কাকতাড়ুয়ার গল্প : উত্তরের প্রলয় জীবনের কথারা
প্রলয়ের সাথে সরাসরি পরিচয় নেই, ফেসবুকেই পরিচয়, ফেসবুকের ওয়ালে তার লেখাগুলি মন কাড়ত খুব। দিনহাটায় জাফরের বুকক্যাফে থেকে অনেকদিন আগে পাই প্রলয় নাগের 'কাকতাড়ুয়ার গল্প' গল্পগ্রন্থটি। আজ করোনার দ্বিতীয় টিকা নেওয়ার পর অবসরে দুপুরে পড়তে বসি গল্পগ্রন্থটি। শেষ না করে উঠতে পারলাম না প্রলয়ের লেখার গুনে, গল্প বলার নতুন লেখনীতে আর আশেপাশের পরিচিত পরিবেশের টানে। এই গল্পগ্রন্থটি ১২টি গল্পে সমৃদ্ধ। তারমধ্যে ৭টি গল্প অন্য নামের আর গল্পগ্রন্থের নামের সিরিজে আছে ৫টি গল্প। গল্পগ্রন্থটি উৎসর্গ করা আমার খুব প্রিয় একজন অধ্যাপক তপোধীর ভট্টাচার্য ও ওঁনার স্ত্রী স্বপ্না ভট্টাচার্য মহাশয় মহাশয়াকে।
প্রথম গল্পটির নাম 'ফড়িং'। গল্পটির পটভূমি
কোচবিহারের মধুপুর ধাম পার করে তোর্ষার চরভূমি। যেখানে মুসলমান লেখাপড়া না করা
ইয়াকুব ও হিন্দু অবস্থাসম্পন্ন লেখাপড়া করা ছেলে ফড়িং পরস্পর অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু। ইয়াকুবের সাথে
মিশতে যাওয়া নিয়ে ফড়িংএর মায়ের নানান বিধিনিষেধ ছিল, তবে
ফড়িং ইয়াকুবের সাথে মিশত। ইয়াকুবের হাত ধরে সে কোচবিহার শহর, রাজবাড়ি, সাগরদীঘি
দেখতে বেড়িয়ে পড়ে। রিকশাওয়ালার ভুল ঠিকানা দেখিয়ে দেওয়াতে তারা সাগরদীঘির বদলে
পৌঁছায় যৌনপল্লিতে, তবে তাদের হাত থেকে ছাড়া
পেয়ে আবার তারা বাড়িতে ফেরে। ইয়াকুবের জন্য ফড়িংদের নৌকো তোর্ষায় ভেসে যায়, তবু
ফড়িং ইয়াকুবের স্বাধীন জীবনের নেশা ত্যাগ করতে পারে না। ইয়াকুব নিজেকে বলত এই
তোর্ষার রাজা, তোর্ষা ছেড়ে সে ভুটানে
বাবার সাথে কাজ করতে যায় কিন্তু মন টিকিয়ে রাখতে পারেনি, সেখান
থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে সে স্টেশনে চায়ের দোকানে থাকে পাঁচ বছর সেখানেও মন বসেনি তার।
অতঃপর তারজন্য তার মা তার বাবার কাছ থেকে তালাক পায়। নদীতে ভেসে ওঠা চরের দাঙ্গায়
ইয়াকুব ফড়িংএর কাকার আঘাতে মরা যায়,
ইয়াকুবের মা সিরাজ মিঞার
সাথে বিয়ে করে চলে যায়, তাদের ঘর চর আবার ভাঙলে
দখল করে ফড়িংরা কিন্তু ফড়িংএর মনে থেকে যায় ইয়াকুবকে। যে তার জন্য ভুটান থেকে পেট
মোটা বুদ্ধের ছবি আনে, মিষ্টির দোকানে কাজ করার
সময় মিষ্টি খাওয়ায়, নিরুদ্দেশ থেকে ফিরে এসে
নিষিদ্ধ বই দেখায়। চরের জন্য জমির মালিকানার জন্য মরতে হয় ইয়াকুবকে। কামরাঙা
গাছের এখনও ফড়িং খুঁজে বেড়ায় ইয়াকুবকে,
যে একবার নিরুদ্দেশ থাকার
পর মধুপুর মেলায় চোখ আটকে ফড়িংএর কাছে জানতে চায় সে কে? কিন্তু
এবার ফড়িং বোঝে ইয়াকুব আর নেই। গল্পটি পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে চর জীবনকে নিয়ে লেখা
দু'টি উপন্যাসের কথা একটি অমরেন্দ্র ঘোষের 'চরকাশেম' ও
আরেকটি আবু ইসহাকের 'পদ্মার পলিদ্বীপ'। বুড়ো খোকাদের
ভারত ভাগে আজও সহজখোকাদের মনের মিলে এভাবেই বাধা হয়।
দ্বিতীয় গল্পটি 'শিমুলতুলো'। বৌ মরা নারায়ণ
আর তার আইবুড়ো মেয়ে শিমুলের গল্প। শিমুল তার গাভীকে নিয়ে সংসার বজায় রাখে, আর এদিকে তার বাবা নারায়ণ মেয়ের পরিশ্রমের টাকায়
খেতে থাকে। গ্রামের হাঁটে আমরা আজও দেখি ভাঁওতাবাজি জ্যোতিষীদের তাদের তাবিজ, কবজের
সরঞ্জামকে, একদিন নারায়ণের মেয়ের বিয়ে দেওয়ার হুশ হয় সে টাকার জন্য
কোচবিহার মাথাভাঙ্গার নিশিগঞ্জের হাটে সেই লোক ঠকিয়ে টাকা উপার্জন করতে যায়। এদিকে
শিমুল কখনই চায় না লোক ঠকানোর টাকায় তার বিয়ে হোক। শিমুলের গাভী মরে, বাছুর
মরে পরে একদিন শিমুলও মরে। যে নারায়ণ হাঁটে লোকের ভাগ্য বলে, অনেক
আইবুড়ো মেয়ের বিয়ে দেয় তাবিজের গুনে,
সে তার মেয়ের বিয়ে কিংবা
জীবন দিতে পারে না। যে শিমুল গাছ নারায়ণের বৌএর প্রিয়, যার
কারণে মেয়ের নাম শিমুল, শিমুল মারা যাবার পর সেই
গাছের তুলো নারায়ণের ভেজা শরীরেরও পেছন ছাড়ে না। পরিচিত পরিবেশে, পরিচিত
অলস জীবিকায় কিভাবে সম্পর্ক ভাঙে প্রলয় নাগ আমাদের তা দেখান তার নিপুন গল্প
বুনোটে।
তৃতীয় গল্প 'মহামায়া
মিষ্টান্ন ভাণ্ডার'। তিনবার বিয়ে হওয়া মহামায়া স্বামী ছেড়ে আসে বাবার
বাড়িতে। তার মা তাকে তিনবার বিয়ে দিতে নিঃস্ব হয়ে গেছে। মহামায়া তাই নিজের
রোজগারের জন্য চায়ের দোকান খোলে। রূপের সাথে চা মিশিয়ে সে খোদ্দের বাড়ায়, কিন্তু
কখনও সীমা ছাড়ায় না। মাঝে মাঝে যতীন তার গরম বাড়ায় তবু সে তার সীমানা ছাড়ায় না।
বিডিও অফিসের সামনে তার চায়ের দোকান একদিন কৃষকদের আন্দোলনের আগুনে পুড়ে যায় তার
সাধের দোকান, পুড়ে যায়, পরে
মারা যায় তার একমাত্র সন্তান, পোড়ে তার রূপও। তবু যতীন
তাকে জীবিকার জীবনে আনে কিন্তু রূপ পুড়ে যাওয়ায় আর খোদ্দের জোটেনা তেমন মহামায়ার।
তবু যতীন মহামায়ার ভালোবাসা ছাড়ে না। 'তবু মহামায়ার মন নরম হয় না- আর
যতীন হালও ছাড়ে না। যদিও যতীনের মাথার চুল আরও বেশি সাদা হয়ে গেছে।'(মহামায়া
মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, পৃ-৩৯)
চতুর্থ গল্প 'মহুয়ার
গল্প'। সেখানে আছে অবৈধ পরকীয়া আর বাংলাদেশ ছেড়ে চলে আসে মহুয়া ইণ্ডিয়া। সেখানে সে
আত্মহত্যা করা
মৃত স্বামীর চেয়ে বেশি মনে করে অবৈধ প্রেমিক নিবারণ কবিরাজকে। মহুয়ার মেয়ে মারা যায়
সাপের কামড়ে, এখনও প্রথা অনুযায়ী সে তার
মেয়েকে ভাসিয়ে দেয় ভেলায়, মহুয়ার বিশ্বাস তার মেয়ে
ভাসতে ভাসতে চলে যাবে নিবারণের কাছে,
সেই বাঁচিয়ে তুলবে তার
মেয়েকে। এই ভাবনায় সে জামালদা চ্যাংড়াবান্দা হয়ে অবৈধ পথে পৌঁছায় বাংলাদেশ।
সেখানে দেখা হয় রশীদের সাথে। তার কাছে জানতে পারে নিবারণ মারা গেছে একটি মেয়েকে
বাঁচাতে গিয়ে কিন্তু মেয়েটির গায়ের রং কালো। অবশেষে মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে লোকের
চোখে পাগলী হয়ে ওঠে মহুয়া, তার ভারতে আসা হয় না। লেখক
আশা জিইয়ে রাখে এভাবেই। এই বিশ্বাসকে নিয়েই তো আমাদের জীবন এগিয়ে চলে।
পঞ্চম গল্প 'ডুয়ার্সের
কোলে' বন্ধু বান্ধবদের সাথে রকি আইল্যান্ডের ঘুরতে যাবার
বর্ণনাতে আমার মনে পড়ে বন্ধু সুবীরের সাথে তার নতুন এনফিল্ড বাইকে সানতালিখোলা
ঘুরতে যাবার কথা, ফেরার সময় রকি আইল্যান্ড
হয়ে ফেরা। তবে এই গল্পে মুখ্য গল্প গল্পের ভিতরের গল্পটি লেখক আর তার দাদার
একদিনের জন্য ইসলামপুরে পাগল হয়ে ঘোরার শখ। সেখানে এক পাগলীর সান্নিগ্ধতা লাভ
করা। যার আদল আবার পায় লেখক রকি আইল্যান্ডের মোমোর দোকানে। হিসেবী জীবনে বেহেসেবী
শখ বহেমিয়ান যাপন আমাদের পাগল পাগলীর সাথে এক করে দেয়।
'
অনুপ্রবেশ' গল্পে আমরা দেখি কীভাবে পরস্পর হিন্দু-মুসলমান একসাথে থাকলেও আর থাকা যায় না সুযোগলোভী সাম্প্রদায়িকতার কারণে। ভারতে অনুপ্রবেশের কালেও মারা পড়ে দুলাল ও করিম শেখ। বাংলাদেশে দুলালের মা পড়ে থাকে আর ইন্ডিয়াতে দুলালের কন্যা সোনা। ছেঁড়াতারের মত শুকিয়ে যায় দুজনারই ভালোবাসার শিকড়। আমার এই গল্পের মায়ের চরিত্রটি পড়তে গিয়ে মনে পড়ে হাসান আজিজুল হকের 'আগুনপাখি' উপন্যাসের গৃহবধূ নায়িকার কথা, যিনি ভারত দেশ ছাড়েনি, যাকে ছেড়ে চলে যায় সবাই। আর সোনা ও করিম শেখের চরিত্রদুটি পড়তে গিয়ে মনে পড়ে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নীলকণ্ঠপাখির খোঁজে' উপন্যাসের খোকা সোনা আর ঈশম শেখের কথা।
'ভুটান রাজার সুখ' গল্পে
আমরা পাই দয়ার জীবনযাপনের কথা, তার পেকে যাওয়ার কথা।
