কুক্কুটারমা
যার অর্থ হয়ত কেউ কেউ আন্দাজ করতে পারবেন,
কুক্কুট, এই শব্দটি বাংলা ভাষাতেও রয়েছে।
‘কুক্কুট’- এই শব্দটি নিয়ে
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অনন্য-মধুর স্মৃতি-বিজড়িত এনেকডোট রয়েছে। আধুনিক
বাংলা কবিতার এক অন্যতম স্রষ্টা সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে (১৮৬১ – ১৯৪১) নিয়ে সেই কাহিনী।
একবার প্রাজ্ঞ রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ মজা ও কৌতুকের ছলে বহু বিষয়ে অগাধ পড়াশোনা করা খানিক
গম্ভীর স্বভাবের সাতাশ বছরের ঝকঝকে তরুণ সুধীন্দ্রনাথকে এক আপাত চটুল বিষয় ‘মোরগের
কবিতা’ রচনা করতে বললে সুধীন্দ্রনাথ মোরগ নয়, বেছে নিয়েছিলেন এই কুক্কুটকে!
লিখেছিলেন (যেন ‘মেঘার্ত পাণ্ডুর শশী,’ ঘনায়মান
মেঘ ও প্রলয়…):
"শূন্যগর্ভ নভস্থল অকস্মাৎ অনুনাদে অনুনাদে
ভরি।
তরঙ্গিল সারা বিশ্বে হে কুক্কুট, তোমার মাভৈ।“
কবিতার নাম: কুক্কুট। (যা মূলত সুধীন্দ্রনাথের প্রথম প্রকাশিত কবিতা, প্রকাশিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগে, প্রবাসী পত্রিকায় ১৯২৮ সালে)।
পরে যিনি আরো লিখবেন:
“জন্মাবধি যুদ্ধে, বিপ্লবে বিপ্লবে
বিনষ্টির চক্র বৃদ্ধি দেখে,
মনুষ্যধর্মের স্তবে নিরুত্তর, অভিব্যক্তিবাদে
অবিশ্বাসী, প্রগতিতে
যত না পশ্চাৎপদ, ততোধিক বিমুখ অতীতে।
…
জাতিভেদে বিবিক্ত মানুষ, নিরঙ্কুশ
একমাত্র একনায়কেরা। কিন্তু তারা
প্রাচীর, পরিখা, রক্ষী, গুপ্তচর ঘেরা প্রাসাদেও
উন্নিদ্র যেহেতু, তাই ভগ্ন সেতু নদীতে নদীতে,
মরু নগরে নগরে।” (‘যযাতি’)
অথবা
“স্টেপের প্রসারে লোকালয় নিরুপায়"
(‘প্রত্যাবর্তন’)!
তো ‘কুক্কুটারমা’ নাম প্রসঙ্গে ফিরি।
প্রখ্যাত এপিগ্রাফিস্ট ইরাবাথাম মহাদেবন (১৯৩০ - ২০১৮) তাঁর সিন্ধু লিপির নিবিড় গবেষণায় প্রাচীন তামিল ভাষার ব্যাকরণ ও শব্দাবলীর কাঠামো ব্যবহার করে সিন্ধু লিপির অর্থের কিছু হদিশ পাওয়ার চেষ্টা করেছেন, সিন্ধু সভ্যতায় ব্যবহৃত ভাষার সঙ্গে প্রত্ন দ্রাবিড় ভাষার তুলনামুলক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সিন্ধু সভ্যতার সময়ের শীল ইত্যাদির তথ্য উদ্ধার করতে গিয়ে আবিষ্কার করেছেন যে মহেঞ্জদারোর আরেকটি সম্ভাব্য নাম ‘কুক্কুটারমা’। ‘কুক্কুট’ শব্দটি বর্তমান ভারতের প্রায় সমস্ত ভাষাতেই রয়েছে। কি দক্ষিণ, কি উত্তর, অথবা পূর্ব! সংস্কৃতেও এই শব্দটি রয়েছে।
মানব জাতির দীর্ঘ মহাপরিগমণের ইতিহাস বুঝতে
গিয়ে নৃতত্ববিদ, পুরাতত্ববিদ, ভাষাবিদ, তথা ঐতিহাসিকেরা আধুনিক বিজ্ঞান, জেনেটিক্স
ইত্যাদির প্রয়োগে জানতে পেরেছেন মানব জাতির দীর্ঘ ইতিহাসে তার উৎস ও বিশ্ব ব্যাপী ছড়িয়ে
পড়ার আশ্চর্য প্রাগৈতিহাসিক এবং ঐতিহাসিক কতসব ঘটনাবলী।
যেমন জানা গেছে যে স্টেপ অঞ্চল থেকে নর্ডিক
জনজাতির ভারতে আসার আগেই তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগের প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে যোগাযোগের
কথা। আর জানা যাচ্ছে আনুমানিক ৬০০০-৫০০০ সাধারণ পূর্বাব্দে বা তারও কিছু আগে পশ্চিম
এশিয়ার সুমের অঞ্চলের জাগ্রোস পর্বতের (বর্তমান ইরাক ও ইরানের সীমানা বরাবর বিস্তৃত)
পূর্ব দিক থেকে আরও পুব দিকে সরে আসা প্রাচীন এক কৃষিজীবী, ও পশুপালক (এবং সম্ভবত কিছুটা
