রবি ঠাকুরের মংপু হয়ে সিটং-লাটপাঞ্চারে
'ঘন ছায়াছন্ন পথ দিয়ে মেঘ কুয়াশার রাজ্য ছাড়িয়ে মংপুতে যখন নামলাম তখন রোদ চারদিকের ধোয়া সবুজের উপর ঝিলমিল করছে, শেষ বেলাকার রোদের সুন্দর শান্ত হাসি।' 'মংপুতে রবীন্দ্রনাথ' বইটিতে মৈত্রেয়ী দেবী এভাবেই মংপুর বর্ণনা দিয়েছিলেন। আজও যেন পাল্টায় নি সেই মংপু।
শিলিগুড়ি থেকে সেভক হয়ে ৫১ কিলোমিটার দূরের ৩৭০০ ফিট উচ্চতার মংপুতে পৌঁছে সেকথাই সবার আগে মনে হল। রাম্ভি থেকে শেষ ১১ কিলোমিটার পথ ভীষণ খাড়াই ও সর্পিল এবং হিমালয়ের নিস্তব্ধতার সঙ্গে মানানসই রকম নির্জন। শীতকালে এই পথের দু`ধার হলুদ কমলালেবুতে ছেয়ে যায়। সে দৃশ্য এই শরতে দেখা না গেলেও, সিঙ্কোনা গাছের নির্জন জঙ্গল দেখাটা কিন্তু একেবারে অন্য অভিজ্ঞতা। সেভক থেকে রাম্ভি অবধি তিস্তা পাশে পাশে চলে আর রাম্ভি থেকে এই পাকদন্ডী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে আমলে গেলখোলা পর্যন্ত আসতেন টয়ট্রেনে আর সেখান থেকে রাম্ভি অবধি বাকি চার কিলোমিটার পথ গাড়িতে। রাম্ভি থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হত পালকিতে।
১৯৩৮ সালে মংপুর কুইনানিন ফ্যাক্টরিতে কর্মরত ছিলেন মনমোহন সেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের কন্যা মৈত্রেয়ী দেবী। তাঁদের আহ্বানে ওই বছর ২১শে মে গুরুদেবের পদার্পণ হয় ছোট্ট এই জনপদে। এই পাহাড়ি শহরটির অসাধারণ নৈসর্গিক দৃশ্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। প্রথমবার রবীন্দ্রনাথ ৯ই জুন অবধি কাটিয়েছিলেন মংপুতে। ১৯৩৯ সালে তিনি দু'বার আসেন মংপুতে। প্রথম দফায় পুরী থেকে ১৪ই মে এসে ১৭ জুন কলকাতায় ফেরেন। আবার ১২ই সেপ্টেম্বর এসে দু`মাস কাটিয়ে যান মংপুতে। শেষ এসেছিলেন পরের বছর ১৯৪০ সালের ২১ শে এপ্রিল। ২৫ শে বৈশাখের অনুষ্ঠান পালন করে চলে যান কালিম্পঙে। সে বছরই সেপ্টেম্বরে আসতে চেয়েছিলেন, তিনি কিন্তু অসুস্থ শরীর নিয়ে প্রথমে কালিম্পঙে এলেও, মংপুতে আর আসতে পারেন নি। কিন্তু মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন আসবার জন্য। তাই হয়তো আসবার আগে পাঠিয়েছিলেন নিজের ওষুধের কৌটো। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি নিরুপায় হয়ে কলকাতায় ফিরে যান।
রবীন্দ্রস্মৃতি ধন্য মংপুর ভবনে আজও রক্ষিত সেই কৌটোগুলি। শুধু ওষুধের কৌটোই নয়, ষোলোটি ঘরের এই বিরাট ভবনটিতে রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যবহৃত খাট, তোশক, বিছানা। তাঁর নিজের নকশায় তৈরী চেয়ারটিও যত্নে রাখা। চেয়ারের ওপর রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত কুশনটিও। রক্ষিত কবি ব্যবহৃত রঙের বাক্স। প্রতিটি ঘরেই রাখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অসংখ্য নিদর্শন, ব্যবহৃত সামগ্রী। রয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্য আনা এক আনা দামের ন্যাশনাল হেরাল্ডের একটি কপিও। বেশ কিছু দামি ফোটোগ্রাফও রয়েছে, তবে অযত্নে সেগুলির দশা অত্যন্ত সঙ্গীন।
১৯৪৪ সালের ২৮ শে মে এই বাড়িটিকে রবীন্দ্রস্মৃতিভবন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আজ এই বাড়িটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। দেখে নেওয়া যায় স্মৃতিভবনের সবকিছুই, এমনকি ইট ও বালি দিয়ে বানানো বাথটবটিও। কুইনাইন ফ্যাক্টরির প্রবেশদ্বারের ঠিক উল্টোদিকে রবীন্দ্রভবনে ঢুকবার রাস্তা। ঢুকেই বাগান। বাগানে রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি। বারান্দায় সাদা চাদরে ঢাকা চেয়ার, চেয়ারে রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি। প্রতিকৃতির পেছনে মৈত্রেয়ী দেবী-কৃত রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত তাম্রলিপি যাতে বাংলা, হিন্দি আর নেপালি ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে।রবীন্দ্রস্মৃতিভবনের বর্তমান কেয়ারটেকার শিশির রাউত উদাত্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গাইতে গাইড করেন পর্যটকদের। তাঁর ঠাকুরদা ভীমলাল রাউত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পাল্কিবাহকদের সর্দার।
মংপুর অদূরে পেশক রোডের ওপর সার্নেল বাংলো একসময়ে অন্যতম পর্যটক আকর্ষণ কেন্দ্র হলেও, বর্তমানে তা ভগ্নস্তূপে পরিণত। মংপুর ডাইছেন শেরপা চোয়েলিং মনাস্ট্রি বা পিস্ প্যাগোডাটিও অনবদ্য। সার্নেল বাংলো থেকে স্থানীয় গাইডের সাহায্যে হিমালয়ের গহন অরণ্যের ভেতর দিয়ে হাঁটা পথে যাওয়া যায় ছটকপুর অবধি। অসামান্য প্রাকৃতিক দৃশ্যের এরকম জায়গা পূর্ব হিমালয়ের এই অঞ্চলে আর দ্বিতীয়টি মেলে না। মংপুর কাছের সিকসিম গ্রামটিও অনবদ্য। প্রকৃতির নিবিড় পাঠে সিকসিম অতুলনীয়। অন্যদিকে মংপু থেকে যাওয়া যেতে পারে ৬কিমি দূরের রিয়াং নদীর কাছে যোগীঘাটেও। বাবা রামদেবের জন্য আজ এই স্থানটি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
আজকের পর্যটন মানচিত্রের পরিচিত নাম সিটং, মংপু থেকে মাত্র সাত কিমি দূরে। চিৎকার-চেঁচামেচি-মাথাব্যথার শহরবাসীর কাছে সিটং এক লোভনীয় মনোরম গন্তব্য। সিটং-এর খুব কাছেই রয়েছে শেলফু ও লাটপাঞ্চারের মতো জনপ্রিয় আরও দুটি জায়গা। ট্রেক করবার জন্য এখানে বেশ কিছু পথ রয়েছে। এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ উচ্চতায় পৌঁছে গেলে ডুয়ার্স, তরাই-সহ দার্জিনিঙের অপূর্ব প্যানারোমা শিহরিত করে তোলে। রয়েছে মামরিং হয়ে বাগোরা অথবা মাজুয়া-মহলদিরাম হয়ে কার্শিয়াং পর্যন্ত ট্রেক করবার পথটিও। সব পথেই উপরি পাওনা কাঞ্চনজঙ্ঘার তুষার-ধবল ঔদ্ধত্য। পাখির ডাক, আপার সিটং মনাস্ট্রি, চার্চ সব মিলে, সিটং আর লাটপাঞ্চার অফ বিট লোকেশন হিসেবে আজ কড়া টক্কর দিচ্ছে দার্জিলিং, কালিম্পঙের মতো শৈল শহরকে। সিটং পৌঁছনো যায় রাম্ভির আগেই কালিঝোরা বা বিরিক দারা থেকে আহালদারা হয়ে, অথবা রাম্ভি-মংপু হয়ে। থাকবার জন্য রয়েছে বেশ কিছু হোম স্টে থেকে শুরু করে সরকারি ব্যবস্থার লজও।
ছবি- লেখক
ছবি পরিচিতি
১/ ট্রেকিং পথে একটি প্রাকৃতিক দৃশ্য
২/ মংপুর রবীন্দ্র ভবন
৩/ গভর্নমেন্ট কুইনাইন ফ্যাক্টরি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন