শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩

সপ্তর্ষী বণিক- র অনুগল্প ' খিদে'

 


খিদে



তারপর একদিন সে ধরা পড়ে গেল।

তাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হলো। কেউ ক্ষমার পক্ষে গেল। কেউ আইন আদালতের কথা বলল। তবে সে যে মিশে গেছে, শরীর বলে আর কিছু নেই, একথা অনেকেই মানতে পারে নি।

শরতের শুরু। তবে বর্ষা এখনো যায় নি। গরমও লাগে। একটা অদ্ভুত আবহাওয়া থাকে এসময়টা। গরম পড়লে খুব গরম, বৃষ্টি পড়লে সেটাও খুব। ভ্যাপসা একটা গরমের সঙ্গে জল, বৃষ্টি, কাদা। বৃষ্টি হবে সারাদিন, কিন্তু গরম কমবে না। ঘামিয়ে দেবেই। শরতের শুরু ক্যালেন্ডারে। কিন্তু চারদিক দেখে তা বোঝার যো নেই। ঠিক এসময়েই সে ধরা পড়ল। অতল, দাদু নাম রেখেছিল। যার তল নেই। সেই অতল ক্রমে হয়েছে অটল, সেখান থেকে আজকের অবস্থা।

ছোট বেলা থেকেই ভালো পড়াশোনায়। দাদু অঙ্কের মাস্টার। যদিও বাবা চাকরি করত না। গ্রামে গ্রামে নাটক দেখিয়ে বেড়াত। সেই দাদুর সব সম্পত্তি শেষ করেছে। তাই অতলের আজ এই অবস্থা। তাকে এইভাবে পাওয়া গেছে।

অতল সকালে বের হয়। গ্রামের রাস্তা ধরে শহরে যায়। শহরে ফেরি করে সারাদিন হরেক মাল। যেটুকু বিক্রি হয় তারথেকেই কিনে আনে চাল, ডাল। এনে রাঁধে, খেয়ে ঘুমায়। সকালের জন্য ভাতে জল দিয়ে রাখে। পান্তা খাবে। কাঁচালংকা, পেঁয়াজ দিয়ে। কখনো পেঁয়াজ জোটে না। কাঁচা লংকা, লবণ, তেল দিয়ে খেয়েই বেরিয়ে যেতে হয়। সেই অতল। সারাদিন ঘোরে রোদে, জলে ছুটি নেই। পড়াশোনায় ভালো থাকলেও তার পড়াশোনা বেশি হয় নি। বাবার শখের নাটকের দলে ঢুকে যায়। কিছু পয়সা আর নামডাকের লোভে। হঠাৎ দাদু মারা যায়। তার বাবার শখের নাটক শেষ হয়। মদের বোতল থাকে হাতে। এভাবেই দিন চলছিল, নাটক শেষ হলো, দলের থেকে বের করে দিল। সংসারের হাল ধরতে হলো অতলকে; বুড়ো দিদা, মা। বাবাও মারা গেল কিছুদিন পরে। এরপর সব দায়িত্বই তার।

মা, দিদাকে নিয়ে সংসার। সংসার তো তার নয়। যেন তিনজনের জীবনের বোঝা বহন করা। বাবা দাদুর সব সম্পত্তি শেষ করে গেছে। তার জন্য রেখে গেছে শুধু চালটুকু। যা দিয়ে আজকাল জল পড়ে। ঠিক করবে একটু টাকা জমিয়েই।


বিয়ে আর হয় নি তার। কে করবে বিয়ে। আর বিয়ে দেবেই বা কে। সময়ের কাজ সময়ে না করলে কী হয় তা সে ভালোই বুঝতে পারছে। এই আকাশের নিচে, ধরা পড়ার পর, গলা শুকিয়ে যেতে যেতেও সে তাই চাইছে। কী এমন বেশি! যা পায় নি সে। পেতেই বা কী চেয়েছিল। কোথাকার প্রচুর টাকা বা সম্পত্তি। কিছুই তো নয়। সামান্য জিনিস।

এই শরতের সময় প্রেম আসে। প্রেমের একটা চাহিদা থাকে। কিন্তু কোথায় প্রেম। কোথায় বিয়ে। কোথায় স্বপ্ন। সবই মিশে যাচ্ছে। ঠোঁটের রক্ত পেটে গিয়ে সব খিদে মিটিয়ে দিয়েছে। খিদে কী শারীরিক শুধু!

অতল শহরে যায়। সেখানকারমেয়েমানুষকে দেখে। প্রেম দেখে। দুপুরে ছুটির দিনে শহরের রাস্তা দিয়ে হাকতেহাকতে গেলে কোনো বাড়ির দোতলার বারান্দার একজন পুরুষকে বেরিয়ে আসতে দেখে তার ঘরের মেয়েমানুষের হাত ধরে। অতল ভাবে। বোঝে। তারও পেটের কোথাও খিদে তৈরি হয়। কিন্তু এক খিদে অন্য খিদে মেরে দেয়। সে আড়চোখে তাকিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে আসার চেষ্টা করে।

শুধু কি খিদেই পায় তার। সেও স্বপ্ন দেখে। সংসারের। ঘরে একটা বউয়ের। একটা বাচ্চার। শহরের গৃহস্থ বাড়ির খুনসুটির মত কিছু। বা বাবুদের বারান্দার যা দেখা যায় তার। কিন্তু কে করবে তার এই স্বপ্ন পূরণ। কেউ জানে না। সে কি জানে।

এরপরেই সে ধরা পড়ল। এক রবিবার। এই দুপুরের একটু পরেই। মোড়ের মাথায়। কোন মোড়। শহরের চৌ রাস্তার মোড়।

সকাল থেকেই আবহাওয়া খারাপ। রোদ ওঠে নি। বৃষ্টি থেমে যাবার পরই অতল প্রতিদিনের মত বেরল। আজ একটু বেশি বিক্রি করতে হবে। চাল সারাতে হবে। আর অল্প কয়েকটাবেশি টাকা লাগে। এই লোভেই সে এ রাস্তা ও রাস্তা ঘুরঘুর করছিল। কয়েকটা ভালো বিক্রি হলো। এভাবে দুপুর পেরিয়ে বিকেল হলো। শহরের এক দোতলা বাড়ির দরজা খোলা দেখে সে ভাবল কিছু যদি বিক্রি বাড়ে। একবার, দুবার, তিনবার ডাক দিল। কেউ সাড়া করল না। কী ব্যাপার ভেবে, একটু টাকার লোভে সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে পড়ল। তারপর! তারপর চোখ গেল বাবুদের ঘরের দিকে। সেখানে কোনো পুরুষালি চেহারার একজন তার বাড়ির মেয়েবউটির সঙ্গে বিছানার চাদর ভাঙতে ব্যস্ত।

স্বপ্ন চোখের সামনে দেখলে মানুষ কী করে! দাঁড়িয়ে যায়। তাকে উপভোগ করে। অতলও তো এই স্বপ্ন দেখে। পূরণ হয় না। সে ভাবতেই থাকে। দেখতেই থাকে। স্বপ্নকে গ্রাস করতে থাকে। কে বলবে তাকে অন্যায়, ন্যায়। স্বপ্নের সামনে ন্যায়-অন্যায় মনে আসে।

এরপর! হঠাৎ পুরুষালি চোখ দুটি ঘুরে তাকায় অতলের দিকে। মহিলাটিচিৎকার করে ওঠে। অতল বুঝতে না পেরে দৌড় লাগায়। রাস্তায় মোড়েই তাকে ধরে জনতা। পুরুষালি বহু তার চোয়াল লক্ষ করে নেমে আসে। এরপর নেমে আসে একের পর এক হাত। নাক ফেঁটে যায়, মুখের রক্ত গিলে নেয়। খিদে আটকে দিতে চায়।

কীভাবে আটকাবে খিদে। মাটিতে মিশে যাওয়ার


আগে তার স্বপ্নের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে বিছানায় ভেঙে যাওয়া চাদরের কথা। যৌবনের কথা। সংসার ও বউয়ের সঙ্গে অন্তরঙ্গতার কথা। যৌনতার গন্ধ তার নাক বন্ধ করে দেয়। তার শ্বাস ফুলে ওঠে। রক্ত পেট থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, স্বপ্ন আটকে যায়। আবহাওয়া আর সে মিশে যাচ্ছে। মাটির সঙ্গে। নাকি স্বপ্নের সঙ্গে কে জানে! অংকের মাস্টারের নাতি, শিল্পীর ছেলে নাকি অতল...



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বনিক

  উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বণিক উৎসবের আর মাত্র কয়েকটা দিন, একদম হাতে গোনা।  আর উৎসব  সংখ্যা ছাড়া উৎ...