শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩

অখিল ঘোষ- র গল্প "ডাক''

  

ডাক

 

বেরোবার আগে ট্রাঙ্কের কোণায় ভাঁজ করে রাখা একটা কালচে হয়ে যাওয়া রক্তমাখা কাপড়ের টুকরো বের করে পকেটে পুরে নিল হারু। 

 "তুই খুন হবি।কখন ওর মা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি

 "খুন করে কোন হালায়”---  বলে হারু।  

ওর মা অনুনয় করে বলে, "বাদ দে না ওগুলা। ঝঞ্ঝাটে যাইয়া কাম কি?" 

 "তুমি থাম তো," ধমকে ওঠে হারু, "পনেরো বছর ধইরা বুকের মইধ্যে কী আগুন জ্বলতাছে হেইডা তুমি বুঝ না?”

 " আগুন কি আমার বুকে নাই রে বাপ ! লোকডারে চক্ষের সামনে দাফরাইয়া মরতে দ্যাখলাম। অহন ডরাই, এইসব করতে গিয়া ' যুদি এডা কিছু হইয়া যায় তাইলে আমি কী নিয়া থাকুম?” 

অত ডরাইয়ো না মা, উপরওলার প্রতি ভরসা রাখ। রাবণ-কংসের মতন এ্যাদের বিনাশ একদিন ইবই।"

 

   তুলসীতলায় প্রণাম সেরে, মাকে প্রণাম সেরে বেরিয়ে পড়ল হারু। বাইরে রাস্তাটা ভীষণ রোদ্দুরের আগ্রাসী গহ্বরে হারিয়ে গেছে যেন। গোটা এলাকা জুড়ে শত শত লাল পতাকাগুলোকে কাদের যেন লকলকে রক্তজিহ্বা বলে মনে হচ্ছে। রাস্তার দুপাশে হারুর শ্রমলালিত কালচে সবুজ ধানের গাছগুলো যেন

সেগুলি দেখে, সেগুলির আন্দোলনে--- উষ্ণ বায়ুর প্রক্ষেপণে শিউড়ে শিউড়ে উঠছে। যেতে যেতে ধানগাছগুলির উপর হাত রাখে হারু। লালনকর্তার স্নেহস্পর্শ। বুকটা ওর দুরু দুরু করে ওঠে। ফসল এবার বোধ হয় আর ঘরে তোলা হবে না ওর। গোলায় ওঠার প্রতীক্ষায় থেকে থেকে বোধ হয় মাঠেই শুকোবে এগুলি। অথবা উঠে যাবে অন্য কার গোলায়

 

  হারুর মনে পড়ে যায় তেরো চোদ্দো বছর আগের একটি ঘটনার কথা। ওর জীবনের কিছু কিছু ঘটনা ওর হৃদয়-খুবলানো রক্তে স্মৃতিতে আঁকা হয়ে আছে--- সেরকমই একটি ঘটনা। এই ঘটনাগুলি যদিও বেদনাকে উস্কে দেয়, মনকে ভারাক্রান্ত করে, তবুও হারু নিজের মনে লালন করে চলেছে তাদের অস্তিত্বকে আজও। সময়ের একটা গতি পরিবর্তনের অপেক্ষায় সেসবকে বয়ে বেড়ানোর সমস্ত জ্বালা-বেদনা সয়ে যায় নীরবে

 

   তখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। সেবারও ধানগাছের গোছা হয়েছিল বিশাল বিশাল। শিষ বেরনোর আগে গোটা ক্ষেত হয়ে উঠেছিল কালচে সবুজের সাগর। ক্ষেতের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সেদিকে তাকিয়ে ওর বাবার মুখটা খুশিতে ঝলমল করে উঠতে দেখেছিল সেবার হারু। পাকা ধানের ক্ষেতে মিহি বাতাসের আন্দোলনে সোনালী আভার বিচ্ছুরণ দেখেছিল ওর বাবার মুখমণ্ডলে। তখন বেশ কয়েকদিন ক্ষেতের চারপাশে হেঁটে বেড়িয়ে গান গাইতেও শুনেছিল বাবাকে—'মনরে কৃষিকাজ জান না, এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা' শুনেছে ওর মাকে ডেকে বলতেশুনছ গো! এইবার ধানের যা ফলন হইছে, সারা বছর খাইয়াও বাড়তি হইবো। ভাবতাছি বাড়তি ধান বেইচ্যা চালের টিন কিন্যা রাখুম এই বার। তারপরে ভগমান দিলে পাটের বাজার যদি ওঠে, কাঠ-খুঁটি কিন্যা টিনের ঘর দিমু আগামীবার, তুমি কী কও? কবের থিকা সখ আমার টিনের ঘরে থাকনের

 

   কিন্তু সে ধান আর ঘরে তোলা হয়নি সেবার। ধান কাটার প্রস্তুতি চলছিল। কামারবাড়ি থেকে কাস্তের ধার কাটিয়ে আনা হলবাড়ির বাইরে মলন দেওয়ার জন্য খোলান তৈরি করা হল; একদিন মজুরদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য বেরোচ্ছিল ওর বাবা, এমন সময় হরগোবিন্দ মাস্টারের ভাগ্নে সর্বেশ্বর এসে বলল,  "মামা খবর পাঠিয়েছে, তোমাকে এবার 'বয়কট' করা হয়েছে। কোনও মজুর-কামলা তোমার ক্ষেতেখামারে বা বাড়িতে কাজ করতে পারবে না। কাল পার্টির লোকাল কমিটিতে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে।

 "আমার অপরাদডা কি?" হারুর বাবা গর্জন করে উঠলো। 

"তুমি অন্য পার্টির মিটিং- গিয়েছিলে।” 

 "হেইডা আমার মর্জি। আমি কুন পাট্টির মিডিং মিছিলে যামু না যামু, হেইডা আমার ব্যাপার। আর কামলা-কিষানেরা কি কারোডা খায়, না পরে? আমি ট্যাকা দিমু, তারা কাম করবো। তারা কি পাট্টির গুলাম? আইচ্ছা, দেখন যাইবো অহন, কামলায় কাম করে কিনা। না করে নিজেই করুম। ইঃ! বয়কট করছে, ক্ষ্যামতা দ্যাখাইছে ! এ্যাতো জুলুম ভালা না কইলাম, হরগোবিন মাষ্টাররে কইয়া দিও, দিন এ্যাকদিন ঘুরবো!”

 

   হরগোবিন্দ মাস্টার এই এলাকার লাল পার্টির নেতা। যেদিন থেকে এই পার্টি ক্ষমতায় আছে সেদিন থেকেই তিনি নেতা। অর্থাৎ প্রায় তিরিশ বছর ধরে তিনিই তল্লাটের হর্তা-কর্তা-বিধাতা। কে 'টার্গেট' হবে, কাকে 'বয়কট' করা হবে, কার জমি বিক্রি করলে বা কিনলে ক্রেতা বা বিক্রেতাকে পার্টিফাণ্ডে কত দিতে হবে, কার চষা ক্ষেতে পার্টির জনসভা হবে, কার পতিত জমিতে 'প্রস্তাবিত সার্বজনীন কালীমন্দির'- এর সাইনবোর্ড পোতা হবে এবং তাঁর সঙ্গে জমির মালিকের গোপন বৈঠকের পর কবে সেই সাইনবোর্ড উঠে যাবে; কাকে পার্টিবিরোধী কার্যকলাপের জন্য গাঁ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, কাকে বিপিএল তালিকাভুক্ত করা হবে কিংবা কাকে করা হবে না, কাকে কে-এল- জঙ্গি আখ্যা দিয়ে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া হবে, কে একশো দিনের কাজ পাবে কে পাবে না, কার বাড়িতে মজুরেরা কাজ করতে যেতে পারবে না, গ্রাম্য সালিশীতে কার লঘু পাপে গুরুদণ্ড অথবা গুরু পাপে লঘুদণ্ড হবে, ভোটের সময় কে লাল পার্টিকে ভোট দিয়েছে কে দেয়নি এসব বিষয়ে তিনি যা সিদ্ধান্ত দেবেন সেটাই চূড়ান্ত। ফলে, সেবার কোনও কামলাকে ধান কাটানোর কাজে নিযুক্ত করতে পারল না হারুর বাবা। সেই দুর্বিসহ দিনগুলোর কথা হারুর হৃদয়ে দগদগে ঘা-এর মতো হয়ে আছে সেখানে আজও জ্বালা-পোড়া হয়। আজও সেখান থেকে রক্তপূঁজ ঝরে। সেই ক্ষতের দপদপানিতে হারুর ভেতরটাতে কীসের যেন আগুন জ্বলে দাউদাউ করে আজও

  

   মাঠভর্ত্তি ধান পড়ে পড়ে নষ্ট হওয়া দেখে, বাবাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে ছোট্ট হারুর ভেতরটাও ফুঁসে ফুঁসে উঠছিল সেদিন

গুলতি দিয়ে হরগোবিন্দ মাষ্টারের মাথার খুলিটা উড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছিল

 

 


 অগত্যা মা-বাবার সঙ্গে সেবার হারুও নেমে পড়েছিল ধান কাটতে। স্কুল ছেড়ে, খেলা ছেড়ে, ট্যুইশানি ছেড়ে, পড়াশোনা ছেড়ে সারাদিন এমনকি রাতেও ধান কেটেছে হারু ওর বাবা-মার সঙ্গে

 

  ওরা সবাই মিলে সকাল থেকে যতটা সময় সম্ভব, অন্য কাজ ছেড়েছুড়ে ধান কেটেছে। মায়ের সঙ্গে কেটেছে আর ওর বাবা সেগুলো বয়ে বাড়ি নিয়ে গেছে। কাটতে কাটতে বইতে বইতে শরীর নেতিয়ে পড়েছে, তবু কেটে শেষ করতে পারেনি ওরা। সারাদিনের শেষে

ঘরে তোলা ধানের স্বল্পতা দেখে ওর বাবাকে যখন কপাল চাপড়াতে দেখেছে, ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাসে বাড়ির উঠোনের বাতাসকে ভারী করে তুলতে দেখেছে, সারা বছরের আহারের

জোগাড় হবে কেমন করে সে চিন্তায় ছটফট করতে দেখেছে, তখন শ্রমক্লান্ত ছোট্ট হারুর ভেঙ্গে পড়া শরীরটাও চিড়বিড়িয়ে উঠেছে; ওর ইচ্ছে হয়েছে ছুটে গিয়ে হরগোবিন্দ মাষ্টারের

টুটিটা টিপে ধরতে

 

   এদিকে মাঠের ধান কাটার সময় পেরিয়ে গেলেও কোনও মজুর কাজ করতে এলো না। ওপাড়ার ঝড়ু কাকা দ্বিগুন মজুরি নিয়ে চুপি চুপি একদিন মাঝরাতে এসে কিছুটা ধান কেটে দিল। কিন্তু সেই খবরটাও কেমন করে যেন হরগোবিন্দ মাস্টারের কানে চলে যায়। ফলে ঝড়ুকাকার দুর্ভোগের সীমা থাকে না। বেচারাকে আর কেউ কাজে নিতে পারবেনা বলে ফরমান জারি করে হরগোবিন্দ মাস্টার। অথচ বেচারা দিন আনে দিন খায়। কাজ না জুটলে খাওয়া জোটে না তার। পরে পার্টি অফিসে গিয়ে, নাকে খত দিয়ে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করে, ঝড়ুকাকা রেহাই পেয়েছিল সে যাত্রা

 

   হারুর বাপের কাছেও পার্টির কয়েকজন চামচা এসেছিল। সহানুভূতি দেখানোর ছুঁতোয়, পরামর্শ দেওয়ার অছিলায় হরগোবিন্দর বার্তা দিয়ে বলেছিল, পার্টি অফিসে গিয়ে হরগোবিন্দ মাস্টারের হাতে-পায়ে ধরতে। হারুর বাবা বলেছিল--- কুনও শালার আমি ঠ্যাং ধরতে যামু না। পোলা-পরিবার নিয়া না খাইয়া শুকাইয়া মরলেও যামু না

  

হারুর মা- বলেছিল --- খবরদার কইলাম, পোলার মাথার কিড়া লাগে, কারো ঠ্যাং ধরতে যাবা না। তুমি কি চুরি করছ, না ডাকাতি যে...

 

ফলে গায়ের রক্ত জল করে ফলানো ফসল সেবার মাঠেই নষ্ট হয়ে গেল প্রায় সবটাই

 

   পনেরো বছর পর এবার সেই ঘটনারই বোধহয় পুনরাবৃত্তি ঘটবে--- বিষয়ে কোনও সন্দেহ তো নেই- হারুর মনে, বরং আরও মারাত্মক কিছুও ঘটে যেতে পারে। এমনকি ওর ঠাকুরদার আমল থেকে দখলে থাকা খাসজমিগুলো লালপার্টির লোকেরা বেদখলও করে দিতে পারে বলে মনে হচ্ছে হারুর। 

 

   না, হারু কোনও লালবিরোধী মিটিং- বা মিছিলে যায় নি। এবার পঞ্চায়েত ভোটে লাল পার্টির প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়িয়েছে সে।  অত্যন্ত গোপনে গিয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়ে এসেছে। গোপনে না গেলে যেতেই দিত না ওরা। রাস্তাতেই আটকে দিত। একেবারে শেষ বেলায়, যখন হরগোবিন্দর লোকেরা ধরেই নিয়েছিল যে ওদের বিরুদ্ধে কেউ প্রার্থী দিচ্ছে না, তখনই হারুর মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়া দেখে সাঙ্ঘাতিক রকম হকচকিয়ে গেল।  আর, তার পর থেকেই হরগোবিন্দর পক্ষ থেকে হুমকি আসতে লাগলো প্রতিদিন এবেলা ওবেলা। প্রথম দিনই বলে পাঠালেন, হারু যদি ভোটে হেরে যায় তাহলে দশ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। আর যদি জিতে যায় তাহলে কুড়ি হাজার টাকা দিতে হবে। এছাড়া জমি-ফসল সম্পর্কিত নানান হুমকি, এমনকি বাড়িঘর গুড়িয়ে দেয়ার হুমকিও দিয়ে রাখল ওরা। কে-এল- জঙ্গি সাজিয়ে কেস্ করে জেল খাটাবে--- সে কথাও বলে রাখল হরগোবিন্দ মাষ্টার। বলল, মাকে দিয়ে দেহ-ব্যবসা করানোর অভিযোগ তুলে উলঙ্গ করে গ্রামে ঘোরানোর কথা এবং গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথাও। 

   মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের যেদিন শেষদিন, তার আগের দিন হাট থেকে ফিরছিল হারু। সন্ধ্যে সবে পার হয়েছে। গ্রামের রাস্তায় ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে অন্ধকারের দাপাদাপি

দুপাশের গাছপালা ঝোপঝাড় যেন অন্ধকারের করালগ্রাসে বিলীন হয়ে যাওয়ার ত্রস্ত প্রতীক্ষায় বিমূঢ়। লুকিয়ে পড়া ভীরু রাস্তাটার বুকে  জোনাকীর মিটিমিটি হারুর বুকে দুরুদুরু কাঁপন তোলে, একটা ছমছমে আবেশ মাখিয়ে দেয়।  কেন যেন ওর একটু ভয় ভয় করতে লাগল। পঞ্চায়েত ভোটের দামামা বেজে উঠলেই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামগঞ্জ হয়ে ওঠে একেকটা রণক্ষেত্র। খুন খারাপি এই সময়েই তো বেশি হয়

গাঁ-মুলুকে। 

   হঠাৎ হারু যেন কাদের পায়ের শব্দ শুনতে পায় ওর পেছনে। কারা যেন হনহনিয়ে আসছে  পেছন পেছন। হরগোবিন্দ মাস্টারের লোক নয় তো? পেছন ফিরে তাকায় না হারু। জোরে পা চালায়  

" হারু, এট্টু দাঁড়া দিনি", পেছন থেকে হাঁক শুনে বুকটা ছ্যাৎ করে ওঠে ওর।  "তোর সাথে আমাদের কিছু কথা আছে।" যে সর্বেশ্বরের গলা ! হরগোবিন্দ মাষ্টারের খাস চ্যালা সর্বেশ্বর। মতলবটা কী ওদের ?

   পেছনের পায়ের শব্দটাকে মৃত্যুর পদধ্বনি বলে মনে হচ্ছিল। মায়ের কথা মনে পড়ে যায় ওর। মা একা। ওর যদি কিছু হয়ে যায়, তবে মা' কী হবে? হারু কী করবে বুঝে উঠতে পারেনা। দৌড়বে? দৌড়ে লাভ হবে না, ধরে ফেলবেই ওরা, তাছাড়া হারুর হাত-পা- অবশ হয়ে যাচ্ছে যেন তাহলে চিৎকার করবে? এই ফাঁকা মাঠে ওর চিৎকার শুনবেই বা কে? আর শুনলেও সর্বেশ্বরের গলা শুনে ওকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে সে-, যার কাঁধে একাধিক মাথা আছে। বুকে সাহস এনে প্রায় ছুটতে ছুটতে যেতে যেতেই হারু বললঅহন দাঁড়াবার পামু না, কাইল কইও, কী কবা

"আরে দাঁড়া! আমরা বেশি সময় নেব না। ভয় পাচ্ছিস কেন, আমরা তোকে কিছু করব না। শুধু তোকে একটা জিনিস দেখাতে চাই।বলতে বলতে প্রায় ঘিরে ধরেছে ওরা হারুকে। সর্বেশ্বরের সঙ্গে আরো দুতিনজন রয়েছে, কারা তা অন্ধকারে ঠাহর করতে পারেনা হারু। "এ্যাই, বের কর !" 

   সর্বেশ্বরের হুকুম পেয়েই হাতের ঝোলা থেকে  কেউ একজন বের করল দ্রষ্টব্যটা। অন্ধকার খানিকটা চিরে নিঃশব্দে যেন হেসে উঠল

একটা পিশাচ। হারুর বুকের রক্ততৃষ্ণায় ওটার দাঁত যেন ঝলসে উঠল। হারু দেখেই আঁৎকে উঠল চকচকে ভোজালিটা। তা দেখে সর্বেশ্বর বলল--- আরে চমকাচ্ছিস কেন? ওতে এখনও ধার দেওয়া হয়নি। কাল বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত অপেক্ষা করা হবে। কাল মনোনয়নপত্র যদি প্রত্যাহার না করিস, তবে পরশুদিন থেকে এটি ধারানো শুরু হবে, আর শেষ হবে ভোট গণনার দিন। আশা করছি দু' কোপের বেশি লাগবে না তোর গর্দান নামাতে। যা, আজ রাতটা ভাল করে ভেবে দেখগে

 

   হারু দমে নি। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নি

হুমকি, ভয় দেখানো কোনও কিছুতেই পিছিয়ে আসে নি। তবে মাঝেমধ্যে মনটা দুর্বল যে হয়নি তা নয়, বরং এক-আধবার সিদ্ধান্ত প্রায় নিয়েই ফেলেছিল পিছিয়ে আসার। কিন্তু একটা ডাক আর রক্তমাখা কাপড়ের টুকরোটা ওকে ঠেলে দিয়েছে বারবার সামনের দিকে। মাঠঘাট  বনবাদার ভেদ করে দিগন্তের ওপার থেকে ভেসে আসে একটা ডাক--- - হা---রু---...!

 

   এই ডাকটা মাঝেমধ্যেই শোনে ডাকটা যখন আসে ভেতরটায় ওর উথাল পাথাল শুরু হয়, চোখের সামনে নেচে উঠে সেই রক্তমাখা কাপড়ের টুকরোটা। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে

ভাবতে শুরু করে অতিকায়, অমিত শক্তিধর বলে। বুকের মাঝে তখন শুরু হয় কীসের যেন প্রলয়-তাণ্ডব। সব লন্ডভন্ড ছারখার হতে থাকে চারপাশের সবকিছু। হরগোবিন্দ, সর্বেশ্বর, লাল পার্টির অফিস টুকরো টুকরো হয়ে আছড়ে পড়ে যেন ওর পায়ের সামনে

 

   ডাকটা ওর বাবার। বিকেলবেলা যখন খেলতে যেত, খেলতে খেলতে সন্ধ্যে হব হব করত, তখন ওর বাবা হাট থেকে ফিরত। ফিরেই বাড়ির ভেতর থেকে হাঁক ছাড়ত--- -  হা---রু--...! হারামজাদা, বাড়ি আয় শিগগির, সারাদিন তর খেলা আমি বাইর করতাছি !

হারু খেলা ছেড়ে তৎক্ষণাৎ ছুট লাগাতো বাড়ির দিকে। ভয়ে নয়, আনন্দে। কারণ, হারু জানত, ওর বাবা যতই দূর থেকে এটাসেটা বলুক, বাড়ি

যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাট থেকে ওর জন্য  আনা কিছু না কিছু বের করে দেবে। ওর বাবা ওর জন্য হাট থেকে কিছু না কিছু আনবেই। কোনওদিন ওর প্রিয় খাওয়ার জিনিস---  জিলিপি, বোঁদে, গজা; কোনওদিন আনকোরা খেলনা, কোনওদিন জামা বা প্যান্ট বা জুতো। 

ফলে ওর বাবা যেদিন হাটে যেত সেদিন খেলায় মন বসত না হারুর। কানটা খাড়া হয়ে থাকত বাড়ির দিকে। আর ওর বাবাও যেন নিয়ে আসা জিনিসটা হারুকে না দেখানো পর্যন্ত স্বস্তি পেত না, তাই বাড়িতে ঢুকেই হাঁক ছাড়তো -  হা---রু--...! 

  ডাককে ঘিরে আহ্বায়ক আর আহূত উভয়েরই ব্যাকুলতায় অনুপম একটা তরঙ্গ খেলে যেত যেন দিগন্ত থেকে দিগন্তে

 

                             

 

   ভোটপর্ব নির্বিঘ্নেই শেষ হল হরগোবিন্দর পার্টি আর কোনও ঝামেলা করে নি। বলা ভাল ঝামেলা করার সুযোগ পায় নি। কারন, হারু একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গেছিল। ওদের নানা

প্ররোচনাকে গুরুত্ব না দিয়ে নীরব থেকেছে এই

'দিন। এমনকি ভোটপ্রচারেও বেরোয়নি একদিনও। একজনকেও বলে নি ওকে ভোট দেওয়ার কথা। এছাড়া হরগোবিন্দও বোধ হয় মাঝের এই সময়পর্বে অহেতুক ঝামেলা বাড়িয়ে ভোট বাতিলের সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে চায় নি। কারণ, তাহলে নিশ্চিত জেতা আসনটি হারানোর সম্ভাবনাও থাকে

 

   আজ গণনা। গণনাকেন্দ্রের দিকেই যাচ্ছে এখন

 

  সকালবেলার কাজকর্ম সেরে, স্নান করে, চাট্টি খেয়ে, লুঙ্গিটা কষে কাছা দিয়ে নিয়েছে। তার উপর দিয়ে ফুলপ্যান্টটা পরে নিয়েছে। গায়ে পরেছে স্যান্ডো গেঞ্জির উপর হাফহাতা গেঞ্জি, তার উপরে ফুলহাতা শার্ট। পকেটে পুরে নিয়েছে সেই রক্তমাখা কাপড়ের টুকরোটা। শীতকাল নয় এটা। ভরা জষ্টিমাস, গরমটাও একেবারে উস্তন খুস্তন। তবু পোশাকের ব্যবস্থা হারুকে নিতে হয়েছে। কারণ, বাড়ি ফেরা আর হবে না। ফলাফল ঘোষণার পর হরগোবিন্দর লোকেরা সামনে পেলে আর আস্ত রাখবে না। কাজেই গণনাকেন্দ্র থেকে সোজা দিদির বাড়ির গাড়িতে ওঠার জন্য প্রস্তুত হয়েই এসেছে হারু। দু' সেট জামাকাপড় তাই কায়দা করে গায়েই পরে নিয়েছে ও। ব্যাগে করে নিয়ে গেলে সবাই জেনে যাবে। হরগোবিন্দর লোকেরা 'পালিয়ে যাচ্ছে' বলে ঘিরে ধরতে পারে

 

   রাস্তার দুপাশের গাছপালা, ক্ষেতখামার স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যেন প্রহর গুনছে মহাপ্রলয়ের। প্রতিবার ভোটে জেতার পরদিন অভিযানে বের হয় হরগোবিন্দর দল। বিরোধীদের শায়েস্তা করার অভিযান। সেই তাণ্ডব চাক্ষুষ করার আতঙ্কে ওরা যেন হতবাক। গাঁয়ের প্রায় জনশূন্য রাস্তাটা যেন হাহাকার করতে করতে হারিয়ে গেছে কোন গহ্বরে। 

  ক্ষেতের পাশ দিয়ে যেতে যেতে চোখে জল এসে গেল হারুর। ক্ষেতভরা ধান মাঠে মারা যাবে, এই শোকে নয়। ফসল ফলালোর গোটা প্রক্রিয়ায় কৃষকের সাথে ফসলের একটা মায়ার বন্ধন তৈরি হয়ে যায়। ফসল কেটে গোলায় তোলার মধ্য দিয়েই সে বন্ধন থেকে কাঙ্খিত মুক্তি যেন। এবার যেন সেই দায়িত্ব পালন করা হবেনা হারুর, সেই কারণেই শোকার্ত সে। হারু আলতো করে হাত রাখে বিমর্ষ, নুয়ে পড়া ধানগাছের মাথায়। ক্ষেতটাও ভাবী সময়ের ভয়ঙ্করতার আভাসে ম্রিয়মাণ, যেন এখনই কেঁদে উঠবে ডুকরে---  মনে হল হারুর

 

  কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ক্ষেতের পাশে ও। তারপর ধীরে ধীরে রওনা হল। 

 

  গণনাকেন্দ্রে পৌঁছতে পৌঁছতে জেলা পরিষদের গণনা শেষ হয়েছে। হরগোবিন্দর পার্টি জেলা

পরিষদে বিরোধীদেরকে একটি আসনও দেয়নি

 

  গণনাকেন্দ্রের এলাকা শুরু হবার মুখেই রাস্তার ধারে লাল পতাকায় মোড়া হরগোবিন্দর পার্টির শিবির। হারুকে পাশ দিয়ে যেতে দেখে সোল্লাসে শ্লোগান ধরল ওরা, 'লাল বাংলায় লাল পতাকা উড়ছে উড়বে!' 'শ্রমিক-কৃষকের রক্তে রাঙানো লাল পতাকা উড়ছে উড়বে! লাল পতাকার বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীরা হুঁশিয়ার!' 'লাল পতাকার বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের ধোলাই হবে পেটাই হবে!'

 

   হারু মনে মনে হাসে। 'সর্বহারার রক্ত রাঙানো লাল পতাকা উড়ছে উড়বে'--- হাসে এদের অজ্ঞতায়। এরা শুধু শ্লোগান দিতেই জানল। এরা জানে না, একটা লাল পতাকা হারুর পকেটেও

আছে। আর সেটা একজন কৃষকেরই রক্তে রাঙানো। ওরা জানে না, সে রক্ত এরাই ঝরিয়েছে। এরা এও জানে না, সর্বহারার কথা বলতে বলতেই কতজনকে এরা সর্বহারায় পরিণত করেছে

 

  হারুর বাবাও তো একজন কৃষক ছিল। সেবার অন্য পার্টির মিটিং- যাবার অপরাধে এরাই তো ওঁর পরিবারের সারা বছরের আহার ক্ষেতের ধান ঘরে তুলতে দিল না ওঁকে। এরা ভেবেছিল ভাতে মারার ব্যবস্থা করলেই ওঁ পথে আসবে। হরগোবিন্দর হাতে পায়ে ধরে ক্ষমাটমা চাইতে আসবে হারুর বাপ। একটা জরিমানা করে, নাকে খৎ টৎ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে--- এই পরিকল্পনা ছিল ওদের। কিন্তু হারুর বাপ তো সে পথে গেল না, ফলে চির একাধিপত্যের বাসনাবিলাসী হরগোবিন্দের কোপানলও

ছল খুঁজতে লাগল হারুর বাপকে ছারখার করার। এই বিরোধীতার জঁড় উপড়ে ফেলতে মরিয়া হয়ে উঠল ও। কারণ, এই বিরোধী সত্তার অস্তিত্ব জিইয়ে রাখলে এর বংশবৃদ্ধি ঘটবেই, যা ওর পক্ষে চরম অস্বস্তির। একটা দৃষ্টান্তমূলক কিছু করার ফিকির খুঁজতে লাগল হরগোবিন্দ

 

   এদিকে কোন মজুর কাজ করতে আসে না, হালচাষ বন্ধ হয়ে রয়েছে। হারুর বাপের নিজের হালের বলদ নেই। অন্যের  বলদ ভাড়া নিয়ে জমি চাষ করে। কিন্তু হরগোবিন্দর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে কেউ ওঁর জমিতে বলদ ভাড়া দিতে সাহস পেল না। এদিকে যা সামান্য ধান ঘরে নিতে পেরেছিল, তা দিয়ে বড়জোর মাসখানেক চলতে পারে। ফলে অনন্যোপায় হয়ে হারুর বাবা একদিন ঘোষণা করল, 'বিদ্যাশ যামু! দিল্লি বোম্বাই যাইয়া লেবারি করুম।'

 এবং দুদিন পরেই কাঁধে ঝোলানো ঢোল ব্যাগে কিছু জামাকাপড় ভরে নিয়ে, নিউ কোচবিহার স্টেশনে গিয়ে দিল্লিগামী ট্রেন- উঠে বসল

   ট্রেন ছাড়বার আগে হারুকে বুকে টেনে নিল, কান্নাভাঙা গলায় বলল, "দুষ্টামি কইরো না বাপ!... মায়ের কথা শুইন্যো !... ল্যাখাপড়া মন দিয়া কইরো!... আমি তাড়াতাড়ি চইল্যা আইমু, তোমার লিগা কতকি আনুম !...” 

ওর মাকে বলল, "অরে মাইর ধোইর কইরো না!...”

 

  এরপর বহুদিন দশ বছরের হারুর একটা ডাক শুনবার আকুলি বিকুলিতে বিকেলগুলো দুপুরগুলো সকালগুলো ম্যাড়ম্যাড়ে হয়ে যেতে থাকে। খেলার মধ্যিখান থেকে প্রাণের উল্লাস-উচ্ছলতা উবে যেতে থাকে। সদা-উদাসী মেঠো বাতাস প্রতিক্ষণে হু হু করে ওর মনের মধ্যে পাক দিয়ে পাক দিয়ে তুলতে থাকে কোন্ এক বেদনাকে। হাট-ফিরতি লোকগুলোকে দেখে বেদনাবিকৃত মনে গৃহকোণে ফিরে যাওয়ার অভ্যস্ত চর্যা সাঙ্গ করে হারু প্রতিদিন

 

'-  হা---রু------!' বুঝি কাঙ্খিত ডাক শোনা যায় বাঁশবনের ঝিরিঝিরি বাতাসে, এঁকে বেঁকে হারিয়ে যাওয়া পথের প্রান্তে, দিল্লীফেরৎ ট্রেনের হুঁইসেলে। কান পাতে হারু। শ্রুতিবিভ্রম। কান্না পায় ওর। মা দেখে বলে, "কীরে, কান্দস ক্যান?"

 

"মা, বাবা কবে আইবো?"

 

মুখে আঁধার লেপে সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় মা---  আইবো। 

মায়ের কান্না আঁচলের খুঁটে, আঁচলের তলে, বুকের গভীরে চেপে রাখা--- টের পায় হারু

 

"-  হা---রু--...!” একদিন সত্যি সত্যিই ডাকটা শুনতে পায় হারু। ডাকের উৎস লক্ষ্য করে ছুট লাগায়  'বাবা আইছে! বাবা আইছে!' চিৎকার করতে করতে। বাবাকে দেখে হারুর আনন্দ যেন বাঁধভাঙ্গা বন্যার জল

 

  ওর বাবা ওর জন্য কত খেলার জিনিস, জামাকাপড়, এনেছে। কত রকমের খাবার জিনিসসব অন্য রকমের। এদিকে ওসব দেখেনি কখনও হারু

 

   রাতে শুয়ে শুয়ে কত গল্প শুনল। দিল্লির গল্প

দিল্লি খুব মজার দেশ। অনেক কিছু দেখার আছে এখানে - কুতুব মিনার, লালকেল্লা, যন্তরমন্তর, জামে মসজিদে, ইমামবারা, মতি

মসজিদ, আরো কত কি! দিল্লির কাছেই আগ্রায় রয়েছে ওদের বইয়ে পড়া তাজমহল। হারুকে একবার দিল্লি নিয়ে গিয়ে সব দেখিয়ে নিয়ে আসবে বলে জানায় ওর বাবা। শুনে  আনন্দে লাফিয়ে ওঠে হারু। আবার কিছুটা হতাশ হয় এই জেনে যে, দিনটির বিলম্ব আছে। এবার নয়। তবু খুশীই হয় মোটের উপর এই ভেবে যে, ওর বাবা যখন নিজে মুখে বলেছে, তখন নিয়ে যাবেই একবার না একবার। 

 

   দিল্লির কথা ভাবতে ভাবতেই সেদিন ঘুমিয়ে পড়েছিল হারু। স্বপ্নে তাজমহলের সামনে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, লালকেল্লায় হুটোপুটি করছিল,

যন্তর মন্তরে লুকোচুরি খেলছিল হঠাৎ কাদের হাঁকডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায় ওর। বাইরে কারা যেন ওর বাবাকে শাঁসাচ্ছেশিগগির ভালয় ভালয় গরুটা বের করে দে, নইলে আজ আর প্রাণে বাঁচবি না বলে দিচ্ছি!'

 হারু ধরমড়িয়ে উঠে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখে সর্বেশ্বর আর ওর সাঙ্গোপাঙ্গোরা ওর বাবাকে ঘিরে ধরেছে। হারুর বাবা আর্তনাদ করে ওঠে--আরে কীসের গরু? কার গরু? আমি কিস্যু জানি না, আমি কাইলই দিল্লি থিকা আইলাম !

 

--- চোপ ব্যাটা চোর ! ভেবেছিস আমরা কিছু খবর রাখি না ! তুই ব্যাটা গরু পাচারকারীর কাজ করছিস, এটা আমরা সবাই জানি। কাল রাতে তুই মজিদের গরু চুরি করেছিস। আমি নিজের চোখে দেখেছি। কাল রাত একটার সময় মিটিং থেকে ফেরার পথে তোকে মজিদের বাড়ি থেকে গরু নিয়ে বেরোতে দেখেছি

 

--- মিছা কথা, সব মিছা কথা ! আমারে ফাঁসানের লাইগ্যা এইসব কিচ্ছা বানানি হইছে !

 

--- ্যাটা এমনি এমনি মানবে না দেখছি, ধর ব্যাটাকে !

সর্বেশ্বরের হুকুম পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে টেনে হিঁচড়ে হারুর বাবাকে উঠোনে নামিয়ে এলোপাথারি কিল-চড়-ঘুষি-লাথি মারতে থাকে ওরা। হারুর মা ঝাঁপিয়ে পড়ে স্বামীকে বাঁচাতে---  মাইরো না, মাইরো না! প্রাণভিক্ষা দ্যাও!--- 

পায়ে জাপটে ধরে অনুনয় করতে থাকে। ওদের একজনের ধাক্কায় ছিটকে দূরে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন এসে উঠোনের কোণার সুপুরি গাছের সঙ্গে পিঠমোড়া করে বেঁধে  রাখে। হারুকে একজন চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে  ঘরে ঢুকিয়ে দরজায় বাইরে থেকে শিকল লাগিয়ে দেয়। 

 

  হারু ভেতর থেকে শুনতে পারে ওর বাবার প্রাণান্তকর আর্তনাদ--- -  হা---রু--... আমারে মাইরা ফালাইলো রে--...!

 

   ঘরের ভেতরে কাঁদতে থাকে ও। চিৎকার করতে থাকে। দেওয়ালে মাথা ঠোকে। দেওয়াল ভেঙ্গে, দরজা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে চায়। পারে না।  যখন বেরোতে পারল তখন উঠোন পুলিশে পুলিশে ছয়লাপ। হতবাক হয়ে দেখল, যে লোকটা কাল রাতেই ওকে দিল্লি ঘোরানোর স্বপ্ন দেখালো, যে মানুষটার গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমের মধ্যে তাজমহল দেখেছে, লালকেল্লা দেখেছে সেই লোকটার দেহটা রক্তে ভেসে গিয়ে উঠোনে পড়ে আছে  বিভৎসভাবে। সেই লোকটার দেহটা বিশ্রীরকমভাবে একটা ছেড়া বস্তায় মুড়ে, দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে গেল পুলিশের লোকেরা। তার আগে হারুর মা কখন কেন যেন ওঁর গা থেকে দিল্লি থেকে কিনে আনা, রক্তে লাল হয়ে যাওয়া সাদা জামাটা খুলে নিয়েছিল। সেটি এতদিন রাখা ছিল ট্রাঙ্কে। মাঝেমধ্যে বের করে দেখত হারু। হু হু করে কান্না এসে ভাসিয়ে নিয়ে যেত ওকে তখন। কান্না একসময় আগুনে পরিণত হয়ে ভেতরটাকে তাতিয়ে তুলত ওর

 

   সেই আর্তনাদটাই ওর বাবার মুখে হারুর শোনা শেষ কথা-  হা---রু--...! আমারে মাইরা ফালাইলো রে--...!

 

   সেই ডাকটা আজও অনুরণিত হয় হারুর কানে প্রতিনিয়ত। সেই ডাকটাই ওকে উজ্জীবিত রাখে সদাই। একটা প্রতিশোধস্পৃহার

ধিকি ধিকি আগুন জ্বালিয়ে রাখে ওর অন্তরে। আর সেই রক্তাক্ত কাপড়টা, যেটা সেই কালো দিনটার আগের দিনই একটা সুন্দর সাদা শার্ট ছিল, যেটা দেখিয়ে দিল্লিতে জিনিসপত্র কী শস্তা সবাইকে সেই প্রমাণ দিচ্ছিল ওর বাবা; যে শার্টটা যখন পরেছিল, বাবাকে তখন দারুন লাগছিল হারুর

   রক্তমাখা জামার টুকরোটা ওকে দুর্বার সাহস জোগায় আজও। সেই সাহসেই হরগোবিন্দর পার্টির বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ানোর দুঃসাহস হয় ওর, হরগোবিন্দর দীর্ঘকালব্যাপী কায়েম একাধিপত্যের বুলন্দ দেওয়ালে ছোট্ট আঘাতের প্রত্যাঘাত মারাত্মক জেনেও

 

   গণনাকেন্দ্রের বাইরে যে অস্থায়ী খাবারের দোকানগুলো হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে যেটা থেকে গন্ডগোলের আঁচ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাওয়ার সুবিধে হবে, সেরকম একটি দোকানে ঘাপটি মেরে বসে রইল হারু। ভোটের ফলাফল নয়, যেন একটা নিশ্চিত রায় শুনবার অপেক্ষায় রইল--- 'হারু তুমি পালাও' এই রায়। রায়টা নিজের কানে শুনেই বেরিয়ে পড়বে। এখান থেকে প্রথমে দিদির বাড়িতে উঠবে। সেখান থেকে পরিস্থিতি বুঝে হয় গাঁয়ে ফিরবে, না হয় পারি দিবে ভিনরাজ্যে---  দিল্লি, মুম্বাই, রাজস্থান বা গুজরাতে। যেমন অন্য অনেকে যায় এখানে কাজ না পেয়ে দিনমজুরি খাটতে। মা আর , দুজনের পেট চালাতে কোনও অসুবিধে হবে না তাতে। জমিজিরেত না হয় পতিতই থাকবে। মাঝেমধ্যে যখন দেশে ফিরবে তখন এসে দেখে যাবে।  হাঁস-মুরগি-কবুতরগুলো সব বিক্রি করে দিয়েছে। গরুবাছুর আগেই দিদির বাড়িতে পাচার করে দিয়েছে। মাকেও সেখানে পাঠিয়ে দিয়েছে 'দিন আগে

 

   পঞ্চায়েত সমিতিতে আশ্চর্যজনক ভাবে হরগোবিন্দর পার্টি হেরে গেল। তবে লড়াই হল হাড্ডাহাড্ডি। কাঁটায় কাঁটায় ব্যবধানে জিতেছে বিরোধীরা

   পঞ্চায়েত ভোটের গণনা শুরু হতেই হারুর বুকের ধুকপুকুনি শুরু হয়ে গেল। এই পর্যায়েও লড়াই হচ্ছে ভীষন। 'টা আসনের মধ্যে আটটার ফল ঘোষণা হলে দেখা গেল হরগোবিন্দর পার্টি আর বিরোধী পার্টি উভয়েই চারটি করে আসন পেল। হা্রুর আসনটিই নির্ণায়ক অর্থাৎ, পঞ্চায়েতে হরগোবিন্দর একাধিপত্য বজায় থাকবে, নাকি বিরোধীরা বহুকালের প্রতিক্ষীত জয়ের উল্লাসে মাতবে তা ঠিক হবে হারুর আসনটির গণনা শেষ হলে। ফলে এই আসনটির গণনাকালে উত্তেজনার 

পারদ তুঙ্গ ছুঁল

 

   তবে প্রথম কয়েক রাউন্ড গণনার পরই হারু নিজের ভবিতব্য সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেল। হাগোবিন্দর পার্টির আধিপত্য চলতে লাগল। সেই শিবিরে ইতিমধ্যেই জয়ের উল্লাস শুরু হয়ে গেছে

   হারুর গাঁয়ের কথা মনে পড়ল। আশৈশব কাটানো ওদের কুটীরের আনাচ কানাচ, খেলার মাঠ, বাঁশবন, পথের বাঁক, ছায়াবট গাছ, দুর্গামন্দির, গা-ছমছমে শ্মশানঘাট, পাখির কুজন ভরা বনবাদার সব একে একে মনে

পড়তে লাগল ওর। সেসবের সাথে জড়িয়ে থাকা স্মৃতিগুলো মনের পর্দাটায় ভেসে ভেসে উঠতে লাগল। একটা দীর্ঘশ্বাস খসে পড়ল ওর বুক থেকে। হায়! আর কিছুক্ষণ বাদেই এসবকে পেছনে ফেলে চলে যেতে হবে। যেতেই হবে। কারণজলে বাস করে তো আর কুমীরের সঙ্গে লড়াই করা যাবে না। হারুর বুকটা হু-হু করে উঠল। কান্না পেয়ে গেল। উঠে দাঁড়ায় ও। প্রস্তুত হয়। চির বিদায়ের জন্য। হাঁস মুরগি বিক্রি করা টাকাগুলো আছে তো? বুকটা ধক্ করে ওঠে হারুর। দ্রুত হাত চালায় প্যান্টের ডান পকেটে, বাঁ পকেটে--- টাকা তো নেই! কিন্তু একটু আগেই তো চায়ের দাম দিল ! তখনও তো ছিল! তাহলে কি কোথাও পড়েটড়ে গেল? নাকি পকেটমার হয়ে গেল ? চায়ের দোকানটার টেবিল-বেঞ্চির তলা, যেখানে যেখানে পায়চারি করেছে সেখানে, সর্বত্র নিষ্ফলভাবে খুঁজল খানিকক্ষণ

কিন্তু টাকা না হলে পালাবে কীভাবে?

 একেই বোধহয় বলে কপালের ফের। কপালে দুর্ভোগ থাকলে ঠেকায় কে ? হরগোবিন্দর লোকেদের হাতে পিটুনি খেয়ে মৃত্যু ওর অবধারিত। চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে পড়ল ধপ করে হারু। এখন কী করবে? দু'হাতে মাথা চেপে ধরে ভাবতে লাগল। হঠাৎ একটা ঘোষণায় চমকে উঠল হারু। এতক্ষণ নানান

চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকার ফলে আগের ঘোষণাগুলো শোনাই হয়নি। ভুলেই গেছিল যে, একটা গণনাকেন্দ্রে আছে এবং নিজে একজন প্রার্থী--- দেশান্তরী হবার একটা অনিবার্য রায় শুনবার জন্য প্রতীক্ষা করছে। কিন্তু ঘোষণাটায় যেন বেখাপ্পা একটা কিছু বলল বলে মনে হল ওর। দ্বিতীয়বার শুনবার জন্য কান পাতল। কিন্তু এত কোলাহল চারপাশে যে, এবারও ঠিকমতো শুনতে পেল না। তৃতীয়বার মাইকের কাছাকাছি ছুটে এসে দাঁড়িয়ে ঠিকঠাকমতন শুনল। শুনেই লাফিয়ে উঠল। পকেট থেকে রক্তমাখা কাপড়ের টুকড়োটা বের করে শূন্যে তুলে ধরে চিৎকার করে উঠল বা-বা গো--- ! আমি জিত্যা গেছি ! আকাশপাতাল বনবাদাড় ভেদ করে তার যেন প্রত্যুত্তর শুনতে পেল হারু- -  হা--রু--...!

  হারু কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সন্দেহটা কিছুতেই দূর হচ্ছে না-- ঠিক শুনেছে তো ?

  ইতিমধ্যে পূর্ব পাড়ায় জয়ী গণেশ আর অন্য একজন জয়ী প্রার্থী এসে ওকে জড়িয়ে ধরল। বললআমরা জিত্যা গেছি হারু ! তুই আমাগোর মইধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পাইছস। অল্প ল্যাখাপড়াও জানস, আমরা 'রে প্রধান বানামু

 

   একজন বয়স্ক লোক এসে বলল--- আমরা 'রে ভোট দিছি হারু, এলাকায় শান্তি আইন্যা দিস, হরগোবিন্দর দাদাগিরি আমরা আর দ্যাখতে চাই না কিন্তুক!

 

  অনেক লোক এসে যেচে কথা বলে গেল। হরগোবিন্দর ভয়ে যে লোকগুলো ওর ছায়া মাড়াত না, তারা এসে নানান পরামর্শ দিয়ে গেল। হারুকে তারা সবাই ভোট দিয়েছে, তাদের কাঙ্খায় ছিল ওর জয়, এরকম বলে গেল অনেকেই। সবচেয়ে অবাক লাগছেহরগোবিন্দর শিবিরে যেক'জন লোক বসেছিল শেষ পর্যন্ত, সেই 'টি ভোটও পায়নি ওর দল। গণনাকেন্দ্রের চতুর্দিকে যেন বিজয় উৎসব শুরু হয়ে গেল। পূর্ব পাড়ার গণেশ একমুঠো আবির এনে মাখিয়ে দিল হারুকে। হারুকে জড়িয়ে ধরে বলল--- হারু রে ! তিরিশটা বছর ধইরা এই দিনডার জইন্যে অপেক্ষা কইরা আছি ! এইবার হরগোবিন মাস্টারের চ্যালাগুনারে কচুকাটা করুম। হালাগো শরীল কাইট্যা কাইট্যা লবন ভরাইয়া দিমু!

 

---খবরদার ! ধমকে উঠে হারু--- এলাকায় অশান্তি করন যাবো না। 

  গণেশদের দুই ভাইকে গ্ৰামছাড়া করা হয়েছিল, অন্য পার্টি করে বলে। এবার গণেশ পঞ্চায়েতে দাঁড়িয়ে জিতেছে। গণেশ, হারু এরা এবার নতুন একটি দলের হয়ে ভোটে দাঁড়িয়ে জিতেছে। হারুর কথায় অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ গণেশ। তারপর বলে--- কস্ কি তুই এগুলা হারু ! তুই ' বাপের খুনের বদলা নিবার চাস না?

 

--- বদলা নিমু, কিন্তু অইন্যভাবে, আইনের পথে

 

---- আমি আগে পিটাইয়া মনের জ্বালা মিটামু, তারপরে আইনের কী করনের আছে আইন করব। আইনের কারসাজি ' দ্যাখলাম। '

বাপেরে পিটাইয়া মারলো বিনিদোষে। ' মা থানায় গেল কেস্ করবার। থানায় কেস নিল না, কইলো--- আপনের স্বামী গরুপাচার করতো, গণপ্রহারে মারা গ্যাছে, তার আবার কেস কী?  

 

  এক বিড়ম্বনা এসে হাজির হয় হারুর সামনে।  হরগোবিন্দর দলবল মানুষের উপর অত্যাচার তো কম করেনি। ক্ষমতার দম্ভে মানুষকে মানুষ বলে মনে করত না। ভোটটা পর্যন্ত নিজের ইচ্ছায় দিতে পারত না কেউ। ভোটবাক্সের পাশে ওর লোক দাঁড়িয়ে থাকত, দেখিয়ে ভোট দিতে হত। এই গ্ৰাম পঞ্চায়েত এলাকায় হরগোবিন্দ সর্ববিষয়ে শেষ কথা। ওর কথার খেলাপ করলে, নেমে আসত শাস্তির খাড়া। থানা পুলিশ ওর কথামতোই চলে। এই অসীম ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে গ্ৰামবাসীদের উপর  যথেচ্ছ জুলুম করত সে। পার্টিফাণ্ডে চাঁদা থেকে শুরু করে, যখন তখন মিটিং মিছিলে যাবার হুকুম সবকিছুই বিনা বাক্যব্যয়ে মানতে হত সকলকে। ফলে, আজ মানুষের ক্ষোভ ফুঁসে ফুঁসে তেড়ে যেতে চাইছে হরগোবিন্দর দিকে আর তার সাগরেদদের দিকে। হারুর নিজের মনের আগুনটাও ইন্ধন পেতে চাইছে। বারবার যেন শুনতে পাচ্ছে সেই ডাকটা। একটা যেন আবেদন নিয়ে একটা অতৃপ্ত আত্মা ওকে ডেকে চলেছে--- -  হা---রু--...! --- একটা সুবিচারের আবেদন নিয়ে

 

  হারুর চোখে ভেসে ওঠে--- বাপটাকে ওরা পিটিয়ে মেরে ফেলে রেখে গেছে, পুলিশ এসে বস্তায় ভরে নিয়ে গেল লাশ। পরদিন সবাই বলতে লাগল--- গরুচুরি করে ধরা পড়েছে বলে পিটিয়ে মেরেছে জনতা

 বস্তুতঃ হরগোবিন্দর লোকেরাই এটা রটনা করে দিয়েছিল

   আপাদমস্তক সৎ ভালমানুষটিকে চোর অপবাদ নিয়ে পিটুনি খেয়ে মরতে হল। এটা হারুকে আরও বেশি করে পোড়ায়। সেই জ্বালানী পোড়ানি থেকে ওর মনে জন্ম নেয় অদম্য প্রতিশোধস্পৃহা। কোনওদিন সুযোগ পেলে একইরকমভাবে হরগোবিন্দকে, সর্বেশ্বরকে পিটিয়ে মারতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু পরক্ষণেই মনে খটকা লাগে। প্রতিশোধ নেবার এটাই কি ঠিক রাস্তা? তাহলে তো ওদের ছেলেরাও বুকে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে হারুকে মারার জন্য সময় এবং সুযোগের অপেক্ষা করবে একদিন। তারপর একদিন হয়ত মেরেই দেবে। তারপর পিতৃহত্যার ভয়ঙ্কর স্মৃতি নিয়ে ছটফট করবে হারুর ছেলেও। ধারা কতদিন চলবে?

 

 


যাবতীয় নঞর্থকতার অন্ধকারের মধ্যেই  অস্ত্যর্থক আলোর আভাস ফুটিয়ে তোলা মানুষের বৈচিত্র্যময় মনেরই একটা দিক। সেই কারণেই বোধহয় সব মানুষই স্বপ্ন দেখে, আশা নিয়ে বাঁচে। ভোটে দাঁড়ানোর পর নিজের পরাজয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েও হারু তাই এসব ভেবেছে। আজ হবু প্রশাসকও তা- ভাবছে। এলাকায় যে কোনও মূল্যে শান্তি বজায় রাখতে হবে। যে গুমোট পরাধীনতার অদৃশ্য পাথর হরগোবিন্দ মানুষের বুকে চাপিয়ে দিয়ে রেখেছে, সেটা সরাতে হবে। সব মানুষকে স্বাধীনভাবে ভাববার, কাজ করবার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। আবার প্রতিশোধও নিতে হবে। না, ঠিক  প্রতিশোধ নয়--- অন্যায়কারীর শাস্তি দেওয়া। গাঁয়ের প্রতিটি নিরপরাধ মানুষকে তার প্রতি হওয়া অন্যায়ের সুবিচার দিতে হবে। ওর নিজের বাপের খুনের, গণেশের ভাইদের এবং আরও অনেকের প্রতি অবিচারের বিচার করতে হবে

 

   সর্বপ্রথমে ওর বাবার চোর অপবাদ দূর করতে হবে। যারা অপবাদ দিয়েছে, তাদেরকে দিয়েই প্রমাণ করতে হবে সবই সাজানো, মিথ্যা ছিল। শোনা গেছে, যে মজিদের গোরু চুরির কথা বলা হয়েছিল, সেই মজিদের কোনও গোরুই ছিল না মজিদকেই সর্বসমক্ষে টেনে এনে সেই সত্যিটাকে স্বীকার করাতে হবে। তারপর আইনের হাতে  তুলে দিতে হবে। এইভাবে, হেনস্থার শিকার প্রতিটি মানুষকে একত্রিত করে, তাদের সঙ্গে পরিকল্পনা করে, আইনের সাহায্য নিয়ে সমস্ত কিছুর বিচার করতে হবে, গায়ের জোড়ে নয়। হিংসার বিচার হিংসা দিয়ে করা যাবে না

 

  এইসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির দিকে ফিরছিল

হারু। হঠাৎ একটা কোলাহল শুনতে পেল ও। সর্বেশ্বরের বাড়িটা এই রাস্তাতেই পড়ে। কোলাহলটা সেখানেই। এগিয়ে গিয়ে

দেখল, অগণিত অত্যাচারিত মানুষ ঘিরে ধরেছে বাড়িটা। গণেশ এবং আরও কয়েকজন বিজয়ী প্রার্থী সেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছে

"অ্যাই, কী হইতাছে এইসব?" হারু যেন প্রশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। 

"হালারে আইজকা গুষ্টিসুদ্ধ জিন্দা পুইত্যা থুইয়া যামু। হালায় বহুত অত্যাচার করছে আমাগরে।গর্জাতে গর্জাতে বলল গণেশ

"খবরদার! আমার এলাকার কুনও অশান্তি করা চলব না।" প্রতিগর্জনে হুঙ্কার ছাড়ে হারুও

 

"' এ্যালাকা মানে ? ব্যাটা তুই অহনও ক্ষমতাই পাইলি না, আর তর এলাকা হইয়া গেল? তুই ্যাকলাই জিতছ নাই, জিতছি আমরাও, ' কথা আমরা শুনুম ক্যান? তুই সর, নাইলে তরেও রেয়াত করুম না কইলাম ! " 

"দ্যাখ্ গণেশ, বেশি আস্পর্দা করিস না "...



 

  সর্বেশ্বরও কিছু লোকজন তৈরি রেখেছিল। বিপক্ষের দুই পক্ষকে যুযুধান দেখে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফলে ভীষণ গণ্ডগোল লেগে গেল

 

   পুলিশ এসে যখন ভিড় ছত্রভঙ্গ করল, তখন দেখা গেল হারু রক্তে মাখামাখি হয়ে শুয়ে আছে। বোধ হয় তন্ময় হয়ে একটা ডাক শুনছে--- -  হা---রু--... !

অনন্ত আকাশের ওপার থেকে ভেসে আসা সেই ডাকের উৎসের দিকে তাকিয়ে আছে হারু। ওর চোখে পলক পড়ছে না। ওঠানামা করছে না বুকটা

 



 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বনিক

  উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বণিক উৎসবের আর মাত্র কয়েকটা দিন, একদম হাতে গোনা।  আর উৎসব  সংখ্যা ছাড়া উৎ...