রেশনের চাল থেকে লটারীর জীবিকার কথা। আলে সাইকেল চালাতে চালাতে শিখে যাওয়া জীবন।
সান্তনার সাথে জড়িয়ে পড়া। জীবনে গরিব দয়া সান্তনা আজ এভাবেই প্রেমে জড়ায়, সমাজ
সেখানে দয়ার মায়ের মত সান্তনাকে খারাপ মনে করে।
'কাকতাড়ুয়ার গল্প-১' এ
আমরা দেখি মাথাভাঙ্গার সুটুঙ্গা নদীতে ১৯ বছরের এক মেয়ের লাশের কথা। যেই লাশ লাশঘর
থেকে চুরি হয়। রাজনীতির কারণে সেই লাশের খোঁজ পড়ে, দুই
লক্ষ টাকা পুরুষ্কার ঘোষণা হয়, পরের দিন আরেকটা লাশ পাওয়া
যায় একই বছরের মেয়ের কেউ বলে একই মেয়ে,
কেউ বলে এক নয়। সেই লাশও
চুরি হয় পরের দিন।
'কাকতাড়ুয়ার গল্প-২' মদনের
অনাথ জীবন আবার আনাথ হয়। যারা তাকে শরীরের খেলা শেখায় তারা ভালোবাসার সময় পাত্তা
দেয় না। পরে এক বিধবা বৌ মদনের রতি হয়,
সেখানেও সবাই তাদের পরকীয়া
আখ্যা দেয়। গ্রাম ছাড়া করে। মদনের মনে হয়-
'সাধের জনম মাটি হইয়া গেল
রে,
ওরে প্রেম কইয়াছি অবুজ বয়সে-
প্রেম কারে কয় বুঝি নাই রে,
সাধের জনম মাটি হইয়া গেল রে।'('কাকতাড়ুয়ার গল্প-২,
পৃ-৭৬)
'কাকতাড়ুয়ার গল্প-৩' গল্পে
আমরা দেখি ভাটিয়া আর দেশির জীবন কথা,
ভাটিয়াদের গল্প দেওয়ার
গল্প ও আব্বার বাপের মৃত্যুর গল্প।
'কাকতাড়ুয়ার গল্প-৪' বউ
পেটানো কেষ্টার কথা। ভাগ্য তাকে আবার সোনার কারিগর থেকে আবার পারিবারিক জীবিকা 'চামারে' রূপান্তরিত
করে।
'কাকতাড়ুয়ার গল্প-৫' গল্পে
আমরা দেখি কাকতাড়ুয়ার গল্পকার হবার শখ,
জীবনের কোনো গল্পই তার
ভালোলাগেনা পড়ে এক স্বপ্নে পাওয়া চোরের না পাওয়া ভালোবাসার গল্প তার পচ্ছন্দ হয়, কিন্তু
তা ভাষার জন্য আর কাহিনির জন্য সম্পাদকের পছন্দ হয় না। বাধ্য হয়ে সে বাঁশি
বাজায়।
প্রলয় মাথাভাঙ্গা শহরে জন্মগ্রহণ করে ২৮
এপ্রিল ১৯৮৮। তার প্রতি গল্প
ছুঁয়ে আছে আমাদের আশেপাশের চেনা জায়গা,
জীবন যাপন,
ভালোবাসা পরকীয়ায় জড়িয়ে থাকা ভালোমন্দ মিশিয়ে থাকা চেনা মানুষেরা। তার গল্পের
কাহিনিগুলি অভিনব। শক্তিশালী গল্পকার প্রলয়। তার দেখার চোখ মনন ও বোধ ছুঁয়ে থাকে।
গল্পের শৈলি কোথাও আমাদের অলস করে না। আশা
করব প্রলয়ের কাছে আমরা আমাদের চেনা উত্তরের জনপদের গল্পগ্রন্থ আমরা আরো পাব অভিনব
কাহিনির সাথে।
“কাকতাড়ুয়ার গল্প”
প্রলয় নাগ
একুশ শতক
প্রচ্ছদ:
প্রবীর আচার্য
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি
২০১৮
মূল্য-
১৫০ টাকা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন