সংশয়ী ও বিজ্ঞানজিজ্ঞাসুর গ্যেটে
য়োহান উলফগ্যাং ভন গ্যেটে। তিনি আইনব্যবসা
করার লাইসেন্স বা সনদপ্রাপ্ত হবার পর
ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে গিয়ে ছোটখাট ভাবে আইনব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু উচ্চতর মানবিক
প্রজ্ঞা নিয়ে আইনি ব্যবস্থার মধ্যে কাজ করতে গিয়ে তিনি বিপাকে পড়লেন। তাঁর
অনভিজ্ঞতাও এজন্য দায়ী ছিল। কয়েকমাস প্র্যাকটিশ করার পর তিনি
উকিল হিসাবে কাজ করা বন্ধ করলেন। এরপর ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে তিনি জার্মানির
হেসে প্রদেশের ওয়েটজ্লার শহরে পুনরায় আইনব্যবসা শুরু করেন। গ্যেটের পিতা চেয়েছিলেন যে, ছেলে আইন পড়ুন এবং জার্মানির হেসে
প্রদেশের ওয়েটজ্লারে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের ইম্পিরিয়াল সুপ্রিম কোর্ট রাইখস্ক্যামারজেরিখট
এ আদালতী কর্মপ্রক্রিয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করে ইটালি ভ্রমণ করে একজন বিশ্বনাগরিক হয়ে
উঠুন।
আইনের
যে শাখাটি খ্রিস্টীয় চার্চের পরিচালনা ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের আইনি
নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে কাজ করে, সেই একলেসিয়াসটিক্যাল আইন তিনি পাঠ্যবিষয় হিসাবে
বাছলেন। প্রাচীন ইহুদি ধর্মের আইনি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল।
লোকবিশ্বাস অনুযায়ী ঈশ্বর মিশরের সিনাই পর্বতে ইহুদি প্রফেট মোজেস বা মোশি কে 'টেন
কম্যাণ্ডমেন্টস' অর্থাৎ দশ উপদেশাবলী দান করেছিলেন। ইহুদি, খ্রিস্টীয় ও ইসলামী মতে মোজেস বা মোশিকে প্রদত্ত এই দশ উপদেশ
বিশেষ শ্রদ্ধেয়। ইহুদিদের তোড়া, খ্রিস্টানদের বাইবেল ও মুসলিমদের কোরাণে এই মাউন্ট
সিনাইয়ে প্রাপ্ত উপদেশাবলীর শ্রদ্ধাপূর্ণ উল্লেখ আছে।
এই
এতখানি গুরুত্বপূর্ণ ও শ্রদ্ধেয় 'টেন কম্যাণ্ডমেন্টস' এর বাস্তবতা, যৌক্তিকতা ও
সারবত্তা নিয়ে গ্যেটে প্রশ্ন তুলে দিলেন। তাতে
তাঁর বেশ বদনাম রটল। কিন্তু ওই যে আইনের পড়াশুনা, আইনের বিধানগুলির বৈধতা নিয়ে
কঠিন কঠিন প্রশ্ন তোলা তাঁর পরবর্তী জীবনকে
তৈরি করতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য লেখকেরা
যেখানে ধর্মীয় তত্ত্ব, দর্শন অথবা ধ্রুপদী ভাষাতত্ত্ব নিয়ে পাণ্ডিত্য অর্জন
করেছিলেন, সেখানে গ্যেটে প্রথমাবধি একজন বাস্তবপন্থী মানুষ হিসাবে যাত্রা শুরু
করলেন। গ্যেটে ছাত্রবয়সেই একজন মুক্তচিন্তক ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। তিনি মনে
করতেন, খ্রিস্টান চার্চগুলির বিভিন্ন ঘরাণার কোনো একটিকেও অনুসরণ না করেই একজন ব্যক্তি
অন্তরধর্মে খ্রিস্টান হয়ে উঠতে পারেন।
গ্যেটে এমনকি খ্রিস্টান ধর্মের মূল তাত্ত্বিক ভিত্তি নিয়েই কঠোর সমালোচনাপূর্ণ বক্তব্য রাখতে শুরু করলেন। তাঁর মতে যিশু খ্রিস্ট এক মেরুতে আর তথাকথিত খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্ব ভিন্ন মেরুতে, আর এ দুটির মধ্যে তিনি এক মৌলিক ও অলঙ্ঘনীয় পার্থক্য দেখতে পেতেন। খ্রিস্টান ধর্মের বিকাশের ইতিহাসকেও গ্যেটে ছেড়ে কথা বলেন নি। তিনি বলেছেন, খ্রিস্টান ধর্মের ইতিহাস আসলে কিছু বিশ্রী ধরনের ভুল আর হিংস্রতার ধারাবাহিক ইতিহাস। গ্যেটের সেক্রেটারি কবি ও লেখক য়োহান পিটার একারম্যান (২১ সেপ্টেম্বর ১৭৯২ - ৩ ডিসেম্বর ১৮৫৪) ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে জার্মান ভাষায় দুই খণ্ডে 'গেসপ্রাশে মিত গ্যেটে' বা গ্যেটের সঙ্গে আলাপচারিতা নামে একটি বই লেখেন। বছর বারো পরে ১৮৪৮এ এই বইয়ের আরো একটি খণ্ড প্রকাশিত হয়। এই গেসপ্রাশে মিত গ্যেটে বইতে পিটার একারম্যান গ্যেটেকে খ্রিস্টান ধর্ম নিয়ে আগ্রহী বললেও গ্যেটে কিন্তু নিজের সম্বন্ধে বলেছিলেন, আমি সচেতন ও সুচিন্তিত ভাবে নন-খ্রিস্টান। গ্যেটে একটি লুথেরান পরিবারে জন্মেছিলেন। মার্টিন লুথার নামে ষোড়শ শতকের জার্মান সাধু ও ধর্মসংস্কারক ক্যাথলিক চার্চের ধর্মতত্ত্ব এবং আচার বিশ্বাসের সংস্কার করতে গিয়ে প্রোটেস্টান্ট মতবাদ গড়ে তোলেন। লুথেরান মতবাদ সেই প্রোটেস্টান্ট মতবাদেরই এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা।
গ্যেটে যখন নিতান্তই শিশু, তখন ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগালের লিসবনে এক সাংঘাতিক ভূমিকম্প হয়। তারিখটা ছিল ১ নভেম্বর, শনিবার। সময়টা ছিল সকাল নয়টা চল্লিশ। সেই ১ নভেম্বর দিনটা ছিল একটা পবিত্র দিন। অল সেন্ট'স ডে পালিত হচ্ছিল। সকালেই শহরের মানুষ জড়ো হয়েছিল চার্চে, উপাসনাগৃহে। এমন সময়ে দেখা দিল সাংঘাতিক মাত্রার ভূমিকম্প। বিজ্ঞানীরা আন্দাজ করেন, রিখটার স্কেলে সে ছিল সাড়ে আট থেকে নয় মাত্রার সাংঘাতিক বিধ্বংসী ভূমিকম্প। দশ মিনিটের মধ্যে তিন তিনবার প্রবল আন্দোলনে লিসবন শহর প্রায় গুঁড়িয়ে গেল। তার মধ্যে একবার একটানা সাড়ে তিন মিনিট ধরে কাঁপল লিসবন। পনের ফুট করে গভীর ফাটল দেখা গেল বিভিন্ন জায়গায়। ধর্মীয় উৎসব পালন উপলক্ষে ভক্তমানুষ চার্চে চার্চে প্রার্থনায় সমবেত ছিলেন। তাঁদের এক বিরাট অংশ মারা পড়েছিলেন। তার পরে ভূগর্ভ থেকে বেরিয়ে এল আগুন। শুরু হল অগ্নিকাণ্ড। তারপরেই বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছুটে আছড়ে পড়ল সুনামি। লিসবন শহর ধ্বংসস্তূপ হয়ে গেল। এরপরই ১৭ মে ১৭৫৬ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৭৬৩ অবধি ছয় বৎসর আট মাস চার সপ্তাহ একদিন ধরে ইউরোপে এক বিশাল যুদ্ধ বাধল। তার একপক্ষে ছিল গ্রেট ব্রিটেন, প্রাশিয়া, পর্তুগাল; আর অন্যপক্ষে ছিল ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ইত্যাদি। পিঠোপিঠি ঘটে যাওয়া লিসবনের ভূমিকম্প এবং এই যুদ্ধ বালক গ্যেটের মনে 'ঈশ্বর পরম করুণাময়' এই ধারণায় সংশয় গড়ে দেয়।
