চলতে থাকে নিয়ত আমার দুই সত্তার দ্বন্দ্ব, আমার স্খলন।
আবেগকে সম্বল করেই একটি স্বপ্নের উত্থান।পুঁজি মূলত শূন্য।
২০১১ সাল।
সম্পাদক হিসেবে আমার আবির্ভাব। যে স্বপ্ন নিয়ে শুরু সেটা অধরাই হয়তো। তবু ভূমিষ্ঠ হয়েছে উত্তরের সৃজন। এর আগে জনাছয়ের বন্ধু আর একটি দেওয়াল ম্যাগাজিন। নিয়মিত কয়েক বছর। সেই ম্যাগাজিনও পাঠকপ্রিয় হয়।উচ্চশিক্ষার জন্য শহর ছাড়তে হয় আমাকে আর বাকীদের উৎসাহে ভাটা পড়তে খুব বেশি সময় লাগলো না ফলে সেই পত্রিকাও পড়লো মুখ থুবড়ে
পড়াশোনার বিরতি পর্বে বাড়ীতে ফিরে একটু নতুনভাবে ভাবছি দেওয়াল পত্রিকার সংক্ষিপ্ত পরিসরে বাইরে গিয়ে একটি লিটল ম্যাগাজিন করার। সে-ই শুরু। আজও চলছে। তবে অনিয়মিত।
একটা উদ্বিপনা বরাবরই আমাকে তারিয়ে বেড়ায় । ২০১৪ সাল। আবার আরও একটি নতুন পত্রিকা। শব্দবাউল অনেকটা পরিস্থিতির চাপে বাধ্যতামূলক ভাবে করতে হল। কেন? কি বাধ্যবাধকতা? সে না হয় অন্যকোন দিন... এখন প্রায় নিয়মিতই হচ্ছে।অনলাইনেও প্রতিমাসে শব্দ-বাউল পত্রিকা। এবং নিয়মিত। আর প্রতি সপ্তাহান্তে শব্দ-বাউল ভিডিও ম্যাগাজিন। নতুন এক ধারনা। এখন অনেকেই এর প্রতি আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
যাক, ততদিনে বুঝতে শিখেছি সাহিত্য ম্যাগাজিন ও লিটল ম্যাগাজিনের মধ্যেকার ফারাক । জানা হয়েছে আর অনেক ধারণার যাবতীয় ভুলভ্রান্তি। যেমন...'দি ডায়াল’-কে পৃথিবীর প্রথম লিটল ম্যাগাজিন বলা হয়ে থাকে। সম্পাদক ছিলেন রালফ ওয়াল্ডো ও মার্গারেট ফুলার।পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠস্বর ছিল আর একটি পত্রিকা। নাম 'সেভয়'। আরও পত্রিকা হেরিয়েট মনরো ও এজরা পাউন্ড-র সম্পাদনায় ১৯১২ সালে প্রকাশিত হয়। নাম ‘পোয়েট্রি’। সেই পত্রিকাকে বলা হতো 'এ ম্যাগাজিন অফ ভার্স’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমাদের দেশে লিটল ম্যাগাজিন মূলত বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরেই প্রবেশ করে১৮৭২ সালে 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকাএই পত্রিকাকে বাংলার প্রথম লিটল ম্যাগাজিন বলা হয়ে থাকে। যদিও ১৯১৪ সালে প্রকাশিত 'সবুজপত্র' এই পত্রিকাতেই প্রথম দেখা যায় প্রথা ভাঙ্গার প্রয়াস এবং 'সবুজপত্র' এক মননশীল পত্রিকাও বটে। যাকে যথার্থ লিটল ম্যাগাজিন বলা যায় । সম্পাদক ছিলেন প্রমথ চৌধুরী।
ভাবছেন ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি কেন? আসলে লিটল ম্যাগাজিনের আলোচনা আসলেই, লিটল ম্যাগাজিন সম্পর্কে বুদ্ধদেব বসু’র সেই কথাটাই ভীড় করে মনের ভেতর...
"...এক রকমের পত্রিকা আছে যা স্টেশনে পাওয়া যায় না, ফুটপাতে কিনতে হলেও বিস্তর ঘুরতে হয়, কিন্তু যা একবার হাতে এলে আমরা চোখ বুলিয়ে সরিয়ে রাখি না, চেয়ে চেয়ে আস্তে আস্তে পড়ি, আর পড়া হয়ে গেলে গরম কাপড়ের ভাঁজের মধ্যে ন্যাপথলিন-গন্ধী তোরঙ্গে তুলে রাখি- জল, পোকা, আর অপহারকের আক্রমণ থেকে বাঁচবার জন্য। (দেশ,১৯৫৩)। এই কারণ গুলোই নিয়ত উদ্বুদ্ধ করেছে আমাকে পত্রিকা করার ক্ষেত্রে।
চলুন আবার একটু পিছন ফিরে দেখি।
ছোট বেলায় দেখতাম বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার দেওয়া হত বই এখন সেই প্রথা প্রায় উঠেই গেছে, বছরের একটা বড়ো সময় আমরা নানান বই উপহার পেয়েছি. আর বাড়িতে নিয়মিত আসতো শুকতারা, আনন্দমেলা, সন্দেশ, কিশোরভারতী, ছোটদের পত্রিকা. নানান রূপকথার বই, কার্টুন, কমিক্স ইত্যাদি এছাড়াও বড়দের কিছু পত্রিকাও আসতো। যেমন দেশ, সানন্দা, নবকল্লোল ইত্যাদি। মা-বাবাকে দেখেছি নিয়মিত নানান বই পড়তেন, প্রিয়জনদের উপহার দিতেন বই।
মা-র কাছে আমরা ভাইবোনেরা গল্প তো শুনতাম-ই কখনো কখনো প্রতিবেশী সমবয়সীরা ভীড় জমত. মা আমাদের বই থেকে পড়ে শোনাতেন- রামায়ণ মহাভারত এমনকি রবীন্দ্র,শরৎচন্দ্র সহ নানান লেখকের গল্পও. নানান স্মরণীয় ও আবিষ্কারের গল্প বলতেন। রাতে শুয়ে শুয়ে বই পড়তাম। আর পড়তে পড়তেই ঘুমিয়ে পড়তাম।সেই অভ্যাসটা আজও আমাদের ভাইবোনদের মধ্যে রয়ে গেছে. রাতে ঘুমানোর আগে কোন না কোন বইয়ের পাতায়, চোখ না বোলালে আমাদের ঘুম-ই আসেনা।
২০১০- ১১ সাল। আমি কলকাতা চলে আসি। উদ্দেশ্য মূলত পড়াশোনা । পারিবারিক সূত্রেই পাওয়া বই পড়ার সেই অভ্যাস আমাকে এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দিল। প্রচুর বই। দেশীবিদেশী সাহিত্যের ভান্ডার খুলে গেল আমার সামনে. আর হ্যা, সুযোগ এলো ভালো ভালো নাটক দেখার. নাটকের দলের সঙ্গেও জড়িয়ে গেলাম নাটকের সম্পাদনা, স্ক্রীপ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করে কিছু আর্থিক উপার্জনও হল।বিভিন্ন নাটকের পত্রিকা থেকে আসতে লাগললেখার আবেদন ফলে লেখার সাথে সাথে প্রচুর পড়েছি আর সেই সময় আমার লেখালেখির সময় বাস্তবিকই দু'হাতে লিখেছিও প্রচুর. তার বেশীটাই ভুলভাল লেখা হয়তো।
কেন এমনটা বলছি, তার কারণ লেখালেখি আর পড়াশোনা সূত্রে লোকের সাথে যোগাযোগও বেড়েছে। পত্রিকার সূত্রেই একজনের সঙ্গে আলাপ হলো। কিন্তু তার পত্রিকা এবং লেখালেখি সম্পর্কে জ্ঞান খুবই সীমিত। তিনি আমাকে তার পত্রিকার দায়িত্ব নিতে বললেন। টাকা-পয়সার জন্য কোন চিন্তা করতে হবেনা। তার শুধু চাই সামাজিক স্ট্যাটাস। অনেকটা বাধ্য হয়েই পত্রিকার দায়িত্ব নিলাম। ওই পত্রিকার প্রায় সবই আমাকে করতে হয়েছিল। এমনকি সম্পাদকীয় পর্যন্ত লিখতে হয়েছিল আমাকেই। এই কাজটি করতে গিয়ে একদিকে লাভ কিন্তু আমার-ই হল। প্রেসমালিক, কম্পোজিটর, বাইন্ডার,ডিটিপি অপারেটর থেকে কাগজে দোকানে সাথে সখ্যতা তৈরী হল। এটা ছিলো আমার একটা বড় প্রাপ্তি। তাদের কারো কারোর সাথে যোগাযোগ আজও আছে। যাক কাগজটা খুবই প্রশংসা পায়। সম্পাদক খুব খুশি। নিজেই হিসেবে মতো সবটাকা মিটিয়েও আমাকে দুই হাজার টাকা বেশি দিলেন। আর তার দৌলতে পরিচয় এমনই কিছু পত্রিকা সম্পাদকের সাথে। এই পত্রিকা-র কাজ করে কমবেশি পয়সা যা পাচ্ছি তা দিয়ে-ই বই কিনছি। কিন্তু এই কাজও বেশি দিন ভালো লাগলো না। তারপর ফিল্যান্স লেখক হিসেবেও প্রচুর পত্রিকা-সংবাদপত্রে লিখেছি। সব তো আর লেখা যায়না। আর লিখতে গেলে রিম রিম কাগজও অ-সংকুলান মনে হবে।
সম্পাদক হিসেবে আমার প্রাপ্তি ঝুলিটা একটু ভারী-ই বটে। সে সময় আনকোরা এক সম্পাদক শুধু আবেগ সম্বল করে নেমে পড়লো পত্রিকা করতে। কাউকেই সে রকম চেনেনা। আর সে সময় লেখা সংগ্রহ এতো সহজ ছিল না। পরিচয় ও ছিলো না। তবুও সেসময় আমি অযাচিতভাবে অনেককে পাশে পেয়েছি। আমার কলেজের বন্ধুরা সবসময় আমার সামনে থেকে উৎসাহ দিয়ে গেছে নিঃস্বার্থে। আর্থিক সহায়তাও করেছে তারা।
সম্পাদনা করার পিছনে কি যুক্তি কাজ করেছিলো আজ আর তা মনে নেই। তবে সম্পাদক হিসেবে আমার ভালো-মন্দ দুটি দিকেই রয়েছে নিঃসন্দেহে। ভালো সম্পাদক যেমন হতে পারিনি তেমনি ভালো লেখকও। তবু্ও আমি নিঃর্স্বাথে যেটা করার চেষ্টা করেছি সেটা এই সম্পাদনা। সম্পাদনার প্রয়োজনে যেমন প্রচুর পড়েছি, জেনেছি। এমনকি নিজের লেখালেখিকেও একসময় দুরে সরিয়ে রেখেছি এই সম্পাদনার জন্য। একটি সংখ্যা প্রকাশ হবার আগে থেকেই পরের সংখ্যার ভাবনা এসে ভীড় জমায়। চলতে থাকে নিয়ত আমার দুই সত্তার দ্বন্দ্ব, আমার স্খলন।
আজকে যখন দেখি কিছু কিছু সম্পাদক অনেকটা সেই ক্যাটারিং সিস্টেমের মতো পত্রিকা করছেন। লিটল ম্যাগাজিনের সেই শ্রদ্ধা, আবেগ আর নেই, পত্রিকার প্যাশন এখন বদলে গেছে ফ্যাশনে। লিটল ম্যাগাজিনের দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাস কী এভাবেই খর্ব হবে. তবে সমাজের অসংলগ্নতার দিকে আঙুল তুলে দেখাবে কারা?...
সম্পাদকীয় আজকাল তেমন কেউ আর পড়েন না। তবু ছোট্ট করে এই প্রশ্নটা রেখে গেলাম।
সকলকে শুভেচ্ছা
ভালো থাকবেন...