ব্যবসা বাণিজ্য করতে জানা) জন জাতি গোষ্ঠীর সঙ্গে প্রত্ন ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে
উপমহাদেশের পশ্চিম, উত্তর পশ্চিম অংশে ক্রমশ এক উন্নত ইন্দাস বা সিন্ধু সংস্কৃতির উন্মেষ
ঘটতে থাকে ৩৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দে। এখানে প্রত্ন ভারত বলতে বোঝাচ্ছে মূলত প্রত্ন দ্রাবিড়-আন্দামান,
প্রত্ন অস্ট্রো-এশিয়াটিক ইত্যাদি প্রাথমিক ভারতীয় ভাষা গোষ্ঠী সংস্কৃতি- যা ভারতে দীর্ঘ
সময় ধরে গড়ে উঠেছিল।
আফ্রিকা থেকে কিছু আদিম জনগোষ্ঠী প্রায় ৬৫০০০
বছর আগে সমুদ্র উপকূল অঞ্চল ধরে দীর্ঘ সময় ধরে নানা ভাবে পরিবর্তিত অভিযোজিত হতে হতে
দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে পৌঁছয়, এবং পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় ধরে ধীরে ধীরে
তার কিছু শাখা আরো বিভক্ত হয়ে ভারতের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূল ধরে আরো দক্ষিণ হয়ে ভারতের
দক্ষিণ পূর্ব উপকূল ধরে এগিয়ে উত্তর পূর্বে পাড়ি দেয়, এবং উপমহাদেশে প্রত্ন ভারতীয়
বিভিন্ন জন গোষ্ঠী হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। যার মধ্যে অস্ট্রো-এশিয়াটিক এবং ক্রমশ উত্তর ও
উত্তর পূর্বের পাহাড়ি তিব্বতি বার্মিজ গোষ্ঠীরও মিশ্রণ ঘটে।
এরকমই এক বা একাধিক প্রাচীন ভারতীয় জনজাতির
বিকাশের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতের উত্তর পশ্চিমে আনুমানিক ৮০০০-৭০০০ সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে
সিন্ধু সভ্যতার প্রাথমিক স্তর গড়ে উঠছিলো, যা ৩৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দ নাগাদ (সম্ভবত
আরো পশ্চিমের ইরান অঞ্চল থেকে আসা জনজাতির মারফত কিছুটা সুমেরীয় প্রভাবে) এক অনন্য
প্রাচীন সভ্যতায় পরিণত হয়, যা ভারতীয় আঞ্চলিক ভৌগোলিক ঐতিহাসিক প্রভাবে সুমের সভ্যতা
থেকে গুণগত ভাবে বেশ আলাদাও। অর্থাৎ এটি সুমের সভ্যতার কোনো কলোনি বা উপনিবেশ নয়, বরং
স্বাতন্ত্র নিয়ে গড়ে ওঠা এক অনন্য ভারতীয় "মিশ্র" সভ্যতা। স্টেপ অঞ্চল থেকে
আসা নর্ডিক জনগোষ্ঠী এদেশে প্রবেশ করতে থাকে উত্তর ও উত্তর পশ্চিমের পাহাড়ি প্রাচীন
গিরিপথ দিয়ে প্রায় ১৭০০ - ১৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দ নাগাদ। মধ্য এশিয়ার আনাতোলিয়া পাহাড়ের
স্টেপ অঞ্চলের প্রাচীন বর্বর হিট্টিটি বা মিত্তানী/ মিতান্নি বা হুরিয় প্রভৃতি জাতির
থেকে ভাগ হয়ে যাওয়া একটি অংশ ছিল ভারতে প্রবেশ করা নর্ডিক আর্য।
আনুমানিক ২৫০০-২০০০ সাধারণ পূর্বাব্দের মধ্যে
আদিম হিট্টিটি জাতি বা তাদের প্রায় সমগোত্রীয় কোনও জনজাতি, যেমন মিত্তানি, হুরিয়ান,
লোহার ব্যাবহার রপ্ত করে ফেলেছিলো। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার এসিরিয়া সুমেরীয়রা ৩০০০ সাধারণ
পূর্বাব্দ নাগাদই প্রথম লোহার ব্যবহার রপ্ত করেছিলো, কিন্তু তার ব্যাপক প্রচলন হয় নি
তখনও । খুব সম্ভবত এদের কাছ থেকেই, আগুনের কার্যকরী ব্যবহারের মধ্যে দিয়ে, প্রাচীন
হিট্টিটি- মিত্তাণী ইত্যাদি জাতিরা লোহার ব্যবহার
শিখে ফেলে ও অস্ত্র, হাতিয়ার, স্পোক যুক্ত চাকা ইত্যাদিতে লোহার ব্যবহার করতে থাকে
এবং শক্তিশালী যোদ্ধা জাতি হিসেবে অভিযোজিত হতে থাকে, সমস্ত মধ্য আনাতোলিয়ার তৃণ ভূমিতে
এদের দখল বাড়তে থাকে। এদের ভাষা সংস্কৃতি ছিল প্রাচীন তাম্র ব্রোঞ্জ সভ্যতাগুলো থেকে
আলাদা, সভ্যতার কেন্দ্রে না থাকা, বরং তার আসেপাশে একটু দূরে-দূরে থেকে বেড়ে ওঠা, শিকারী-সংগ্রাহক,
আধা-যাযাবর, কিছুটা বর্বর, ঘোড়া, রথ, শিকার সহযোগী কুকুরের সাহচর্যে বেড়ে ওঠা পশুপালক,
লোহার গদা-মুগুর-জাতীয় অস্ত্র নির্মাণ ও চালনায় পটু, স্থলবাসি, সমুদ্রবিদ্যা না জানা,
এক উদীয়মান পরাক্রমশালী ‘নতুন’ ‘নর্ডিক আর্য’ জাতি।
মধ্য এশিয়ার প্রাচীন ' বর্বর' জাতির থেকে
ভাগ হয়ে যাওয়া একটি একটি শাখা প্রথমে আনাতোলিয়া অঞ্চল থেকে পশ্চিমে ও উত্তরে ইউরোপের
দিকে সরে যায় ২০০০ সাধারণ পূর্বাব্দ নাগাদ, তারপর সে শাখারই কিছু অংশ আবার আনাতোলিয়া
হয়ে দক্ষিণ পূর্ব ও পূর্ব দিকে সরতে সরতে আনুমানিক ১৭০০ – ১৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দের
মধ্যে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। পৃথিবীর সমস্ত প্রাচীন তাম্র ব্রোঞ্জ সভ্যতাই সেই সময়
এক পরিবর্তনের সাক্ষী থাকছিল, তাম্র যুগ শেষ হয়ে ধীরে ধীরে লৌহ যুগের সূচনার এক প্রারম্ভিক
প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিলো।
২০০০ সাধারণ পূবাব্দের পর থেকে, পশ্চিম ও
উত্তর পশ্চিম ইউরোপের অভিজ্ঞতার প্রভাবে এক অনন্য ভাষা সংস্কৃতি গড়ে উঠছিল, এই ধরণের এক গতিশীল পরিগমণের মধ্যে দিয়েই
খুব সম্ভবত ইন্দো- ইউরোপীয় নামের এক ভাষা গোষ্ঠীর সূচনা হচ্ছিল, ভারতে প্রবেশ করা নর্ডিক
জাতির এই ভাষাই ছিল ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর সেই আদি- সংস্কৃত ভাষা।
প্রাচীন তাম্র ব্রোঞ্জ যুগের সিন্ধু সভ্যতা সেই ৩৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দ থেকে ১৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দের মধ্যে তার উন্নতির শিখরে পৌঁছোবার পর কিছুটা অবনমনের সম্মুখীন, খুব সম্ভবত জলবায়ু পরিবর্তন, খরা ও বন্যা কবলিত হয়ে, যথেচ্ছ বৃক্ষ নিধন, (মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরির জন্য অবশ্যই প্রচুর কাঠ আর আগুনের প্রয়োজন হতো, যার ফলে বৃক্ষ নিধন, এবং গম চাষ ও ধান চাষের জন্য জলের প্রয়োজনে যথেচ্ছ ভাবে কূপ খননের জন্য ভূগর্ভস্থ জলের মাত্রাও হয়তো নেমে যাচ্ছিলো, জমির উর্বরতাও হয়তো কমে আসছিলো। এইসব অসুবিধার সময়েই এক দ্রুত গামী অশ্বারোহী, লোহার ব্যবহার জানা, শিকার ও লুন্ঠন পারদর্শী তথাকথিত 'আর্য' জাতি (মধ্য আনাতোলিয়া অঞ্চল ইরানের উত্তর দিকে অবস্থিত, সম্ভবত প্রাচীন সুমের-ইরানীয় প্রভাব থেকে ইরানিয়ান বা আরিয়ান বা আর্য কথাটির উৎপত্তি) ভারতে প্রবেশ করতে থাকে ।
লিপি হীন এই আর্য ভাষা-সংস্কৃতি ভারতবর্ষের
পূর্বতন 'উন্নত ' এবং প্রাগার্য-প্রাকৃত ভাষা সংস্কৃতিগুলির সংস্পর্শে এসে নিজেও প্রভাবিত
হয় এবং পূর্বের ভাষা সংস্কৃতিকেও ব্যাপক ভাবে প্রভাবিত করে ফেলে। এই পর্বেই ঘটে যাচ্ছিলো
সিন্ধু সভ্যতার পুরোনো জীবনধারা, মূল্যবোধ ইত্যাদির ক্রম অবলুপ্তি এবং পরিবর্তন। স্টেপ
আগত নর্ডিকদের যে গোষ্ঠী এদেশে এসেছিলো তার মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ছিল তুলনামূলক ভাবে
অনেকটা বেশি, যেকোনো যাযাবর, বা যোদ্ধা জাতির মতোই তাই স্বভাবতই তাদের সমাজ ছিল পিতৃ
তান্ত্রিক, ওদিকে আবার প্রত্ন ভারত থেকে প্রাচীন ভারতে গড়ে ওঠা সিন্ধু সভ্যতার কৃষি
কেন্দ্রিক সমাজ ছিল মাতৃ তান্ত্রিক।
সিন্ধু ভারতের প্রাগার্য সভ্যতার কাছে লিপি
ছিল, মৃত্ পাত্ৰ, অলংকার নির্মাণের নিপুণ দক্ষতা ছিল, তন্তু থেকে কাপড় নির্মাণের কুশলতা
ছিল, পশুপালন, সেচের মাধ্যমে উন্নত কৃষি ব্যবস্থা, ব্যবসা বাণিজ্যের হিসাব ও প্রাচীন
প্রযুক্তির জন্য উপযোগী নিঁখুত পরিমাপের গণনা পদ্ধতি ছিল, পোড়া ইটের তৈরি বহুতল গৃহ,
সুসজ্জিত নগর নির্মাণ কুশলতার পাশাপাশি কৃষি ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্য তিথি মাস বছরের
হিসেবও ছিল, পশ্চিমের এবং সম্ভবত পূর্ব ও উত্তর পূর্বের প্রাচীন সভ্যতাগুলোর (মেসোপটেমিয়া,
এবং চীন) সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের উপযোগী সমুদ্র বিদ্যা, বন্দর, দীর্ঘ পথের দিশারী হিসেবে
ভারতের আকাশের উপযোগী নক্ষত্র পরিচয় ছিল, ভারতের ব্যাপক বনাঞ্চলের ভেষজ পরিচয়, যোগ
আয়ুর্বেদ ইত্যাদি ছিল, এবং এই সব বিদ্যা হাজার হাজার ধরে সংরক্ষণের জন্য, প্রজন্মের
পর প্রজন্ম ধরে বয়ে চলা জ্ঞান ধারণ ও প্রসারের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থা, গুরু-শিষ্য প্রথা
গড়ে উঠেছিল। যে কোনও প্রাচীন সভ্যতার মতো এখানেও সমাজে কর্মভিত্তিক শ্রেণীর অস্তিত্ব
থাকা স্বাভাবিক ছিল। মধ্য, উত্তর, পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের ব্যাপক অরণ্যে হাজার
হাজার বছর ধরে বসবাস করা অরণ্যচারী কিরাত, নিষাদেরা ছিল, প্রাচীন সেই প্রাগার্য ভারতের
মূল ধারা (পশ্চিম ও উত্তর পশ্চিম অংশের) এবং অন্যান্য ধারার লৌকিক ধর্ম, তিথি খুব সম্ভবত
চান্দ্রমাস অনুসারে নির্ণয় হতো। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায় বিভিন্ন বাস্তবিক পশু পাখি,
বা মানুষ-মানুষীর মূর্তি পাওয়া গেলেও, উন্নত মানের পোড়া ইট নির্মিত বাড়ি, ঘর, রাস্তা,
নালা, শষ্যগোলা, স্নানের ও জল সঞ্চয়ের জন্য বিরাট জলাধার, বা বাঁধানো পুস্করিণী, নদি
বাঁধ ইত্যাদি ব্যাপক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নিদর্শন থাকলেও, তেমন কোনও তাৎপর্যপূর্ণ বিশেষ
ও ব্যাপক দেব-দেবীর বা ব্যাপক মন্দিরের কাঠামোর
নিদর্শন এখনও পাওয়া যায়নি। পশ্চিম দেশের প্রাচীন মিশর বা গ্রিসের মতো উদ্ভট দর্শন পশু-মানুষের
মিশ্রণে তৈরি কোনও মূর্তির হদিশ পাওয়া যায় না। এ সব থেকে ধারণা করা যায় প্রাচীন ভারতের
ধর্ম আচার ব্যবস্থায় হয়তো প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রভাব ছিল কম। তবে গাছ, পশু-পাখি বা অন্য
কোনও টোটেম যেমন পশুপতি (শিব এর আদি রূপ বলে মনে করা হয়) দেবতার কল্পনা ও আরাধনা হতো
বলে ধারণা করা যায়। প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতায় শবদাহ, মৃত্কলসের ভেতর শবদাহ, শবদেহ ভাঁজ
করে রেখে কবর দেওয়া ছাড়াও ব্যাপক ভাবে মৃতদেহ শায়িত অবস্থায় কবর দেওয়ার প্রথা ছিল,
শবের মাথা উত্তর, বা পূর্ব বা দক্ষিণ দিকে রাখা থাকতো। এখানে বলে রাখা যায় যে ভারতে
মুসলমান ও খিস্টান ছাড়াও বহু অন্ত্যজ গোষ্ঠীর মধ্যে, অনেক বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে,
এবং দক্ষিণে হিন্দুদের পরিবারের বড়ো ছেলে বাদে বাকিদের আজও মৃতদেহ কবর দেওয়ার প্রথা
রয়েছে।
এরকম একটি সমাজ সংস্কৃতিতে ১৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দ
নাগাদ এক ভিন্ন সংস্কৃতির অভিঘাত আসে। যা অত্যন্ত সুদূর প্রসারী গুণগত পরিবর্তন নিয়ে
আসে ভারতের সমাজ মানসে, অর্থনীতি ও ক্ষমতা কাঠামোতে, এবং জীবন চর্যায়। শক্তিশালী লোহা
ও দ্রুতগামী রথের চাকার কাছে খুব সম্ভবত তামা ব্রোঞ্জ ইটের বাড়ির অবরোধ তেমনভাবে ধোপে
টেকেনি। কিন্তু এতো হাজার বছরের অভিজ্ঞান, বিস্তার তো একেবারে কর্পূরের মতো উবে যাবার
নয়! ইতিহাসের কাল বিভাজনে পরবর্তী এই সময়কে বলা হয় বৈদিক যুগ। একসময়ের স্টেপ অধিবাসীরা,
পশ্চিমের সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে কিছুটা জোরাস্ট্রিয়ান ধর্মের আভেস্তা এবং অনেকটা
হেলেনীয় দেবতা বিশ্বের মতো অথচ নিজ অভিজ্ঞতায় সিঞ্চিত এক পৃথক ধর্ম সংস্কৃতি ভাবনা
গড়ে তুলেছিল। ভারত বর্ষে এসে এদেশের প্রথাগত ধর্ম ভাবনা - যার সঙ্গে হয়তো আগে থেকেই
আভেস্তার কিছু পারস্পরিক প্রভাব ছিল, যেমন আগুনের আরাধনা, জলের আরাধনা ইত্যাদি লৌকিক
রীতি রেওয়াজ, যা প্রায় সমস্ত ধর্মেই সাধারণ ভাবে দেখা যায়- তার সঙ্গে সংঘাত ও সংমিশ্রণ
হতে থাকলো। নতুন লোকগাথা কাহিনীর জন্ম হতে থাকলো। যা থেকে পরবর্তীতে সংস্কৃত ভাষায়
মহাকাব্যের জন্মও হবে। রামায়ণ, মহাভারত। যে গল্পের কাঠামোতেও আবার হেলেনিস্টিক বা গ্রেকো-রোমান
মহাকাব্যের কিছু প্রকরণগত মিল পাওয়া যাবে।
তবুও সেগুলি হবে পুরো দস্তুর ভারতীয় উপাদানে ঠাসা। এ ছাড়াও এই সংঘাত সংমিশ্রণে গড়ে
উঠলো অসংখ্য পুরান কাহিনীমালা।
হেলেনীয় ধর্মবীক্ষার সঙ্গে বৈদিক হিন্দু ধর্মের
কিছু আপাত মিলের মধ্যে রয়েছে: আকাশ দেবতা জিউস – স্বভাবে, মেজাজে, আবাসে, অস্ত্র-সজ্জায় প্রজা পিতা ব্রহ্মা
এবং দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গে যার প্রচুর মিল; সমুদ্র দেবতা পসিডন সমুদ্র শায়িত বিষ্ণু-নারায়ণের
সঙ্গে যার আশ্চর্য মিল, যদিও এখানে বিষ্ণুর প্রভাব প্রতিপত্তি অনেকটাই বেশি, তাছাড়া
সমুদ্র বিদ্যার তেমন প্রয়োজন পাহাড় ঘেরা চারণভূমির স্থলবাসী জনজাতির থাকতে পারে না,
তাছাড়া জলের আরেক দেবতা বরুণ ও রয়েছে এদেশে, হয়তো অধিক বৃষ্টিপাতের কৃষিপ্রধান এই প্রাচীন দেশে বরুণ দেবের ধারণা আগে থেকেই ছিল, বৈদিক যুগে
তার সংস্কৃতায়ন হয়েছে, তাই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ "সুদর্শন" "চক্র" হাতে বিষ্ণুকে অন্যতর ব্যাপক ভাবে শক্তিশালী করা হয়েছে,
এবং সমুদ্রগমনের গতিকে ধারণ করেছে চক্রের গতি। পাতালের দেবতা হেডেস-এর সঙ্গে মিলে যায়
যমরাজের ধারণা। পশ্চিমের গ্রিক রোমানদের প্রাচীন হেলেনীয় ধর্মের যেমন বিদ্যা, সম্পদ,
সমস্ত বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা দেব-দেবী আছে, এদেশেও সেরকম চল হলো, আর এদেশের প্রাকৃত
দেব দেবীদের ক্ষমতা খর্ব হলো। শুরু হলো ‘ধর্ম সংস্থাপনের’ অধ্যায়। ১৬০০ থেকে প্রায়
৬০০ সাধারণ পূর্ব-অব্দ পর্যন্ত প্রায় হাজার
বছরের অধিক কাল ধরে চলে এই ব্যাপক ওলোট পালট- যেন সমুদ্র মন্থন! প্রাচীন ভারতের প্রাকৃত,
মাটির কাছাকাছি, অরণ্যচারী, ও লৌকিক, প্রধান দুই দেব-দেবী শিব এবং কালী- এরাও ধীরে
ধীরে নতুন হিন্দু ধর্মে স্থান করে নিলো, অথবা এছাড়া কোনও উপায়ও ছিল না, এত ব্যাপক জনপ্রিয়
ও প্রভাবশালী দেব-দেবীকে অস্বীকার করার। ব্রহ্মা বিষ্ণুর সঙ্গে শিব বা মহেশ্বরেরও স্থান
হলো শীর্ষে । যদিও পুরান ধর্ম গল্প কথায় শিবকে নিয়ে বাকি আর্য দেবতাদের অভিযোগের শেষ
ছিল না। শিবকে বহু ত্যাগ ও অবিচার সহ্য করতে দেখা যায় হিন্দু ধর্মের পৌরাণিক গল্প গাথায়।
শিবকে বশ করতে বা মহিষ-অসুরকে বধ করতে পার্বতীর দশভুজা দূর্গাকরণও সম্পন্ন হয়। ধর্মকে
ধ্বজা করে নিশান উড়িয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে, এবং পূর্বে, চক্রের অধিগমন শুরু হয়, অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন হয়
রাজ্য বিস্তারের লক্ষে। প্রাচীন ভারতের চিরাচরিত প্রাকৃত, বৌদ্ধ বা জৈন ধর্ম ভাবনায়
এক রকমের স্তব্ধতা নেমে আসে। যদিও এই পুরোটা সময় জুড়ে আদি ঋক বৈদিক সংস্কৃতির অনেকটাই
ভারতীয়করণ ঘটতে থাকে, এদেশেরঅভিজ্ঞতা সঞ্চিত রীতি রেওয়াজ জ্ঞান বিজ্ঞান সংস্কার অন্ধ
বিশ্বাস এই সবই বিজয়ীর সুবিধা ও স্বার্থ অনুযায়ী
বৈদিক সংস্কৃতিতে স্থান করে নিতে থাকে।
ক্রমে অবাধ মিশ্রণ, ধর্ষণ, বা যথেচ্ছ যৌনাচার
কমে আসতে লাগলো, এবং রক্ত বংশগতি জাতপাতের কঠিন নিগড়ে বেঁধে শুরু হল এন্ডোগ্যামি বিবাহ
প্রথা। অর্থাৎ নিজের নিজের সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর বাইরে বিবাহ নিষিদ্ধ। সমাজে নেমে এলো
কঠিন অমানবিক এক বর্ণ ব্যবস্থা। যার মুলে ছিল শরীরে আর্য রক্তের আধিক্য অথবা ঘাটতি।
মূলত বাহ্যিক শারীরিক দেখনদারি সর্বস্ব হলেও
পূর্ববর্তী অনেক যৌনাচারের ফলে জন্য জন্মে যাওয়া বহু উচ্চ বংশেও চলে এলো অনার্য রক্ত,
যার ফলে ফর্সা থেকে কৃষ্ণবর্ণ সমস্ত রকমের মানুষই উচ্চ বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ পুরোহিত
সম্প্রদায়, ও ক্ষত্রিয় রাজন্য গোষ্ঠীর মধ্যে চলে আসে। তখন মূলত মুখের ভাষা আর সামাজিক
ক্ষমতা প্রতিপত্তির হিসেবে বর্ণব্যবস্থা চলতে থাকলো। প্রতিবাদীদের, প্রতিরোধকারীদের পুড়িয়ে হত্যা করা, জিভ কেটে দেওয়া, সমাজ থেকে বহিস্কার,
সবই চললো... শক্তিশালী জাতি উপজাতিকে বশ করার জন্য চালু হল তাদের গুরু বা তারা যাদের
কথা মানে শোনে সেই সব সামাজিক ক্ষমতার অধিকারী 'ব্রাহ্মণ' গুরু-পণ্ডিত-মুনি-ঋষিদের
হাত করা। এ প্রসঙ্গে অগস্ত মুনি ও দাক্ষিণাত্যের বিন্ধ্য জাতি তথা পর্বতের কাহিনী মনে
করা যেতে পারে। আধুনিক পরিভাষায় যাকে হেড-হান্টিং বলা চলে।
পুরুষ প্রধান স্টেপ নর্ডিকরা ক্ষমতার চূড়ায়
আসীন হলো, এবং ক্রমান্বয়ে এদেশের পুরুষদেরকে সরিয়ে নারীদের অধিকার নিতে থাকলো, মাতৃ
তান্ত্রিক সমাজ ব্যাপক ভাবে পিতৃ তান্ত্রিক হতে থাকলো। প্রথম কয়েক শতক এইভাবে ব্যাপক
মিশ্রণের ফলে জিনের আদান প্রদানে ক্রমশ এক নতুন মিশ্র জাতির উদ্ভব হতে থাকলো। যার মধ্যে
নর্ডিক বা ‘আর্য’ রক্তের গুণাবলী সঞ্চারিত হতে থাকলো। এই ভাবে তৈরি হলো প্রাচীন উত্তর
ভারতীয় (ANI) এবং এরকম অভ্যূথানে কোণঠাসা প্রাচীন ভারতীয় জনজাতি দক্ষিণ দিকে কেন্দ্রীভূত
হয়ে তৈরি হলো প্রাচীন দক্ষিণ ভারতীয় (ASI)। এছাড়াও আরও দুটি নির্দিষ্ট প্রাচীন জনগোষ্ঠীও
অনেকটা কোণঠাসা বা অনেক ক্ষেত্রে নর্ডিক জীন মিশ্রিত অথবা বৈদিক সংস্কৃতির অংশ হতে
থাকল। তারা হলো প্রাচীন অস্ট্রো এশিয়াটিক (AAA) এবং প্রাচীন তিব্বতি বর্মী (ATB)ভাষা-জনগোষ্ঠী।
সিন্ধু সভ্যতার অবনমনের সময় থেকেই যদিও ভারতের জন গোষ্ঠীর একটা প্রধান ও বড়ো অংশ ক্রমশ
পশ্চিম থেকে দক্ষিণ ও পুব দিকে সরে আসছিল, আনুমানিক ১৬০০সাধারণ পূর্বাব্দের পর সেই
ধারা আরও ব্যাপক হলো। এই সময়েই লিপি হীন প্রত্ন সংস্কৃত ভাষা প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা
সংস্কৃতির থেকে লিখিত রূপ খুঁজে পেলো, তৈরি হতে থাকলো আরও বৈচিত্রময় পরবর্তী বেদগুলি,
সংহিতা, উপনিষদ, পুরাণ প্রভৃতি। সংস্কৃত ভাষায় মিশে যেতে তাকলো প্রাচীন ভারতীয় - প্রত্ন
দ্রাবিড় ও অন্যান্য ভাষার ব্যাকরণ, প্রকরণ ও শব্দাবলী। এই মিশ্রণ উভয় তরফ থেকেই হচ্ছিল।
যেহেতু সংস্কৃত ভারতের কোনও স্বাভাবিক প্রাকৃত বা দ্রাবিড়ীয় বা আরও মিশ্রিত কোনও জনজাতির
দীর্ঘকালীন স্বাভাবিক ভাষা সংস্কৃতি বিকাশের ধারায় গড়ে ওঠা ভাষা ছিল না, এর পেছনে ক্ষমতাশীল
নর্ডিক গোষ্ঠীর পুরোহিত সম্প্রদায় এবং তাদের দখলে চলে আসা তাদেরই সঙ্গে ক্ষমতার ভাগিদার
হয়ে বসা ভারতীয় মূলের গুরু এবং প্রভাবশালী পন্ডিতবেত্তারা, এরাই মিলিত ভাবে নির্মাণ
করলেন ধ্রপদী সংস্কৃত ভাষা। যার ভাষাশরীরে মিশে গেলো ভারতীয় প্রাণ, তৈরি হলো পৃথিবীর
এক প্রাচীণতম ধূপদী ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা।
৬০০-৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দের মধ্যে পাণিনী রচনা করলেন সংষ্কৃত ব্যাকরণ। ৫০০ সাধারণ পূর্বাব্দ নাগাদই 'কৃষ্ণ' দ্বৈপায়ন ব্যাস এবং তাঁর সহকর্মী অনুগামী শিষ্যকুল বিষয় অনুসারে বিভক্ত করে সংকলিত করলেন চতুর্বেদের লিখিত ' প্রামাণ্য' সংস্করণ, রচিত ও সংকলিত হল বেদান্ত উপনিষদ। এবং লিখিত হল এক আশ্চর্য মহাকাব্য- মহাভারত।যাকে পঞ্চম বেদ ও বলা হয়ে থাকে, এবং এই কাব্যের রচয়িতা বেদ সংকলক হিসেবে 'বেদ'ব্যাস উপাধিতে খ্যাত হলেন। ব্যাসদেব মহাকাব্যিক প্রতীকের ব্যবহারে শুরুতেই জানিয়ে দিলেন, "বেদব্যাস কহেন, শ্রীগণেশ লেখেন"। উল্লেখ্য যে গণেশকে অনার্য-মূল দেবতা হিসেবে মান্য করা হয়ে থাকে। এবং সেই রকম এক অনার্যর কাছ থেকে স্মৃতি-শ্রুতি ঋদ্ধ বৈদিক ঋষি লিপি লিখনের সাহায্য নিচ্ছেন।এর দু তিন শতক আগেই গ্রিস দেশেও প্রাচীন ধ্রুপদী গ্রিক ভাষায় ইলিয়াড ও ওডিসি মহাকাব্যগুলি নির্মিত হচ্ছিলো।
৬০০ সাধারণ পূর্বাব্দ নাগাদ মহাকবি বাল্মীকি
নির্মাণ করেছিলেন আরেক মহাকাব্য। যেখানে ভারতবর্ষেরই বিগত প্রায় হাজার বছর ধরে ঘটে
চলা ঘটাবলির অনুসঙ্গ। আর্যাবর্তের বা উত্তর ভারতের তুলনামূলক অনুন্নত গ্রাম্য জীবন
যাপনে অভ্যস্ত এক রাজ্যের সূর্য বংশীয় আর্য নৃপতি রাম, যিনি বিষ্ণুর অবতার, গৃহ বিবাদে
ঘর ছাড়া, মধ্যভারতের অস্ট্রো-এশিয়াটিক আদিবাসী অধ্যুষিত বনাঞ্চল পেরিয়ে দক্ষিণ ভারত
বিজয়ে যাবেন, যেন নিতান্তই ঘটনা চক্রে! দক্ষিণ ভারত যেন সিন্ধু সভ্যতার সেই সব মৃতপ্রায়
বিরাট নগরের চাইতেও ব্যাপক, কাল্পনিক সোনার লঙ্কা নগরী। রামের বিবাহিত স্ত্রীটিও ভারতের
মাটি থেকে পাওয়া। তাই তার নাম সীতা। গল্পের এক অংশে তিনিই হয়ে যাবেন অগ্নিস্নাতা জ্বলন্ত
ঝলসানো সতী। মানুষরুপী সুরলোকের দেবতারা সব
যেন মর্তে আগত। অনার্য অসুর নিধনের খেলা জমে ওঠে গল্পে গল্পে। বালিকে আড়াল থেকে রামবাণ
ছোড়া হয়। আদিবাসী ভাইয়ে-ভাইয়ে খুনোখুনি। এক
দিন অরণ্য পথে 'কুৎসিত' সুর্পণখার নাক, কান
কেটে দিয়ে উচিত শিক্ষা দেন রামানুজ। তারপর রাবনের প্রতিশোধ, সীতাহরণ। বিদ্বানকে সে
যুগে 'ব্রাহ্মণ' হিসেবে মানা হত। তাই ‘অসুর-রাক্ষস’ কুল-জাত হলেও কেউ বিদ্যাবলে ব্রাহ্মণ
হতে পারে। তো এমনই এক ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ রাবনকে তার স্পর্ধার সীমা বোঝাতে গড়ে ওঠে 'বানর'
সেনা। অরণ্যের আদিবাসী সমাজ থেকেই এই সৈন্যবাহিনী
তৈরি হলো। তবু তার নাম হয় বা-নর সেনা। ‘হন্যমান’ হয়ে ওঠেন পবন পুত্র রাম ভক্ত ‘হনুমান’।
যিনি এক উল্লম্ফনে পার হয়ে যেতে পারেন সাগর, পাহাড়, ধরিত্রী। উপড়ে নিয়ে আসতে পারেন
জঙ্গল উজাড় করে ভেষজ পর্বত। তিনি ল্যাজে আগুন নিয়ে সোনার লঙ্কা হেলায় পুড়িয়ে ফেলতে
পারেন। সেই যুগের সার্জিকাল স্ট্রাইক, লুঠ, অগ্নি সংযোগ, নগর ধ্বংস, ক্ষমতা দখল- এইভাবেই
যেন নির্মিত হচ্ছিল ভারতের তাম্র-ব্রোঞ্জ যুগ থেকে লৌহ যুগে রূপান্তরের অন্ধকারময় নীরবতার
মহাকাব্যিক অধ্যায়।
এই রামায়ণেরই পঙ্ক্তিতে ত্রিকাল দর্শী কবি,
মিথুনরত ক্ৰৌঞ্চ ক্ৰৌনচির শরবিদ্ধ রক্তাক্ত মৃত্যুস্বর শুনে ব্যথায় বেদনার গাঢ় রসে
আপ্লুত হয়ে বলে উঠেছিলেন: মা নিষাদ! সেই থেকেই ক্রমে গড়ে ওঠে আখ্যায়িত হয় সেই মহাকাব্যিক
বিয়োগ গাথা। যা কিনা বাল্মীকি শোনাবেন মাতৃহারা দুই সহোদর ভাই লব এবং কুশকে। যারা তাঁরই
কুটিরে শিক্ষালয়ে আবাসিক হিসেবে আশ্রিত। যারা সাম্রাজ্য বিস্তারক শ্রীরামের অশ্বমেধের
ঘোড়া থামিয়ে দিয়ে ‘মর্যাদা পুরুষোত্তম’ রাজা রামকে খোলা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেবে, আর তার
পর শ্রীরামের রাজ্ সভায় গিয়ে, সর্বসমক্ষে, গানে গানে, কবিতায় কবিতায়, শুনিয়ে যাবে তাঁরই
‘মহান’ সব কীর্তিকাহিনী আর তাদের নিজেদের আর তাদের মায়ের হতভাগ্যের শ্বাসরোধী সব কথকতা।
কাহিনীর যেখানে সূত্রপাত, সেই নিষাদেই আমাদের
আজকের এই কাহিনীর ইতি হবে। ‘নিষাদ’ মানে ‘ব্যাধ’। প্রত্ন ভারতের এক আদিম জনজাতি। যাদের
কিরাত নামেও ডাকা হয়। সেই নিষাদ ছিলেন এই বেদনাদায়ক মহা-ঘটনার এক সামান্য ক্রীড়ানক।
যার কাজ শুধুই অনুঘটকের মতো, গল্পে এর চাইতে বেশি তার কোনও কাজ নেই। তাৎপর্য পূর্ন
ভাবে কুক্কুটের আরেকটি এক অর্থ হলো ‘নিষাদ পুত্র’, বা ‘শূদ্র’!
‘কুক্কুটারমা’র অর্থ ‘মোরগ লড়াইয়ের বা মোরগ
প্রতিপালনের নগরী’। কোনও এক দুর্জ্ঞেয় কারণে সেই প্রাচীন শহর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর তার
নাম হয় ‘কুক্কুটারমাটা’, ‘ধ্বংস হয়ে যাওয়া মোরগ লড়াইয়ের বা মোরগ প্রতিপালনের নগরী’।
প্রাচীন ভারত ও প্রাচীন চীন দেশেই নাকি প্রথম
মুরগি প্রতিপালন শুরু হয়েছিল!
সেই নামেই করা যেন নাম রেখেছিলো মহেঞ্জোদারোর।
“তরঙ্গিল সারা বিশ্বে হে কুক্কুট, তোমার মাভৈ।“
তথ্যসূত্র:
- সেন মজুমদার, জহর, 'মেজাজ ও মনোবীজ- আধুনিক বাংলা কবিতা'
- Mahadevan, Iravatham, "'Address’ Signs of the Indus Script" (PDF). Presented at the World Classical Tamil Conference 2010. 23–27 June 2010. The Hindu.
- Romila Thapar, "The Theory of Aryan Race and India: History and Politics"
- ভট্টাচার্য্য, সুকুমারী, ‘প্রবন্ধ সংকলন’
- Joseph, Tony, ‘Early Indians: The Story of Our Ancestors and Where We Came’, 2018.
- Harari, Yuval Noah, 'Sapiens: A Brief History of Humankind', 2011.
- Nehru, J.L., ‘The Discovery of India’, 1946.
- মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফেসবুক গ্রূপ ‘ইতিহাস, তথ্য ও তর্ক’-এ প্রকাশিত পোস্টসমূহ, বিষয়: 'মাইগ্রেশন'
- উইকিপিডিয়া
- এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন