শুক্রবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২৩

সমর দেব-র গল্প "অন্ধকারের বিন্দু"




 অন্ধকারের বিন্দু


'তুই সবচেয়ে সুখী হবি’—চার্মিনারে শেষ টান দেবার মুহূর্তে অভিমন্যুর কথা মনে পড়লে, সে ঊনত্রিশ বছরের যুবক, মায়ের একদা বলা কথাটা মনের পর্দায় ছবির মতো ভেসে উঠেছিল। একটু আগেই চলে গেছে নবনীতা। এখনও ঘরের ভেতরে নবনীতার গন্ধটার উগ্র উপস্থিতি। মেঝের এক কোণে অবহেলায় পড়ে আছে নবনীতার রঙিন হাওয়াই জোড়া, একটার গোড়ালির দিকটা অস্বাভাবিকভাবেই অন্যটার চেয়ে অসমান্তরাল অবস্থানে। ওটা তো উলটেও পড়ে থাকতে পারত। বিশেষত, শেষমুহূর্তে যে-ধরনের উত্তেজনা জমাট হয়ে উঠেছিল, নবনীতার বুক যেভাবে প্রবল শ্বাসাঘাতে উথাপাথাল করছিল, তাতে অস্থির দ্রুততায় পা থেকে হাওয়াই জোড়া ছুঁড়ে ফেলতে গিয়ে অন্তত একটা হাওয়াই আরও দূরে ছিটকে গিয়ে উলটে গেলেই যেন ভালো হতো। অথচ, সেরকম না হওয়ায় অভিমন্যুর মনে একটা দারুণ খচখচে অনুভূতি কাঁটার মতো বিঁধতে থাকে। আর, দেখো, বিছানার ওপরে নবনীতার ছেড়ে যাওয়া জামা, অন্তর্বাস কেমন নিষ্প্রাণ পড়ে আছে। ওসবের চেহারাটা মালিকানাহীন লাগেজের মতো, যেন পরিত্যক্ত, অবহেলাপ্রসূত, জীবনের স্পর্শহীন, নিক্ষিপ্ত। কপালে হাত রেখে অভিমন্যু ভাবে, আর কি অন্য কিছু সম্ভব? মায়ের বলা কথাটা ভেসে ওঠেতুই সবচেয়ে সুখী

হবি। পরবর্তী দৃশ্য হিসেবে পর্দায় ভেসে ওঠে মায়ের মুখটা। এখন মায়ের জরাজীর্ণ, বলিরেখাযুক্ত মুখে সেই শৈশবের দেখা উজ্জ্বল দুটো চোখ বড়ো নির্জীব, সাম্প্রতিক অসম্ভব রকমের ধূসর দেখায় ; দন্তহীন মাড়ি, তবু এখনও অনেক চুল, পিঠ ছাপানো হয়তো নয়, তারপরও এখনও অনেক চুলই কালো ; চুলের সবটা এখনও পাকেনি; অতএব কিঞ্চিৎ মসৃণতাও দুর্লক্ষ্য নয়। এবং এখনও বার্ধক্যশাসিত মুখে, শৈশবের একদা চিনে নেওয়া মুখের সেই আদল, আজও ঠিকঠাক চিনে নিতে পারে অভিমন্যু 

গতকাল বৃষ্টি পড়েছে  খুব, একটানা মুষলধারে, ঝমঝম, ঝরঝর, অবিরাম ঘণ্টা দুয়েক ; অথচ চৈত্র মাস; বৃষ্টির আগেই মাটি খাঁ খাঁ করছিল, অজস্র বলিরেখা, কোষে কোষে ক্ষয়, নিয়তির মতো। ফুটিফাটা মাটিতে বিচিত্র মানচিত্র। বৃষ্টির পর, এখন মাটি নরম, ভেজা ভেজা, শ্যামল, কোমল, আসন্নপ্রসবা রমণীর স্তনের মতো করুণায় আর্দ্র যেন বা। এখন আকাশ পরিষ্কার, মেঘহীন, নীলচে আভাযুক্ত, অমলিন, ঝকঝকে। নবনীতার আয়ত চক্ষু যেন-বা, চকচকে, দীপ্ত, গভীর, রহস্যমাখা, অচঞ্চল, গাঢ় কাজলচর্চিত, মেদুর। সে, অভিমন্যু, একমনে আকাশ দেখে, আকাশের ব্যাপ্ত নীলিমা দেখে, দূর দেখে, রূপকথার মতো মেদুরতা দেখে, মায়ের মুখ দেখে, নবনীতার মুখ দেখে। গ্রিলের বাইরে সময়ে আকাশে পাখি ওড়ে, আলো কমে এসেছে, মৃদু হাওয়া বইতে থাকে, হাওয়ায় পতপত ওড়ে খোলা জানালার পর্দা। ঘরে ফেরে বকপাখির দল। বেলা পড়ে আসছে দ্রুত, নিঃশব্দে চুপি চুপি ; তাতে গোপনতা আছে, সাবধানতা আছে, ফিসফিসানি আছে। সায়াহ্ণের মন্থরতা টের পায় অভিমন্যু। তারপরে, একটু একটু করে অন্ধকার নামবে, গাঢ় হয়ে উঠবে আলোহীনতা, শৃগালেরা জাগবে, আড়মোড়া ভাঙবে এবং শিকারে বেরোবে শব্দহীন পায়ে, তাদের কষ বেয়ে লালা গড়াবে, অন্ধকারে জ্বলজ্বল করবে কুতকুতে চোখ, পচা লাশের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে শ্বাপদেরা, শুধু নীরব দর্শক হবে বুড়ো কাল প্যাঁচা, প্রতিবাদহীন, অক্ষম, কিঞ্চিৎ উচ্ছিষ্টলোভী ; অভিমন্যু এসব জানে; জেনেও দেখে কীভাবে দিনের আলো আছড়ে পড়ে রাতের অতল গহ্বরে, অনিবার্য : মৃত্যুর মতো হিম, ব্যাপ্ত হিমযুগে সে দাঁড়িয়ে থাকে। বহুদুরে কোথাও কুকুরের চিৎকার

,আর্তনাদের মতো, কান্নার মতো; তাদের দখল শেষ, এবার এলাকায় দাপিয়ে বেড়াবে দাঁতাল শ্বাপদেরা; এরা সাবধানী, সতর্ক, হিসেবি, চতুর, গোপন আততায়ী যেন-বা, রক্ত হিম করা নখ তাদের ; ভুতুড়ে, রহস্যময় ; যেন-বা অন্ধরাত 

কোনো কোনো রাতে চাঁদ ওঠে, দূর আকাশে ঝুলে থাকে নবনীতার অনির্বচনীয় মুখ, পানপাতার আদলে ; মনে পড়ে শৈশবে চেনা মায়ের মুখদীপ্ত, সাবলীল, সহজ, জলরঙের ছবির মতো, পবিত্র; পৃথিবীর শেষ দৃশ্যের মতো, শেষ আশ্রয়ের মতো, নিভৃত নোঙর, বড়ো নিশ্চিত, বিশ্বস্ত; আপন হৃদপিণ্ডের মতো একান্ত নিজস্ব, গায়ত্রীর মতো সুরেলা, সাবলীল, উদ্গীত, অথচ রক্তের মতো গতিশীল অনুভব, প্রতীতি স্পর্শের রোমাঞ্চ। অভিমন্যু আকাশ দেখে, চাঁদ দেখেপূর্ণিমার চাঁদ ; -চাঁদের কোনো যায় আসে না, অনপেক্ষ তার অনুভব, তার ক্ষমা, তার হৃদয়-বিক্ষত প্রেম। সে বড়ো রক্তাক্ত অনুভব করে, তার কষ্ট হয়, খুব গোপন, অথচ অনিবার্য নিয়তির মতো; উন্মুক্ত আকাশের নিচে সে একাকী দাঁড়িয়ে ; তার বুক বেয়ে গড়িয়ে পড়ে রক্ত, এত ভালোবাসা ; নবনীতা তার কষ্ট, তারই নিজস্ব, একাকী যন্ত্রণা। পূর্ণিমার চাঁদে লেপে থাকে কলঙ্ক, কানাকানি, ফিসফাস ; তবু চাঁদ নির্বিকার, অভিমন্যু তবু ভালোবাসে, বুক দিয়ে আড়াল করে গ্লানি ; সন্তানের প্রতি যেন-বা পিতা; পিতা মানে পালনকর্তা, জনক নয় মোটেই, স্নেহের শাসনে সে আগলে রাখতে চায়; অবুঝ প্রেম, দূরপ্রেরিত মঙ্গলাকাঙক্ষার মতো, গোপন নিঃশব্দ শপথের মতো; হৃদয়ের রক্তাক্ত বাসনা। এখন আরও কমে এসেছে আলো। শেষবেলায় কি আলোহীনতার, আলোর অপস্রিয়মানতার গতি প্রবলতর হয়ে ওঠে? এমন ঘোলাটে আলোয়, আলোহীনতায় ক্লান্তি, ক্লিষ্টতা, মন্থরতা। অভিমন্যুর চারপাশে অন্ধকারের হালকা চাদর; গভীর লবণাক্ত জলের আড়াল থেকে আকস্মিক উঠে আসা হানাদার হিংস্র হাঙরের দাঁতের মতো ধারালো, তস্করের মতো চুপিসার, গোপন, যেন-বা কালপ্যাঁচা, অশুভ বার্তাবহ, তীব্র বিষ, মৃত্যুদূত, যেন-বা কালান্তক কালকূট, অমঙ্গলের অমোঘ পরোয়ানা অন্ধকার চাদরে মুখঢাকা আততায়ীর মতো ঘোর নৃশংস, কোপন, নিঃসাড়; সন্তর্পণে শ্বাপদেরা ঘুরে বেড়াবে ইতিউতি। আদিম কামুক বাতাসের নখ ছিঁড়ে ফেলবে চাঁদের কোমল শরীর। কুৎসিত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে চাঁদ, অসহায় বালিকা। চাঁদের চোখে লবণাক্ত অশ্রু, গভীর যন্ত্রণাদীর্ণ মুখ ; সভ্যতায় সর্বনাশের আঁচড়, গ্লানি, ক্লেদাক্ত মুখে অহংকার বিচূর্ণীভূত; এমন পরাভব, করুণ পরিণতি, ট্র্যাজেডির আঁশটে গন্ধে যৌবনের অপরিমাণ ক্ষয়। অথচ, চাঁদের -মুখ, যেন-বা নবনীতা, ভেজা বারুদের স্বাদমাখা প্রেম, ভালোবাসার গোপন রক্তক্ষরণ ; আত্মহত্যার মতো, যেরকম আত্মহত্যা আটাশ ক্যাম্পোজে, বড়ো কাঙ্ক্ষিত ছিল সেই ঘুম; নবনীতা আজও জানে না, জানবে না কোনোদিনও, তবু সেই বহুকাঙিক্ষত শেষঘুমে সর্বশেষ দৃশ্য হয়ে জেগে থাকে নবনীতা ; সেই চাঁদ, পূর্ণিমার চাঁদ : সেদিন জ্যোৎস্না উঠেছিল

'তুমি আমাকে ফিল করো না'—-রকমই প্রায়ান্ধকারে নবনীতা নিরুত্তর, পটে আঁকা ছবি ; ঈষৎ গম্ভীর, অনুযোগে অকম্প, আজও স্পষ্ট ; অথচ সে, অভিমন্যু আকুল, অসহায়, নিবেদিত, ভেঙে খানখান। একটু আশ্রয় দেয়নি নবনীতা, একটু ভালোবাসা, সহজ উষ্ণতা ; অথচ সে, অভিমন্যু জানু ভেঙে যেন-বা মার্জনা ভিক্ষা অথবা করুণা ভিক্ষা ; তারপরই আত্মদর্শনে স্তম্ভিত, একটু ভালোবাসা চেয়েছিল, নারীর কাছে পুরুষের আদি অন্ধ বাসনার মতো। মনে পড়েছিল শৈশব, যৌবনের চেয়ে অসহায় ছিল না, এমন অন্ধরাত ছিল না, হিম ছিল না, শ্বাপদের আনাগোনাহীন, রৌদ্রালোকিত উন্মুক্ত প্রান্তর ; অথচ মোম নিয়ে দাঁড়িয়েছিল নবনীতা। 'তুই সুখী হবি’—গুণিনের বাণের মতো অদৃশ্য অথচ অমোঘ, নির্মমতা ; নিঃশব্দ পশ্চাদানুগমন, গোপন আততায়ী যেন-বা, মৃত্যুর মতো পশ্চাদ্ধাবনকারী, আলেয়া, ভ্রম; ভ্রমস্বপ্নে রঙিন ফানুস ; অভিমন্যু বিভ্রমে হেঁটেছিল

আর ফিরবে না নবনীতা, নিশ্চিতই। অভিমন্যুর চারপাশে নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে মৃত্যুর পদশব্দ, শ্মশানে অশরীরী যন্ত্রণার ফিসফাস, মাংসের পোড়া ঘ্রাণ, মাথার ওপরে অবিরত উড়তে থাকে শকুন, বাতাসে গোপন শলা-পরামর্শের ঠাণ্ডা হিমস্রোত; দ্রুত একা মনে হয়, সঙ্গীহীন, প্রেমহীন, নিরাশ্রয়, উষ্ণতাহীন অথবা অবর্ণনীয় ফারেনহাইট ; সে একা পুড়তে থাকে। অথচ, ওষুধ ছিল, নিরাময় ছিল, উন্মুক্ত উদার আকাশ ছিল ; অন্ধকার সরিয়ে দেবার মোম ছিল নবনীতার কাছে। একবুক মোম নিয়ে নবনীতা অন্যত্র জ্বেলে দেয়, দূরবর্তী সেই মোমের আগুনে পুড়তে থাকে অভিমন্যু, আবহমানকাল, অমোঘ, প্রতিরোধহীন যেন-বা; পরাঙ্মুখ  প্রাণ, জীবনের স্পন্দনহীন, নিথর, জরদ্গব। মনে পড়ে নির্মম সত্যকথন, 'ফিল করো না'--- অভিমন্যু বাতাসের দিকে চেয়ে থাকে অপলক, নির্নিমেষ; পরাভূত, শৃংখলিত, রক্তাক্ত, আশাহত; কী- বা করার থাকে, অসহায় সে অভিমন্যু, সপ্তরথী বেষ্টিত, খোঁজে শেষবারের মতো, একটু শান্তি, একটু স্বস্তি, একটু নিরুদ্বেগ; প্রিয় নারীর বুকে স্থির, স্থিত আশ্রয়; ক্লান্ত, বড়ো ক্লান্ত বোধ করে সে। তবু নবনীতা পরিতাপহীন, স্মৃতিহীন, পরাঙ্মুখ, হয়তো অহংকারীও ; অভিমন্যু মৃত্যুর বিভীষিকা দেখে

শহরে অন্ধকার। গোপন সন্ত্রাসের মতো, আত্মগোপনকারী, কাপুরুষ, লুম্পেন বুদ্ধিজীবী, বিমার দালাল, মূর্খ অধ্যাপক, কৃমিকীট, যেন-বা মাফিয়া, অন্তর্ঘাতমূলক, গোপনে গভীর ক্ষয়কারী। অভিমন্যুর চারপাশে লেপটে থাকে অন্ধকার শহর, ঘিনঘিনে বমনোদ্রেগকারী; অথচ মেধাহীন, নিঃস্ব, ভিখিরি, যেন-বা; আর, এই ঘৃণ্য অন্ধকারে নাট্যমঞ্চ, সিনেমা হল, শহরের নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান; নিরুদ্ধ, স্থবির, পতনোন্মুখ, জরাগ্রস্ত, মৃত্যুভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত; সামনে যেন-বা ফাঁসিগাছ, মৃত্যুর মুখোমুখি ইতর প্রাণীদের শেষ সঙ্গম প্রচেষ্টা; ওয়াক থুঃ!

গতকালের মুষলধারা বৃষ্টিতে গাছের পাতা, ঘাস, পাকা সড়কের ঘন কালো অ্যাসফল্টসব ধুয়ে গেছে। চরাচরে প্রাণের সাড়, সেরকম সহজ স্বাভাবিক নয় যদিও, এমনকি ততটা জীবন্তও নয়; ধীর, শান্ত, ঘুমের ওপার থেকে জেগে ওঠা যেন-বা, চোখ তখনও নিরুন্মিলিত, কম্পনরহিত --- যেমন হয়েছিল আটাশ ক্যাম্পোজেঅভিমন্যু শেষবারের মতো ঘুমিয়ে পড়েছিল, অথচ বহুকাঙ্ক্ষিত সেই ঘুম, অবিচ্ছিন্ন, ভগ্ন, অস্থির, অশান্ত, নবনীতা যেন-বা, ভয়ানক প্রলোভনের মতো, স্বপ্নের মতো, ধোঁয়াশা, মৃদু, উত্তাপহীন, শান্ত জলছবি; অস্থায়ী, ক্ষণপ্রভ বিদ্যুচ্চমকের মতো; তবু রহস্যময় ; অভিমন্যু দূর আহ্বান  শুনেছিল, মৃত্যুর হাতছানি দেখেছিল, যেরকম শব্দহীন ডেকেছিল নবনীতা, অমোঘ সময়ের মতো; বড়ো মোহময় সেই ডাক, কুয়াশা জড়ানো ভোরের মতো, তাতে নবনীতা ছিল, আশা ছিল, সম্ভাবনা ছিল। আশ্রয়ের আহ্বান ছিল, যেন-বা প্রেমও ছিল, অনিঃশেষ, মধুর, রোমাঞ্চকর। অভিমন্যু উৎস চিনেছিল, আদিম অরণ্যগভীরে মোহময় গান গেয়েছিল নারী, নবনীতা; স্বপ্নের মতো মনে হয়, তবু আংশিক সত্য, ক্ষণসত্য; করাল রাত্রির বুক চিরে তীক্ষ্ণ বিদ্যুতের প্রভা, চরাচর খানখান হয়েছিল। সেই আলোয় চকিতে আত্মদর্শন, কত যুগ যেন পেরিয়ে আসা স্মৃতি, শৈশব, কৈশোর, নবনীতার আয়নায় প্রতিবিম্বিত হয়েছিল, -কারণে অভিমন্যু পুলকিত, রোমাঞ্চিত, অভিভূত ; জীবনকে ভালোবেসেছিল, নবনীতা যেন তারই নিজের আত্মার অকপট উন্মোচন, আত্মার অন্তহীন সুরেলা সংগীত। অথচ, এখন বিভ্রম, এখন ত্রাস, এখন নিকষ অন্ধকার; অন্ধকারে নবনীতার গালে রুজ, অধরোষ্ঠে ভারী লিপস্টিক, বাহারি পোশাকে

দূর নক্ষত্রগামী যেন বা, যে-নক্ষত্র মরে গেছে, হেজে গেছে; নবনীতা ভুল ছবি আঁকে, ভুল আত্মপ্রতিকৃতি আঁকে। সে অন্ধকারে হেঁটে যায় অনায়াস, ভ্রুক্ষেপহীন, সাবলীল;

অন্ধকারের গোপনে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে কালপ্যাঁচা, তার মাথার ওপরে উড়ে

উড়ে ঘুরে ঘুরে চক্কর খায় নোংরা শকুন, লোলুপ শেয়াল তাকে অনুসরণ করে ; অথচ

এসব জানে না নবনীতা, সে বালিকা, অনভিজ্ঞ একথাও বিশ্বাসের অতীত, অযৌক্তিক

বিমৃঢ়তা যেন; এক অমোঘতা, অনিবার্যতা যেন; দুর্দম তার অন্ধচলা

পথের একপ্রান্তে দিঘলিপুখুরি, কে- বা নিশ্চিত করে বলতে পারে, কেননা দিঘলিপুখুরি পেরিয়েও তো যাওয়া সম্ভব, এদিকে-ওদিকে, সর্বত্রই; অতএব শহরের কোথাও তো কারাগার, স্থানান্তর সত্ত্বেও; আর সেখানে প্রতিটি কুঠুরিতে প্রাচীর ভাঙার মন্ত্রণা ; অথচ বেয়নেট-হ্রাস, বারুদের গন্ধ, হিংস্র পাশবিকতা ; গেস্টাপো-ত্রাস; দুর্গন্ধ, জীবনের পচে যাওয়া ঘ্রাণ, অবরুদ্ধ বাতাসে মৃত্যুর পাঁশুটে গন্ধ। সামান্য কয়েক মিটার, তারপরই রবীন্দ্রভবনতাঁর খাসতালুক ভারতবর্ষময় ; সুসংহত, নিয়মানুগত, পারম্পর্যহীন, উন্মার্গগামী। ওপাশে, পুকুরপারে রাধাগোবিন্দের প্রতিমূর্তি, কৃষ্ণবর্ণ, গোদা গোদা ভাস্কর্য, এখন মহাপুরুষ লোহার খাঁচায় বন্দি, আপামর মানুষের সংস্পর্শহীন, পাথুরে, নিষ্প্রাণ, অতএব অসুন্দর, বিকৃত, কুৎসিত। জীবনের লীলায়িত সৌন্দর্য সেখানে অনুপস্থিত, বড়ো মাপের মানুষকে ক্ষুদ্রত্বে বন্দির প্রচেষ্টা; ইস, খুব কষ্ট হয় ; সারা দেশেই বড়োমানুষদের এভাবে অপমানের অজস্র প্রচেষ্টা। - কি সেই সুখী হওয়া ? হায়, তাঁরা তো জানতেন না এবম্বিধ করুণ পরিণতি। কে সুখী, কারা সুখী ? কেউ কি সেকথা জানে? আর, ওপাশে দেখো সারি সারি অট্টালিকা, পরামর্শসভা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, আফিমের নেশা ধরানো, অথচ কতিপয় আন্তরিক, আলোকপিয়াসি গুরু-শিষ্য ইত্যাদি। এখানেই নবনীতা, অধরোষ্ঠে লিপস্টিক, গালে রুজ, দু-চোখে ঘন কালো রঙের প্রলেপে আচ্ছন্ন সৌন্দর্য, পাহাড়ি পোশাকে চটুল, কলমুখর; যেন-বা মাদকচালিতা, নেশাগ্রস্তা, যেন-বা মৃত্যুকামী; নবনীতা কল্পনার চোখে মারুতি দেখে, নোট দেখে, গগনচুম্বী অট্টালিকার সীমাহীন ঔদ্ধত্যের মতো শিশ্নপরায়ণ পুরুষ দেখে, রুপোলি পর্দায় নিজেরই প্রতিকৃতি দেখে

অভিমন্যু পলকের জন্য দাঁড়ায় এখানে, এই রাস্তার মোড়ে। কেন-না, রাস্তার মোড়ে তোমাকে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে, কোন পথে তুমি যাবে, গম্ভব্য স্থির না করে তুমি স্থবির, অজর, অনড়, স্থানু, জড়দ্গব, হিমশিলা। তুমি তো তা নও; অভিমন্যু তবু থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। চারপাশটা ভাল করে দেখে নিতে চায়। রাস্তাগুলো কোনটা কোনদিকে চলে গেছে উপলব্ধি করে নিতে চায় যেন শেষবারের মতো। আঁতিপাতি করে চারপাশে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়, খোঁজে। তবু নবনীতাকে কোথাও দেখতে পায় না। শেষদৃশ্যের মতো, আটাশ ক্যাম্পোজের সেই অনন্ত পাতালভেদী ঘুমের প্রান্তে শেষ আশ্রয়ের মতো; মনে পড়ে—'তুই সবচেয়ে সুখী হবি', মায়ের প্রতিবিম্ব, নবনীতার বুকের উষ্ণতায় যেন-বা শেষ নোঙর, পানপাতার আদলে মুখ, আয়ত গভীর দুটি চোখ দূর শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত, মোহময় সংগীত নবনীতা—'আমাকে ফিল করো না”, একথায় নিরুত্তর, স্তব্ধ, যেন স্বাভাবিক। তারপর, সেই নাটকের সংলাপের মতো ভাসমান, দুঃসহ বাক্য প্রতিধ্বনি তোলে মুহুর্মূহু, কানে এসে প্রবল হাতুড়ির মতো আঘাত করে অনিবার। কান্না পায় অভিমন্যুর, গোপন অবিরল রক্তপাত, ভেসে ওঠে মোদিগলিয়ানির ক্যানভাস, এমন ভয়ংকর ভালোবাসা, রক্তের লোহিত কণিকাভেদী, আরও, আরও গভীরে, কোষের গভীরে গভীরে, ক্রোমোজমের ডাবল হেলিক্স--- প্যাঁচানো মই, সেই মইয়ের প্যাঁচে প্যাঁচে জড়িয়ে, মেশামেশি, তারপর আরও নৈকট্য ডিএনএ- শেষ বিন্দুতে বিন্দুতে। কেন নয় এমন কাম, ছেদহীন, যতিহীন, অনিঃশেষ ; মৃত্যুর অনন্ত অন্ধকার যেন, মানুষীকে এমন ভালোবেসে, সে অভিমন্যু, বড়ো নিঃস্ব বোধ করে





কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বনিক

  উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বণিক উৎসবের আর মাত্র কয়েকটা দিন, একদম হাতে গোনা।  আর উৎসব  সংখ্যা ছাড়া উৎ...