আবাদের
গান
‘ কখনও কখনও একটা জোনাকি আসে , ওড়ে
দেখে যায় কাছে আছি ? না কি চলে যাচ্ছি দূরে ! ’ এই যে জোনাকি ! এটিই আমার কথা নিয়ে কথোপকথনের আকাঙ্ক্ষা-- আমার লেখালেখির তাগিদ ! আর আমি তখন আমার চারপাশের সমস্তরকম কোলাহল ছাপিয়ে ভিতরঘরের অনুভবে পৌঁছে যাই । ক্রমে। দেখি –
‘সাদা কাগজে নটরাজ পেনসিলের ওঠানামার মতো একটা শব্দ ঘুরেফিরে আসছে যেভাবে রহস্য গল্প লেখা হয়
কিংবা অভিনয় লুকিয়ে রাখে শোক ;
যেভাবে লে হালুয়া বলে ছুটে যায় তুবড়ি কিশোর
অথবা কড়ি ও কোমল নিয়ে
কথা ডিঙিয়ে যায় সুরের চৌকাঠ --
সেভাবেই শান্ত সরোবর থেকে উঠে আসছে নীরবতা ;
ওই তো , তৃষ্ণার্ত প্রতীক্ষা উঠে দাঁড়ালো --
একা !’
আর , তখন ; ঠিক তখনই শুরু হয় আমার লেখালেখির আয়োজন। মনে মনে । একে আমি ঠিক কবিতা লেখা বলতে পারি না। বলতে পারি–অদ্ভুত একটা ঘোর- আর, ঘোর লাগা অনুভবের অনুবাদ। বড্ড অভিমানী সেই ঘোর। কখনও সে আমার কাছে নাছোড় --- আবার কখনও বা রাদি পাগলির মতো এখানে-সেখানে, বনে-প্রান্তরে লুকোচুরি খেলতে খেলতে দৃষ্টির আড়াল হয়ে থাকে। মেঘে ঢাকা চাঁদের মতো–আলোহীন–জ্যোতি নেই!। সে আছে কিন্তু নেই!। উঁকি দেয়। আবছা।
‘ধাঁধার মতো শোনালেও সত্যি বলছি,
আমার কাছে ভিড়ও একটা বই,
কোলাহল নিজেই তার পাতা উল্টে উল্টে প্রচ্ছদের পাঁজর খুলে দেয়
বেরিয়ে আসে ভেতরের ভাঁজ
নাড়ি ও নক্ষত্র ---
অচিরেই নিজেকে প্রাসঙ্গিক মনে হয়
ভারী গল্প থেকে বেরিয়ে চলে আসি আহ্লাদী গল্প-কথায়
দেখি স্পর্শ- প্রাণ
খলবল করে আলো
চুম্বনের মতো চলকে পড়ে হিরে জ্বলজ্বল আগুন
কখনও ঘন হয়ে আসে অন্ধকার !
দেখি ভুল বানানের উৎসর্গ পেরিয়ে খুলে পড়ছে ভালোবাসা !
ভাবি – মন কি নকল গহনা ?
অনায়াসে খোলা –পরা করা যায় বুঝি ?
পথে –ঘাটে , বাসে- ট্রামে , ট্রেনে ও ভ্রমণে
আমার লেখার সঙ্গে ওরাও ঢুকেছে
ঠিক , কাগজে–কলমে ...’
আমার শৈশব
- কৈশোর যেন মালীর হাতে টবে লাগানো চারাগাছের
মতো। নতুন টবে রি-পটিং এর পর যত্ন করলে যেমন সে সাড়া দেয়--- ঠিক তেমন। কখনও গ্রামের
বাড়িতে ঠাম্মার পাশে শুয়ে শুয়ে শুনেছি ভালোদিদার গলায় শেষ রাতের নগর কীর্তনের সুর।
বাইরের আকাশে তখন মরা চাঁদ। সাদা। ভাসমান। শিউলির পাতায় পাতায় শিশিরের গন্ধ । পথ
থেকে পথে ঘুরে বেরানো বোষ্টমীর গানের কথার রহস্যময় সুর ভেসে ভেসে ঢুকে পড়ছে ঘর থেকে
ঘরে। তখন জানতাম--আলো ফুটলে রসকলি আঁকা
নাকে হিরের ফুলের মতো ঘাম মাখা ভালোদিদা এসে আমাদের উঠোনে দাঁড়াবেন। ঊষা পিশি দাওয়ায় বসতে দেবে তাকে। আর, আমার আবদারে
আবার একবার গাইবেন তার সুধামাখা গান –‘প্রভাত সময়ে শচীর আঙিনার পাশে গৌরচাঁদ নাচিয়া
বেরায় রে--’। ততক্ষণে তার পায়ের কাছে একথালা ভুজ্জ্যির পাশে আসবে এক গ্লাস জলের
সঙ্গে সকালের সামান্য আহার । এরপর তার বাড়ি ফেরার পালা। তার আদুরে স্বভাব আমার শিশুমনে
এমন গেঁথে আছে যে এড়িয়ে যাওয়া এই জীবনের কম্ম নয়! আবার কখনও গরমের সন্ধ্যায় আমাদের
রেল কলোনির বাংলো থেকে বেরিয়ে মায়ের হাত ধরে মিনু মাসিদের বাড়ি যাওয়ার পথে দেখেছি–জায়গায় জায়গায় আগুনের লেলিহান ধোঁয়া মাখা লাল-হলুদ শিখা। কাঁচা কয়লা পুড়িয়ে ঘরে
ব্যবহারের এই পদ্ধতিটি যখন দেখেছি তখন আমার
সাত। আমি তখন কাঠিহারের রেলস্কুলের ছাত্র। হিন্দি – বাংলা – ইংরেজি সবই তখন আমার
নিজের মনে হতো। ভালোদিদার গানের ঠিক বিপরীত সুরে গাওয়া ভোজপুরি গান এর আসর শুনেছি
তখন। সেইসব কথাসুর ও এক অপূর্ব স্মৃতি। কোলাহলের মধ্যেও এক অসাধারণ মগ্নতা! ভোলা
যাবেনা তাকেও।
এভাবেই গ্রামের বাড়ি – গ্রামের স্কুল , শহর থেকে শহরে – সাধারণ স্কুল থেকে মিশনারি স্কুল হয়ে বাড়ি থেকে দূরে হোস্টেলে – হোস্টেলে আমার ছাত্রজীবনের যাপন । কখনও অবাধ স্বাধীনতা কখনও অসাধারণ শৃঙ্খলার বন্ধন । কাঁচা মনটা তখন কিভাবে যে এসব মানিয়ে গুছিয়ে ছাত্রজীবন শেষ করেছে --- এখন ভাবলে সীমাহীন বিস্ময়ে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ি । তাই হয়তো স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই কখনও লিখেছি –
‘সংসারী রোদে
কিছু আলাপী শিশির লেগে আছে,
ফোঁটা ফোঁটা
উঠোনের একপাশে জবুথবু
শুয়ে থাকা সোনালী অঘ্রাণে ;
খুঁটে খায় চতুর চড়ুই’ (আলাপী শিশির – প্রতিভাস)
আবার কখনও লিখেছি,
‘আপনজনের কান্নাকাটি
আপনাকে তাই করছি ভেট
সব মিলিয়ে বেশ তো আছি
এই আমাদের কর্পোরেট (সৃজন তুমি লিখতে পারো না তো – প্রতিভাস)
অথবা
‘গ্রাম জীবনের ছায়া পড়ে জলে
ধান জ্যোৎস্নার গন্ধ যেন ঢেউ
শরত মায়ের পাশে ছোট্ট ছেলে
তিস্তাপারের কিশোরবেলার কেউ ’(দেশ পত্রিকার কবিতা বিভাগে প্রকাশিত প্রথম লেখার অংশ ) কিংবা
‘আবছায়া সময়েরা ভাঙা ভাঙা জেগে থাকা
মৃত উপকুল ; জীবন গাঙের ঢেউ
রূপরেখা ছায়ালিপি ঘটনা বহুল ।
হৃদয়ের পাতা জুড়ে তাদের রয়েছি ছুঁয়ে
অবিকল গাছ ।
যেইসব চড়ুইয়েরা
আমার উঠোন মাঠে খেলে গেল আজ ।’ (বাউলের বারোকথা – সিগনেট প্রেস)
তাই কবিতা
কেন লিখি! প্রসঙ্গটি আমায় তেমনভাবে ভাবায় না। মানছি, জীবনে প্রথম যখন কয়েক পঙক্তি
লিখে আরশি পত্রিকার কবিতা বিভাগে ঠাঁই পেয়েছিলাম তখন ভারি আহ্লাদ হয়েছিল মনে। মনে
হয়েছিল – যা লিখছি তা কবিতাই। তখন সবে ক্লাস নাইন। একটু লিখি আর লুকিয়ে পড়ি। এভাবেই
একদিন কেমন বড় ( বয়সে ) হয়ে গেলাম। কবি ও কবিতার জগতকে জানার সঙ্গে সঙ্গে সিলেবাসের বাইরে চলে এলাম। পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখার
আগ্রহ হলো। লিখলাম। বাংলার বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে লেখা পাঠিয়ে অমনোনীত হয়েও লেখা
অভ্যাস হয়ে গেলো। আবার যখন দেশ কিংবা কৃত্তিবাস, কবিতা প্রতিমাসে কিংবা কবি সম্মেলন
অথবা এই সময় বা সানন্দা আমার লেখা প্রকাশ করেছে তখন আর পাঁচজন হয়তো ভেবেছেন আমার লেখা
কবিতা হয়ে উঠেছে। তথাপি আমার মনে কিন্তু এক ভয়ানক অতৃপ্তি আমাকে ভালো লেখার জন্য আকুতি
জাগিয়েছে।
ভালো লেখা
কি? এবং কেমন? যদিও তার মাপকাঠি সঠিক আমার জানা নেই। কখনো জনপ্রিয়তাকেই সেই মাপকাঠি
ধরা হলেও আমার কাছে কিন্তু তা একেবারেই নয়। তাই নিজেকে অতিক্রম করার একটা চেষ্টা জারি
রাখাই শ্রেয় বলে মনে হয়েছে আমার। সিগনেট থেকে প্রকাশিত আমার কবিতার বইটি বাংলা কবিতার
জগতে একটা আশ্রয় দিলেও সর্বদাই মনে হয়েছে সেভাবে লিখতে পারছি কি ?
চিরন্তন বিষয় আর অনুভব ছাড়া কবিতায় আসার বিষয়ের অভাব নেই। বর্তমান আর্থ – সামাজিক পটভূমিতে নতুন কি আছে তা ভাবতে হবে বইকি! আগে বলা হয়েছে তাকেও তাকেও নতুন করে বলা যায় কি? তাই বলার ধরণটিই কি তবে আসল? এমন নানা প্রশ্ন মনে আসে! অদ্ভুত এক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে আমরা এখন চলেছি। চোখের সামনে বেঁচে থাকার লড়াইতে প্রতিদিন নতুন নাম লেখা চলছে। মাঝে মধ্যে মনে হয় সব কথা নির্ভয়ে বলতে পারবো তো?
‘এই যে অকালে বৈশাখ এলো
কিংবা পারা এবং না পারার মধ্যে
তোমার সরগম সম্মত বিস্তারের খেলা
অথবা অ্যান্টিপোয়েট্রি স্ট্রাকচারে
এগারোটি ভুলে যাওয়া বাক্যবিন্যাস
তোমাকে স্রেফ খেলার ছলে মাত্রার উপর দিয়ে গড়িয়ে দিচ্ছে;
আর, তুমি অকূল দরিয়ায় কূল খুঁজে পাচ্ছ না,
খুঁজে পাচ্ছ না দুর্গানগরের আকাশ!
তাকে তুমি সত্যি লিখবে তো, অভয়?
না কি তখনও বলবে, জলের উপর কিছু নেই
পুরোটা ইলিউশন!’
তাই তো কবিতা লেখার ইচ্ছে জারি রাখি। মনে হয়,
‘এতগুলো কথোপকথনের পরেও
তোমাদের কোনও কথাই হল না, আশ্চর্য !
সে কি কথা! তোমার দুচোখে যে এখনও কবিতার ধুলোবালি?’
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন