবর্তী লেখার অপেক্ষায় থাকলাম দাদা।
অবশ্যই দেব।
মুছুন