ছোটবেলায়
গ্যেটে ছবি আঁকতে চেয়েছিলেন। আর তার পরেই সাহিত্যের দিকে তাঁর মন গেল। ইতিহাস এবং
ধর্মতত্ত্ব নিয়ে নানা বইপত্র তিনি পড়ে ফেললেন। তাঁর এই নানামুখী আত্মজিজ্ঞাসা ও
প্রশ্নশীলতা তাঁকে বিজ্ঞানচর্চায় উৎসাহিত করে।
মরফোলজি বা
অঙ্গসংস্থানবিদ্যা এবং রঙের তত্ত্ব নিয়ে তিনি অনেক লেখালেখি করেছেন। ১৭৯০ এর দশকে
তিনি জৈববিদ্যুৎ বা বায়োইলেকট্রিসিটির প্রবক্তা ইতালীয় বিজ্ঞানী লুইজি গ্যালভানি
( ৯ সেপ্টেম্বর ১৭৩৭ - ৪ ডিসেম্বর ১৭৯৮) র পরীক্ষা নিরীক্ষাগুলি নিয়ে চর্চা করলেন।
মানুষের ও বিভিন্ন প্রাণীর অ্যানাটমি নিয়েও তিনি চর্চা করেছেন। বিভিন্ন ধরনের খনিজ
পদার্থ নিয়ে জানা চেনার আগ্রহ ছিল তাঁর। আর তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে যে বিপুল
পরিমাণ খনিজ পদার্থের সংগ্রহ ছিল, তা সেকালে ব্যক্তিগত স্তরে কারো ছিল না।
ভূতত্ত্ব নিয়ে তাঁর আগ্রহের আর একটি বড় প্রমাণ হল সারাজীবন ধরে নানা রকম পাথর
সংগ্রহ করে বেড়ানো। মৃত্যুর সময়ে প্রায় ১৭৮০০ পাথরের সংগ্রহ তাঁর ছিল।
স্যামুয়েল টমাস ভন সমারিং (২৮ জানুয়ারি ১৭৫৫ - ২ মার্চ ১৮৩০) ছিলেন একজন জার্মান চিকিৎসক ও বিজ্ঞান জিজ্ঞাসু। তিনি একটি হাতির খুলি গ্যেটেকে চর্চা করবার জন্য ধার দিয়েছিলেন। ১৭৮০ থেকে ১৭৯০ এই দশকে গ্যেটে যখন প্রাণিতত্ত্ববিদ্যা চর্চা করছিলেন, তখন এই হাতির খুলির সূত্রে ইন্টারম্যাক্সিলারি হাড়ের ব্যাপারে চর্চা করেন। ইন্টারম্যাক্সিলারি হাড়কে এখন প্রিম্যাক্সিলা হাড় বলা হয়। মানুষের শরীরে প্রিম্যাক্সিলা হাড়টি ম্যাক্সিলা হাড়ের সঙ্গে জড়িয়ে মিশে গিয়েছে। মানুষের ম্যাক্সিলা হাড় উপরের দিকের চোয়াল গঠন করেছে। খুলির ঠিক মাঝখানে নাকের নিচে যে অংশটা আছে, ওকে বলে ইন্টারম্যাক্সিলারি সুচার। বাম ও ডান, দুদিকের দুই চোয়ালের হাড় ওই ইন্টারম্যাক্সিলারি সুচার এ এসে জুড়ে গিয়েছে। মানুষের দুটি চোয়ালের একেবারে সামনে কৃন্তক দন্ত রয়েছে। উপরের চোয়ালে চারটি এবং নিচের চোয়ালে চারটি, সব মিলিয়ে এই মোট আটখানা কৃন্তক দন্ত আছে। এদের কাজ হল কামড়ে ছেঁড়া। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে ২৭ মার্চ তারিখে জার্মান কবি, দার্শনিক ও সাহিত্য সমালোচক য়োহান গটফ্রিড হার্ডার ( ২৫ আগস্ট ১৭৪৪ - ১৮ ডিসেম্বর ১৮০৩) কে লিখছেন:
না,
আমি সোনা রূপা নয়, এমন একটা জিনিস খুঁজে পেয়েছি যা আমাকে ভীষণভাবে খুশি করে
দিয়েছে।সেই জিনিসটা হল মানুষের শরীরে ইন্টারম্যাক্সিলারি হাড়! লোডার
সাহেবের সঙ্গে একযোগে আমি মানুষের আর জন্তুর খুলি নিয়ে তুলনামূলক চর্চাভাবনা করছি,
এমন সময় ওর ছাপটি খুঁজে পেলাম।লোডার
হলেন জাস্টাস ফার্দিনান্দ ক্রিশ্চিয়ান লোডার ( ১২ মার্চ ১৭৫৩ - ১৬ এপ্রিল ১৮৩২)
হলেন একজন জার্মান অ্যানাটমি বিশেষজ্ঞ। বয়ঃকনিষ্ঠ লোডারের কাছে গ্যেটে অ্যানাটমি
শিখতেন।গ্যেটে সমারিং সাহেবের ধার দেওয়া হাতির খুলিটি চর্চার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন
স্তন্যপায়ী প্রাণী যে একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছিল, এমন একটি ধারণা
গড়ে তোলেন। এই ঘটনার অনেকদিন পরে, গ্যেটের মৃত্যুর আঠাশ বছর পরে ১৮৫৯
খ্রিস্টাব্দে বেরিয়েছিল 'অরিজিন অফ স্পিসিস' নামে বিশ্ববিখ্যাত বই। লিখেছিলেন
চার্লস ডারউইন (১২ ফেব্রুয়ারি ১৮০৯ - ১৯ এপ্রিল ১৮৮২)।
ডারউইনের তত্ত্ব বলতে আজ
আমরা বুঝি প্রাকৃতিক নির্বচনের মধ্য দিয়ে নব নব জীবপ্রজাতির উদ্ভব। ডারউইন
বলেছিলেন, দীর্ঘ সময়কালে প্রজাতিগুলি পরিবর্তিত হয়, আজকের প্রজাতি থেকে আগামী দিনে
ভিন্নতর প্রজাতি উদ্ভূত হয়। আরো বললেন, সব প্রজাতিই একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ হতে
বিকশিত হয়েছে। মিউটেশন বা পরিবর্তন এবং সিলেকশন বা নির্বচন, এর মধ্য দিয়ে
বিবর্তনের পথে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির সৃষ্টি, এমন একটি কথা ডারউইন তাঁর 'অরিজিন অফ
স্পিসিস' বইতে বললেন। কিন্তু এ কথারই যেন প্রতিধ্বনি আগেভাগে করে
রেখেছিলেন গ্যেটে। গ্যেটের
সম্মানে ওই খুলির হাড়টি আজ 'গ্যেটের হাড়' বলে পরিচিত। এমনকি ওই খুলিটি যে হাতির,
তার নামও 'গ্যেটের হাতি' হয়ে গিয়েছে। জার্মানির হেসে প্রদেশের কাসেল জেলায়
অটোনিয়াম নামে একটি প্রাকৃতিক ইতিহাসের মিউজিয়াম রয়েছে। সেখানে এই হাতিটির কঙ্কাল
রয়েছে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে বোমাবর্ষণ ও
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হাতিটির চামড়াটি যা সমারিং সংরক্ষণ করেছিলেন, তা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। গাছ নিয়েও গ্যেটের অনবদ্য ভাবনা ছিল। তিনি বলেছেন, গাছের পাতাটাই
যেন সমগ্র গাছ হয়ে উঠেছে। উদ্ভিদ জিনিসটা গ্যেটের মতে আগাপাশতলা একটা পাতা ছাড়া
আর কিছুই নয়। আর উদ্ভিদের সমস্ত কিছুই একে অপরের সঙ্গে প্রগাঢ়ভাবে এক হয়ে রয়েছে।
ওই পাতাই মুকুলের জন্ম দিচ্ছে, যৌনমিলনের প্রয়োজন বুঝে সময়মতো ফুল গড়ে তুলছে।
গাছের বীজপত্র থেকে শুরু করে যে পাতা সালোকসংশ্লেষ করে, আর তার ফুলের যে পাপড়ি
বর্ণবিন্যাস করে, সৌরভের ডালি ভরে কীটপতঙ্গকে আকৃষ্ট করে বংশবিস্তারের চেষ্টা
করে, এ সমস্ত কিছুর মধ্যে গ্যেটে একটা সঙ্গতি ও সংহতি দেখতে পেয়েছিলেন। এইসব কথাই গ্যেটে তাঁর 'মেটামরফোসিস অফ প্ল্যান্টস' বইতে
লিখেছিলেন। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে।
আবহবিজ্ঞানেও
গ্যেটের চিন্তা ভাবনার স্ফূরণ ঘটেছে। ইতালীয় গণিত পদার্থবিদ ইভানজেলিস্তা টরিসেলি
(১৫ অক্টোবর ১৬০৮ - ২৫ অক্টোবর ১৬৪৭)র বায়ুর চাপ সংক্রান্ত ধারণাকে কাজে লাগিয়ে গ্যেটে
একটি খুব সরল অথচ সংবেদী ব্যারোমিটার তৈরি করেছিলেন। একটি বদ্ধমুখ অর্থাৎ সীল করা
কাচের পাত্রে একটি শুঁড়ের মতো অংশ থাকত, যার সরু অগ্রভাগটি প্রকৃতিতে খোলাভাবে
থাকত। কাচপাত্রটি অর্ধেক জলভর্তি থাকত। বাতাসের চাপ কমে গেলে শুঁড়ের মতো অংশটি
দিয়ে জল খানিকটা উঠে যেত। আবার চাপ বেড়ে গেলে শুঁড়ের জল নেমে আসত। এই ব্যারোমিটারটির
নাম দেওয়া হয়েছিল 'গ্যেটের ব্যারোমিটার'। রঙ
জিনিসটা ঠিক কি, আর কী তার চরিত্র এবং ধর্ম, তাই নিয়ে 'থিওরি অফ কালারস' নামে বই
লিখলেন গ্যেটে। মূল বইটি জার্মান ভাষায় ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়েছিল। আর এর
ইংরেজি সংস্করণ বেরিয়ে ছিল গ্যেটের প্রয়াণের বছর আষ্টেক পর, ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে। স্যর আইজ্যাক নিউটন ( ৪ জানুয়ারি ১৬৪৩ - ৩১ মার্চ ১৭২৭) তাঁর বছর
তেইশ বয়সে, ১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে লক্ষ্য করেছিলেন একটি প্রিজমের ভিতরে সূর্যের আলো,
যা কিনা বাস্তবে সাদা আলো, তা প্রবেশ করালে বিভিন্ন রঙের আলো নির্গত হয়। তাঁর আগে
আরেকজন অসামান্য বিজ্ঞানী রেনে দেকার্তে ( ৩১ মার্চ ১৫৯৬ - ১১ ফেব্রুয়ারি ১৬৫০)
দেখিয়েছিলেন কাচের ভিতর অথবা জলের ভিতর সৌর আলোকরশ্মি প্রবেশ করালে রামধনু রঙ ফুটে
ওঠে। নিউটন দেখিয়েছিলেন সৌর আলোর ভিতরে সব রকমের রঙ রয়েছে। আর সেই সৌর
আলোকে প্রিজমের ভিতর দিয়ে চালিত করলে তার মধ্যে মিশে
থাকা ভিন্ন ভিন্ন রঙ, নিউটন ভাবতেন রঙের করপাসল বা কণা, ভিন্ন ভিন্ন গতিবেগে ছুটতে
গিয়ে আলাদা হয়ে যায়। নিউটন দেখালেন,
লাল রঙের আলোকে একটি প্রিজম থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে তাকে অন্য আরেকটি প্রিজমের মধ্য
দিয়ে চালিত করলে সেই লাল রঙের আলোটির আর কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। এ থেকে তিনি
ধারণা করলেন আলোর যে রঙ, তা আলোর মধ্যে আছে; প্রিজমে নেই। প্রিজম কোনো রঙ তৈরি
করতে পারে না। শুধু আলোর আলোর মধ্যে যে ভিন্ন ভিন্ন রঙ মিলে মিশে থাকে, প্রিজম
তার গঠনবৈশিষ্ট্যের জন্য সেই রঙগুলিকে আলাদা আলাদা ভাবে দেখাতে পারে। নিজের
বক্তব্য সপ্রমাণ করবার জন্য নিউটন প্রিজম দিয়ে সাদা আলো থেকে বর্ণালী তৈরি করার পর
তাকে আবার একটি লেন্স ও দ্বিতীয় আরেকটি প্রিজম ব্যবহার করে দেখালেন,
তা পুনরায় সাদা আলো হয়ে যায়। আলো নিয়ে নিউটনের এই পরীক্ষাটা একটা বৈজ্ঞানিক বিপ্লব
ঘটিয়ে দিয়েছিল।
তেইশ
বছরের তরুণ যে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেছিলেন, তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল যখন, তখন
তাঁর বয়স বাষট্টি। রঙ ও আলো নিয়ে নিউটনের প্রায় চল্লিশ বছর ব্যাপী গবেষণা ও
চর্চালব্ধ জ্ঞান 'অপটিক্স' নামে বইতে প্রকাশ পেল। প্রথমে ইংরেজি ভাষায় ১৭০৪
খ্রিস্টাব্দে 'অপটিক্স' বেরিয়েছিল। পরে ১৭০৬ এ তার একটি ল্যাটিন সংস্করণ বেরোয়।
নিউটনের প্রয়াণের বাইশ বছর পর জন্মেছিলেন গ্যেটে। কিন্তু ওই যে নিউটন সাদা আলোকে
বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে তা আসলে ভিন্ন ভিন্ন রঙের আলোর সমবায়ে তৈরি, এই ধারণাটি গ্যেটের
পছন্দ হয় নি। গ্যেটে আসলে রঙ চোখের মধ্যে কি প্রভাব ঘটায় তা নিয়ে যত্নসাধ্য ও
নিয়মনিষ্ঠ চর্চা করেছিলেন। তাঁর চর্চার পথ ছিল নন্দনতত্ত্ব ঘেঁষা। আধুনিক বিজ্ঞান
কিন্তু দাবি করে কোনো একটা জিনিসকে বিশ্লেষণ করে তাকে গণিতের সূত্র হিসাবে
প্রতিষ্ঠা করে দেখানো। গ্যেটে বলেছিলেন, রঙ আসলে একটি ঘন ঘোর অশান্ত মাধ্যমের মধ্যে
আলো ও অন্ধকারের গতিশীল খেলা।
জার্মান
দার্শনিক আর্থার শোপেনহাওয়ার (২২ ফেব্রুয়ারি ১৭৮৮ - ২১ সেপ্টেম্বর ১৮৬০) গ্যেটের
থিওরি অফ কালারস (১৮১০) বইটির ভিত্তিতে তাঁর সঙ্গে ১৮১৩-১৪ খ্রিস্টাব্দে দীর্ঘ
আলোচনা করেন। প্রথমে চব্বিশ পঁচিশ বছরের তরুণ শোপেনহাওয়ার গ্যেটের চিন্তা ভাবনা
গ্রহণ করলেও ক্রমশই তাত্ত্বিক প্রশ্নে মতবিরোধ হতে থাকে। গ্যেটের বয়স তখন
পঁয়ষট্টি বৎসর। তরুণ শোপেনহাওয়ারের সঙ্গে বিতর্কে জড়াতে গ্যেটের ভাল লাগে নি।
তিনি নিজেকে শোপেনহাওয়ারের থেকে দূরে সরিয়ে নেন। শোপেনহাওয়ার মনে করতেন, ছায়াময়
মেঘলাটে অন্ধকার আলোর সঙ্গে নানা মাত্রায় মিলেজুলে বর্ণ তৈরি করে। আর সেই বর্ণালীর
দুই প্রান্তের চূড়ান্ত বিন্দুতে রয়েছে সাদা এবং কালো। আর তারই মধ্যে আলো আর
অন্ধকারের ভিন্ন ভিন্ন আনুপাতিক মিশ্রণে তৈরি হয় ভিন্ন ভিন্ন রঙ। আর্থার
শোপেনহাওয়ার নিজের তত্ত্বকে 'অন ভিশন অ্যাণ্ড কালারস' নামে ১৮১৬ সালের মে মাসে
প্রকাশ করলেন। তখন তাঁর আঠাশ বছর বয়স। শোপেনহাওয়ার নিজের তত্ত্বকে গ্যেটের
তত্ত্বের চাইতে উচ্চতর জায়গায় রাখলেও গ্যেটের তত্ত্ব যে তাঁর ভাবনাকে উদ্দীপ্ত
করেছিল, সে স্বীকৃতি দিতে কুণ্ঠিত হন নি। রঙ
নিয়ে গ্যেটের গবেষণা আরেকজন বিশ্ববন্দিত দার্শনিক অধ্যাপককে চিন্তা ভাবনায়
উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অস্ট্রিয়ান দার্শনিক
লুডউইগ উইটজেনস্টাইন (২৬ এপ্রিল ১৮৮৯ - ২৯ এপ্রিল ১৯৫১)। তিনি ভাষার দার্শনিকতা,
গণিতের দার্শনিকতা ও তর্কশাস্ত্র নিয়ে কাজ করে গভীর প্রভাব রেখে গিয়েছেন।
উইটজেনস্টাইন তাঁর বাষট্টি বছরের জীবনের একেবারে অন্তিমে মৃত্যুর এক বছর আগে, ১৯৫০
খ্রিস্টাব্দে গ্যেটের থিওরি অফ কালারস সূত্রে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন।
উইটজেনস্টাইনের মৃত্যুর পর ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে 'রিমার্কস অন কালার' নামে সে বইটি
প্রকাশিত হয়।
আরেকজন
তরুণ জার্মান দার্শনিক নোভালিস ( ২ মে ১৭৭২ - ২৫ মার্চ ১৮০১) যাঁর প্রকৃত নাম
গেওর্গ ফিলিপ ফ্রিডরিশ ফ্রেইহার ভন হার্ডেনবার্গ অকুণ্ঠভাবে গ্যেটের প্রশংসা করে
গিয়েছেন। বলেছেন, গ্যেটের গবেষণাগুলি পদার্থবিজ্ঞানে যুগান্তর এনে দিয়েছে। একজন
শিল্পী তাঁর নিজের জগতে থেকে এইভাবে আমাদের শিক্ষিত করে গেলেন, যা অতিক্রম করতে
আমাদের সেই মাপের কঠিন পরিশ্রম করতে হবে, যেভাবে প্রাচীন জ্ঞানসাধকদের অবদান
অতিক্রম করে যেতে হয়। নোভালিসের মৃত্যু হয়েছিল আঠাশ বছর বয়সে। বেশ বোঝা যায়, গ্যেটের
গবেষণা তরুণ দার্শনিকদের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। দীর্ঘ জীবনে ঈশ্বর নিয়ে নানাবিধ টীকাটিপ্পনী কেটেছেন গ্যেটে। তিনি
বলেছেন, ঈশ্বর যদি আমাকে অন্য রকম করে গড়তে চাইতেন, তা তিনি করতেই পারতেন।
বলেছেন, একটা লোক যেমন, তার ঈশ্বরও ঠিক তেমনি। ওই কারণেই ঈশ্বরকে নিয়ে এত ঠাট্টা
মজা ইয়ার্কি করা যায়। দীর্ঘদিন ধরে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করতে করতে প্রকৃতির নিয়মগুলি
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনেছিলেন গ্যেটে। সেই চর্চার জোরে প্রাকৃতিক বৈজ্ঞানিক নিয়মের
উচ্চতাগুলি উপলব্ধি করেছিলেন তিনি। সেই পুঁজিতে মজার ছলে বলেছিলেন, প্রকৃতি এতটাই
সঠিক যে ট্রিনিটির পক্ষেও তাকে আরো বেশি সঠিক করার উপায় নেই। প্রকৃতি যেন এক
অর্গান যন্ত্র, তাতে আমাদের ভগবান চাবি টিপে চলেছেন আর শয়তান তাঁর সঙ্গে তাল
মিলিয়ে বেলো ঠেলে হাওয়া যোগাচ্ছেন।
ট্রিনিটির স্থান
খ্রিস্টীয় ধর্মীয় পরিমণ্ডলে খুব উঁচুতে। সেটি পিতা পুত্র আর পবিত্র আত্মার সম্মিলিত
ঐক্যবদ্ধ ধারণা। ট্রিনিটির পক্ষে প্রকৃতিকে বাগে আনা অসম্ভব এই কথা বলে, আর শয়তান
ও ভগবানকে যৌথভাবে অর্গান বাজানোর কাজে লিপ্ত দেখিয়ে নিজের মানসিক গঠনটা খুব সপাটে
বলে নিয়েছেন গ্যেটে। ঈশ্বরকে একটা
খামখেয়ালি অস্তিত্ব হিসেবে বর্ণনা করে বললেন, ঈশ্বর আমাদের চাইতে ঢের বেশি
শক্তিমান আর অনেক বেশি বুদ্ধিমান। তাই তিনি আমাদের নিয়ে যেমন ইচ্ছে খেলতে
ভালবাসেন। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দে জার্মান সুরসাধক বন্ধু কার্ল জেল্টার (
১৭৫৮ - ১৮৩২) কে একটি চিঠিতে গ্যেটে লিখেছিলেন, বিশ্বের বিরূপ চাপে আমরা উৎসাহ
উদ্দীপনা পাই, চাপেও পড়ি। আমরা যদি আমাদের নিজেদের সাহায্য করি, তাহলেই ঈশ্বর
আমাদের সাহায্য করে থাকেন। ধর্ম
সম্পর্কে বলেছিলেন, যার চর্চায় আর্ট আর সায়েন্স রয়েছে, ধর্ম তাকে ধারণ করে রয়েছেন।
যার চর্চায় তা নেই, তারই ধর্মের দরকার বটে। ১৮৩১
খ্রিস্টাব্দে জীবনের অন্তিম পর্বে গ্যেটে বললেন, ওই যে লোকে কনফেশন করে, ওইটি
আমার মেজাজের সঙ্গে ঠিক যায় না।
প্রবীণ বয়সে ১৭৭২ থেকে ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে গ্যেটে লিখলেন তাঁর মাস্টারপিস, বা ম্যাগনাম ওপাস বা তাঁর সেরা রচনাটি, ফাউস্ট। এটি একটি ট্র্যাজিক নাটক। ফাউস্ট এর ধারণা রয়েছে জার্মান লোককথায়। মধ্যযুগীয় এক লিজেন্ডে ফাউস্ট নামে এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পাওয়া যায়, যে জ্ঞান আর ক্ষমতা পাবার জন্য নিজের আত্মাটিকে শয়তানের কাছে বেচে দিয়েছিল। ফাউস্ট শব্দটি নানার্থ। কখনো এ শব্দের অর্থ ভাগ্যবান, আবার কখনো ম্যাজিশিয়ান। তবে ফাউস্ট যে শয়তানের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল এ কথা বহুদিন ধরেই চলে আসছে। গ্যেটের নাটকে আমরা পাব হাইনরিশ ফাউস্টকে, একজন প্রবীণ জ্ঞানভিক্ষু বুদ্ধিজীবী নাগরিক। আর আছে একটা রাস্তার কুকুর, মেফিস্টোফিলিস, ও যেন শয়তান। আর আছে একটি মেয়ে, মার্গারেট, তার থেকে সংক্ষেপ করে আদরের নাম তার গ্রেচেন। গ্রেচেন নামে নবীনা মেয়েটি প্রবীণ ফাউস্টের ভালবাসার পাত্রী।ভগবানের সঙ্গে শয়তানের কথা হচ্ছিল। শয়তান ভগবানের সঙ্গে বাজি রাখল যে সে জ্ঞানী ফাউস্টকে অধিকার করবে। গ্যেটে দুইখণ্ডে এই ট্রাজিক নাটক রচনা করেছিলেন। ১৭৯০তে একটি মুদ্রণ হলেও সেটিকে মেজে ঘসে ফাউস্টের প্রথম খণ্ড হিসেবে বেরোলো ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে। দ্বিতীয় খণ্ডটি গ্যেটের জীবনের অন্তিম বৎসর ১৮৩১ এ লেখা হয়ে প্রকাশ হল ১৮৩২ এ, লেখকের মৃত্যুর পর। ফাউস্ট নাটকে পাই ফাউস্ট ঈশ্বরবিশ্বাসী কি না, গ্রেচেনের এই প্রশ্নের উত্তরে ফাউস্ট বলছেন:
Leave
that, child! Truly, my love is tender;
For
love, blood and life would I surrender,
For
Faith and Church, I grant to each his own.
My
darling, who shall dare
‘I
believe in God!’ to say?
Ask
priest or sage the answer to declare,
And
it will seem a mocking play,
A
sarcasm on the asker.
Hear
me not falsely, sweetest countenance!
Who
dare express Him?
And
who profess Him,
Saying,
I believe in Him?
Who,
feeling, seeing,
Deny
His being,
Saying:
I believe Him not!
সাধে গ্যেটে সম্পর্কে পরম শ্রদ্ধায় কবি হাইনরিশ হাইনে ( ১৩ ডিসেম্বর ১৭৯৭ - ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬) বলেছেন,
" দি গ্রেট হীদেন, অর্থাৎ মহান ধর্মহীন!"
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন