ফাটা-জীবনের কোলাজ
শহরের অভিজাত এক অডিটোরিয়াম। পূর্ণকক্ষ শ্রোতার সম্মুখে মঞ্চে উপবিষ্ঠ অভিজাত পোষাকে সজ্জিত উজ্জ্বল ও চকচকে চামড়ার পূর্ণদৈর্ঘের এক লেখক। বয়স ত্রিশের মধ্যে। মঞ্চের নাটকীয় আলোর বৃত্তে মাইক্রোফোনের সামনে বসে, খুলে রাখা তার সদ্য প্রকাশিত বই থেকে রোম্যান্টিক গলায় পাঠ করে যাচ্ছেন একটানা। ডিজিট্যাল সাউণ্ডে অডিটোরিয়াম জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে তার উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ অক্ষর ধ্বনিসমূহ--
"ফুল তো ফাটালাম। নিষ্ঠুর হাতে টেনে ছিঁড়ে সবকটা পাঁপড়ি খুলে ফেলবার উল্লাসই আলাদা। উদ্দেশ্য একটাই, মধু খাবো। চুষে, চেটে, চিবিয়ে, যেভাবে পারি ছিন্ন করবো এই কোমল কুঁড়িমুখ। পদ্ম বা ব্রহ্মকমল যাই হোক। দলনের ছাপ রেখে দেবো ফুল বোঁটা পরাগের কোষ কোষান্তরেরও নিভৃত ও গূঢ় অন্তরালে। ভয় অনুরাগ রাগ ঘৃণা-- রমণের,মন্থনের যাবতীয় অনুক্রমণে অ-বারণ আনুগত্যই প্রথম জরুরী। ফুল ফাটালেও ঝরেনা সে ফুল। দলিত হলেও বোঁটায় লগ্ন থাকে প্রকাশ। নির্ধারিত সময়ের আগে নেভে না দীপালোক। বাধ্যতই নায়কের মতো হেঁটে চলে সে নবতম পুষ্প আয়োজনে। গণিতের নিষ্ঠ কারিগর, প্রহর লগ্ন সব গিঁথে গিঁথে রেখে, চেনাবে পঙ্কিল পথ কাঁচকালো হ্রদের সমীপে। কোরকে বিদ্ধ যে মধুসংহার, পদ্ম বা ব্রহ্মকমল যাই হোক, পুনর্বার মধুসংযোগ হেতু ফেরাবে উদ্যানে। অনুনয় ভিক্ষা হয়ে অনুগতা, কটাক্ষ ঝলসে ওঠা পাঁপড়ীর উৎকণ্ঠাই প্রাকৃত ব্যকরণ। আমোদ কামোদগাঢ় পেষীত রণন। বাকী যা কিছু, পাললিক স্তর থেকে তুলে আনা-- এখনও জানাই হয়নি ফুলের এ প্রস্ফূটনে ফাটানোর প্রাকৃত নিয়্ম। আধিদৈবিক, আধিভৌতিক নিয়ন্ত্রণ কোনও জাবেদা খাতায় বহুপূর্বে লিপিবদ্ধ রয়ে গেছে কিনা, কোথাও দূরে! আপাতত অরিন্দম এ ফুল ফাটালো। আপাতত অরিন্দম তারই হাতে প্রোথিত যে ধ্বজা, এক্ষেত্রে খোদাই হলো কালের নিহীত সব অক্ষরে, বাকলে। আপাতত মৃত্তিকার গোচরীভূত এই ফুলক্ষেত্রে অরিন্দম নবাব, বাদশা, আপাতত!"
এই রকম একটা গা গরম করা পাঠের শেষে লেখক থামলেন। জল খেতে হবে। আমরাও ততোধিক পিপাসী ফাটানেওয়ালা। দেয়ালা যাই হোক, প্রসঙ্গ যখন ভূমিকাতেই ফুল ফাটিয়ে তার যাত্রা শুরু করলো, তখন উঠে যাওয়াও আর সম্ভব নয়। বোঝাই গেলো এরপর আরও নানারকম ফাটানো ফুটোনোর কাহানী এটা। কাজেই গেঁড়ে বসে শাহাজাদা অরিন্দমের পরবর্তী কার্যক্রমে দম তুলে রাখলাম। সরেস লেখক একেবারে আঁঠার গোডাউন নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হইয়েছেন। চল বাঁকু, এই তালে দুটো বিচি ফাটানোর ব্যবস্থা করি। বাঁকু তো অবাক! বাঁকু মানে বাপ দেয়া নাম বাঁকাশ্যাম, আমাদের কাছে বাঁকু। হেব্বী গরম। শহরের কোথায় কোথায় কোন কোন দোকানে ভালো নীলছবির স্টক আছে সব জানতো। যখনই তাকে পাওয়া যাছে না বলে আমরা একটু হৈ হল্লা করি, বাঁকু কিছু পরেই ফিরে এসে বলবে, আজ যা একটা মাল পেয়েছি না! আমাদের মধ্যে কেউ কাঠি করবার জন্য ওকে খোঁচায়, এই বাঞ্চোৎ, তোকে কি ওরা সিডি দেখিয়ে ভাড়া দিয়েছে? বাঁকু সটান উত্তর দিত, দেখাবে কেনো, ব্যবসার একটা ফর্মুলা আছে না, পাব্লিকের বিশ্বাস অর্জন করতে হয়। ওরাও তাই যা বলে, একেবারে সঠিক কথা বলে। কে একজন দূর থেকে ফুট কাটলো, তোর কপালে অশেষ দুর্ভোগ আছে। বাঁকু খেঁকিয়ে বলে ওঠে, এইই ম্যালা ফ্যাঁচাবি না। বহুৎ শুনেছি। আমি কি তোর বোনকে ডেকে নিয়ে এসে দেখাতে গিয়েছি?
তো সেই বাঁকুই আজ আমার সঙ্গে। হিল্লি দিল্লি সম্প্রতি লণ্ডন আমেরিকা ফেরা অনেক বড় এক বাঙালি লেখকের সাম্প্রতিক উপন্যাস পাঠের এই সান্ধ্য অনুষ্ঠানের আয়োজক এক মাল্টিন্যাশনাল প্রকাশনা সংস্থা। উদ্দেশ্য কিছু সেন্টুফেন্টু তুলে ওই ৩০০০ টাকা দামের বই যে কটা হোক বেচে দেয়া। এসেছেও শহরের সব খোদাই করা লোক। মহিলাদের উপস্থিতি দেখেই তো বাঁকু চেয়ারে বেঁকে বসে আছে, একেবারে টঙ অবস্থান। বিষয়টা একটু বিশদে বলি। আপনারা সবাই ভাবছেন আমরা এখানে আসবার আমন্ত্রণ পেলাম কিভাবে! এই পেলাম কিভাবেটাই একটা গল্প, যেটা লিখে পরে আমি বিনে পয়সায় বিতরণ করবো এবং যতই সে গল্প গল্পশিল্প হিসেবে উন্নতই হোক না কেন, এ ঘরে উপস্থিত কোনও দর্শকই থুড়ি পাঠকই সেটা পড়বে না। কারণ, পড়ার চাইতেও বড় ব্যাপার কত বেশি দাম দিয়ে একটা বই তারা কিনছে, যে বই এ শহরের বেশির ভাগ গরিব-গুব্বো পাঠকেরা কিনতে তো পারবেই না, কেনার চেষ্টাও করতে পারবে না। ক্রেতা হিসেবে এই মৌতাতটাই আসল জরুরী।... যাই হোক, এর বাইরেও বিপুল সংখ্যায় যেসব পাঠকেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন, তারাই প্রতিদিন পরিপুষ্ট করেন বাংলা সাহিত্যের এই বিস্তৃত আকাশটাকে, তাদের জন্যই আমাকে লিখতে হবে।
আপাতত বিচী ফাটানোর রিস্কটা কে নেবে, মানে কার ঘাড় মটকে সেটা করা যায়, মাথায় সেটাই ঘুরছে। হঠাতই মধুমিতা এই রঙ্গা-বিল্লার সামনে এসে হাজির, হাতে ঠোঙা। দেখেই তো চমকে উঠলাম, আমরা যে বিচী ফাটাতে চাইছি সেটা মধুমিতা কি করে জানলো! যাই হোক কাছে এসেই প্রথম ডায়ালগ, কিরে, চিনতে পারছিস না, অমন গোলগোল চোখ কোরে তাকিয়ে আছিস?... নে, বাদাম ফাটা।
এবার চটকা ভেঙ্গে গেলো। মধুমিতাকে চিনতে পারবো না, তাই কি হয়! ওর পাছার মাপে আমি ফিদা। ঠকাস কোরে আমাকে চান্স না দিয়েই বাঁকু বলে উঠলো, তুমি এখানে কি মারাতে ঘুরছো! ক্লায়েন্ট ফাসিয়েছো নাকি! কথাটা শুনেই মধুমিতার মুখটা রাগে ও লজ্জায় লাল হয়ে উঠছে বুঝতে পারলাম। এটাও বুঝলাম এর পরের শটেই বাঁকুর গালে এক ৮০ পাউণ্ডের চড় নামবে। কেসটা হাল্কা করতেই, তাড়াতাড়ি প্রায় চিৎকার কোরে উঠলাম, হাই, মিতা, তুমি মাইরি থট-রিডার নাকি! কার ঘাড় ভেঙ্গে বাদাম খাওয়া যায়, মানে বিচী ফাটানো যায়, সেই হিসেবই তো এখানে দাঁড়িয়ে কোরে যাচ্ছি! মধুমিতা একটু ঠাণ্ডা হলেও বাঁকুর অপমানজনক কথাগুলোর ঝাঁঝ তাকে ইরিটেট করছে বোঝাই গেলো। আমার দিকে সরাসরি চোখ রেখে বললো, এই ছেলেটা যেন আমার সঙ্গে আর কখনও কথা বলতে চেষ্টা না করে। তবে কিন্তু আমিও কখনও আর তোকে চিনবনা। তোকে পুরো ঠাণ্ডা দিয়ে দেবো। বাঁকুর দিকে চোখ টিপে বললাম, এই তুই মিতার পা জড়িয়ে বল আর কখনও এমন অপমানজনক কথা ওকে বলবি না। কথাটা আমার বলতে যেটুকু দেরী, বাঁকু ঝাঁপিয়ে পড়ে হাঁটু গেড়ে বসে মধুমিতার দুটো উড়ু তীব্র দুহাতে জড়িয়ে ধরে, পারলে মিতার কাপড়চোপড় ভেদ কোরে তার যোনীর মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দেবে। বিব্রত মধুমিতা কো্নক্রমে নিজেকে মুক্ত করতে আস্তে কিন্তু তীব্রভাবে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, ঠিক আছে ছাড়, ছাড়, আমি আর কিছু মনে করছি না। কিন্তু বাঁকুর একটাই আবেদন, আগে বলো তুমি আমাকে ক্ষমা কোরে দিলে!... জনান্তিকে বলি, বাঁকু মধুমিতার এই বিপর্যস্ত উত্তাপটুকু থেকে নিজেকে খুলে নিতে চাইছে না। যাই হোক, অবশেষে মধুমিতা বাঁকুর ফর্দমাফিক বলতে বাধ্য হলো, যা, তোকে আমি ক্ষমা কোরে দিলাম। ব্যাস, বাঁকুও ধীরেসুস্থে মধুমিতার নিম্ন শরীরে যতটা পারে হাতফাত ঘষে উঠে পরেই সোজা টয়লেটের দিকে চলে গেলো। মধুমিতাও এই ফাঁকে শাড়িটাড়ি একটু গোছগাছ কোরে নিতে নিতেই আলতো কোরে বললো, সাগরেদটাকে যা বানিয়েছিস না, কবে যে ওর জন্যে তোকে মারধোর খেতে হবে কে জানে! কথাটা বলেই আমার হাতে সেই বাদামের প্যাকেটটা ধরিয়ে দিয়ে বললো, দাঁড়া, আমিও একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি। আমি এক বোকা খরগোশ, এই ফাঁকে পটাপট বিচি ফাটাচ্ছি আর মুখে ছুঁড়ছি। মধুমিতার বিপুল হিপ আমার সামনে দিয়েই দুলতে দুলতে মহিলা টয়লেটে ঢুকে গেলো আর বুঝলাম আমারও ফাটানোর বেগটা বেড়েই চলেছে। এর মধ্যেই বাঁকু ফিরে এসে আমার হাত থেকে বাদামের প্যাকেটটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়েই সোজা হলের মধ্যে ঢুকে গেলো। ভাবটা যেন ময়দান ছেড়ে দিয়ে গেলাম, তুই যা করবার কর। মধুমিতা না ফিরলে আমার যাওয়াটাও যেহেতু অসৌজন্য হয়ে যাবে, বাধ্যতই তার ওয়াশের অপেক্ষায় আমায় দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। সে এলো, আমার হাতে বাদাম নেই দেখে বললো, কিরে প্যাকেটটা কোথায় ফেললি? আমি বললাম, বাঁকু খিঁচে নিয়ে হলে ঢুকে গেছে। মধুমিতা আমার দিকে কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থেকে বললো, আমার সাথে যাবি? বললাম, কোথায়? সে বললো, আমিও জানিনা, যে কোনদিকে, যে কোনখানে, আসলে তোর সাথে আমার আজ খুব ঘুরতে ইচ্ছে করছে, ইচ্ছে করছে তোর সাথে আজ খাবলে প্রেম করি।
গোপনে বলে রাখি, মধুমিতা কবি এবং সরকারি আপিসের কেরানি। কাজেই আবেগের সাথে তাল দেয়ার মতো ন্যূনতম পয়সাটুকু ওর আছে। আমার ওই হাবিজাবি ফুলটুল ফাটানোর কাহানী শোনবার আদৌ কোনও ইচ্ছে নেই, এখানে এসেছিলাম এইসব লেখকদের শ্রোতা ওরফে ক্রেতাদের সম্পর্কে একটা ধারণা নিতে। সে ধারণা পেয়ে গেছি। বাঁকুকে শুধু ফোনে বললাম, আমাকে একটু বাড়ী যেতে হচ্ছে,
তুই থাক, তোর কাছে সব শুনে নেব। কথাটা বলেই, একমুহূর্তও দেরী না কোরে মধুমিতার হাত ধরে ঝেরে টান দিয়ে প্রায় দৌড়েই লিফটে ঢুকে নেমে এসেই রাস্তা এবং একটা ট্যাক্সি থামিয়ে চেপে বসলাম দুজন। ট্যাক্সি চলতে শুরু করলে মিতাকে বললাম, এবার বল কোথায় যাবি! উল্লেখযোগ্য ভাবে লক্ষ্য করলাম এই দু-পা ছুটেই মিতা খুব ব্যতিক্রমীভাবে হাঁফাচ্ছে। খুব। ভাবলাম হয়তো ওর কোনও গোপনে টেনশন হচ্ছে আমার সাথে হারানোর এডভেঞারে সামিল হতে! তবে এরকম বাওয়ালি তো আগেও হয়েছে, তবে সেক্ষেত্রে কারও বাড়ি বা কোনও প্রোগ্রামে যাবার জন্য ছুটেছি। আজ ছুটছি হারানোর জন্য, যেন 'যা হবার হোক'। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিতা তার স্বাভাবিকতায় ফেরে। ফিরেই বেশ ক্কিছুটা চুপ থেকে আমার দিকে কেমন অভিব্যক্তিহীন তাকালো, তাকিয়েই থাকলো কিছুক্ষণ। কী ক্লান্ত যে দেখাচ্ছিলো সেই চোখ! আর আমি আপ্রাণ শুধু মিতাকে কিছুটা বুঝতে চাইছি, কিছুটা। এতদিনের যে মিতাকে আমি চিনতাম, কিছুক্ষণ আগেও যাকে জানতাম বলেই হাত ধরে টেনে এই শহরের বুকে ট্যাক্সিতে গন্তব্যহীন ভাসছি, দুজনার কেউই জানি না কোথায় যাচ্ছি আমরা-- আমার জানা সেই মিতা যেন এটা নয়। কেমন সাফোকেটেড লাগছে। হঠাৎই মিতা কেমন গভীর কোনও ঘুম থেকে আকস্মিক জেগে উঠলো যেন। চীৎকার কোরে ট্যাক্সীয়ালাকে থামতে বলে আমার হাত তীব্রভাবে খামচে ধরে বললো, আমাকে বিয়ে করবি? আজ। এক্ষুণই। রেজিস্ট্রারের কাছে তবে এই ট্যাক্সিতেই চলে যাব। বল। কুইক।
আমি কেমন হতভম্বের মত মেয়েটাকে যেন কিছুতেই আজ মিস করতে চাইছি না। পৃথিবীতে যেখানে যা কিছু হোক, এই বাঞ্চোৎ আমায় আজ ফিদা করে দিয়েছে। অসহায়ের মত বেশিকিছু না ভেবেই কেমন যন্ত্রের মত বলে উঠলাম--
-- বাঁকুর সাথে একবার কথা বলবো না? ওর মতামতটা একবার...
-- বোকাচোদা, বিয়েটা তোকে আমি করতে চাইছি, কোনও বাঁকু, কাকু এখানে আসছে কোথা থেকে? বেশি ঘ্যামাস না, রাস্তার পাশে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে, যে কোনও সময় সার্জেন্ট এসে পার্সের গাঁড় মারিয়ে দেবে। হ্যাঁ কি না?
-- রাজি।-- কথাটা বলেই স্থান-কাল-পাত্রের বোধহীন মিতাকে ঠেসে ধরে আগুনের মত চুমু খেয়ে ফেললাম। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে আমাকে ঠাসিয়ে সিটে বসিয়ে, মিতা ট্যাক্সিয়ালাকে বললো, এই ট্যাক্সি, ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিসে চলো। ট্যাক্সিয়ালা বিহারী হলেও, পুরো বাংলা জানে। সে বললো, সে আপিসটা কোথায় বলবেন তো? মিতা কেমন খচে গিয়ে বললো--
-- ধুর বাল, এতদিন কলকাতায় আছো আর বিয়ে করানোর অফিস চেনো না?-- বলেই মোবাইল টিপে কাকে যেন ফোন করলো, বোধহয় আফিসের কোনও বন্ধু বান্ধবী। তারপর ফোন বন্ধ কোরে অল্প কিছুক্ষণ নিশ্চুপ বসে থাকতেই হোয়াটসআপের বাঁশি বেজে উঠলো। সেটা দেখে ট্যাক্সিয়ালাকে জানিয়ে দিলো কোথায় যেতে হবে। ব্যাস, ট্যাক্সিয়ালা ফুর্তিতে গাড়ি ছুটিয়ে সোনাগাছির কাছাকাছি কোন এক গলির মুখে ট্যাক্সি থামিয়ে আমাদের নেমে যেতে বললো। মিতা বিল মিটিয়ে গলিতে ঢুকে বিয়ে করানো এক বুড়ো রেজিস্ট্রারকে নিজেদের প্রয়োজন বলতেই, ভদ্রলোক দায়িত্ব নিয়ে সব কিছু করে দিলেন। এমনকি চাহিদামাফিক টাকাটা ফোনের মাধ্যমে তাকে ঢুকিয়ে দিতেই, মহাখুশিতে ঝকঝকে এক পাত্রে রাখা সিঁদুর নিয়ে আমার সামনে রেখে বললেন, যদি মনে করেন, ব্যবহার করতে পারেন। মিতা বললো, ফাটা, আমার সিঁথিতে ফাটিয়ে একখাবলা সিঁদুর মেরে দে।
জন্মকালীন সংস্কারের মুরগী, কোন কথা আর না ভেবে দু আঙুলে সিঁদুর তুলে দিলাম মিতার সিঁথী ফাটিয়ে লাল কোরে। কপালেও মেরে দিলাম এক লাল টিপ। বিয়েদাদুকে নমস্কার জানিয়ে লাফিয়ে উঠেই ওর হাত ধরে ঝেরে এক টান মেরে বললাম, আজ থেকে তুই আমার বউ। বাঁকু আজেবাজে কিছু বললে ওর বিলা আমি বদলে দেবো। কথা বলতে বলতেই আমরা গলির মোড়ে এসে দাঁড়ালাম। মিতা বললো, এ এলাকাতেই অনেক সস্তার হোটেল আছে। একরাত আমরা এখানে থেকেই আমাদের বাসর রাত্রি কাটিয়ে নিতে পারি। বললাম, যা করবি তাড়াতাড়ি কর।-- আমার তখন একটা ঘর দরকার কারণ মিতা আমার মাথা লুঠ করেছে। ওর ভেতরে না ঢুকতে পারলে থামতে পারছি না।
হোটেলের ঘরে বসে মদ এবং খাবার খেয়ে অভিভাবকহীন এক নবদম্পতি স্বাধীনতা ও বন্যতায় যেভাবে রাত্রি কাটাতে পারে ভাবা যায়, আমরা সেভাবেই কাটালাম। ব্যতিক্রমীভাবে মাঝেমাঝেই মিতা এক আদিম যন্ত্রণায় কেমন কুঁকড়ে উঠেছে, আমার কাছে সেটা ছিলো যন্ত্রণাবিদ্ধ করার পৌরুষের জয়। অবশেষে ভোর হয়। স্নানফান সেরে মিতা সোজা অফিসে যাবে। আমি বাড়িতে ফিরবো। দুজন ছাড়াছাড়ি হবার আগে মিতা বলে, আজ দুপুরটা আর বাড়ি থেকে বেরোস না, কারণ, আমার অফিস থেকে দুয়েকজন লোক এসে তোকে দিয়ে কিছু কাগজ সইটই করিয়ে নিয়ে যাবে। এটা অফিসিয়াল অবলিগেশন। অর্থাৎ আমি যদি হঠাৎ মারাটারা যাই, আমার টাকাপয়সা যেন চোট না যায়। স্বামী হিসেবে তোর হাতেই আসবে সেগুলো। বাড়ি থাকিস।
পরদিন সকালে বাঁকু এসছিলো। ওকে আমাদের বিয়ের কথাটা বলিনি। নানারকম কথার পর বাঁকু চলে গেছে। প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ একজন ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা মিতার অফিসের কলিগ পরিচয় দিয়ে কিছু কাগজপত্র সই করিয়ে নিয়ে গেলেন। যাবার আগে বলে গেলো অফিসের খুব আর্জেন্ট কোনও কাজে আজকেই তাকে চেন্নাই চলে যেতে হয়েছে, অফিসের আরও দু-তিনজন তার সাথে গেছে। সে নাকি বলে গেছে, ঝামেলাটামেলা মিটে গেলে ফোনে তার সাথে যোগাযোগ করবে। এখন মিতাকে আর ফোনে পাওয়া যাবে না।
ভদ্রলোকেরা চলে যেতেই আমার সেই প্রায় গতজন্মের লজঝড়ে মোবাইলটা, তখন নাম ছিলো মুঠোফোন, এখন সব এন্ড্রয়েড, খামচে নিয়ে সত্য যাচাইয়ের ধান্দায় খুঁজেপেতে আমার মধুমিতা বউয়ের নাম্বারটা টিপে দিলাম। প্রায় তৎক্ষণাৎ যান্ত্রিক উত্তর এলো "দ্য নাম্বার ডাজ নট একজিস্ট"। একবার, দুবার, পাঁচবার-- একই উত্তর। মোবাইল ছুঁড়ে ফেললাম বিছানায়। মালটা কোন অফিসে, কিসের চাকরি করে তাও তো জানিনা। লোকগুলো এলো, জেনে নেয়ার কোনও অসুবিধেই ছিলো না। মাথাতেই আসেনি। এতসব কাগজপত্রে সই, ডকুমেন্ট হিসেবে এটা দিন, ওটা দিন, সেটা দিন, ঝ্যাপাঝ্যাপ ছবিটবি তুলে নিয়ে চলে গেলো। মাথায় একেবারেই আসেনি। মিতা কাল নিজেই বলেছিলো ওরা আসবে, তাই জিজ্ঞাসার কোনও প্রয়োজনই ছিলো না। কিন্তু এখন! যাকগে, ও যখন নিজেই ফোন করবে বলেছে, তাই করুক। একরাতের বউ হলেই বা ক্ষতি কী। একরাতের বিনা খরচের মজাটাতো আর মিথ্যে নয়। অনেক দিন খরায় ছিলাম, মিতা কাল সুদে আসলে পুষিয়ে দিয়েছে। ব্যাস। আর মনে মনে ভাবলাম বিয়ের কথাটা পুরো হজম করে ফেলতে হবে নিজের মধ্যেই।
ঠিকঠাক রোজগারহীন, ভুলভাল জীবনে যা হয়, এভাবেই মাস দুয়েক মাঝখানে খসে গেছে। হঠাৎ একদিন মাঝরাতে দেখি আমার সেই মুঠোফোন ঝনঝন কোরে তীব্র বাজছে। ফোনটা খুঁজে হাতে তুলে নিতেই দেখি মিতার সেই নাম্বার থেকে ফোনটা বাজছে। টিপে দিতেই ওপ্রান্ত থেকে এক পুরুষ গলা আমার নাম ধরে বললো--
-- আপনি মিতাদেবীর স্বামী তো?
-- হ্যাঁ, কেন, কি হয়েছে?
-- খবরটা খুবই খারাপ খবর। আমি মিতাদেবির অফিস কলিগ, হাসপাতালে শেষের দিকে ওনার দেখাশোনা আমিই করেছি। আজ রাত ১১টা ৪০ মিনিটে উনি এক্সপায়ার করেছেন। ক্যান্সারেই।
-- তার মানে ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্যেই ও' চেন্নাই গেছিলো!
-- এক্স্যাটলি। মিতাদেবি ছিলেন ফোর্থ স্টেজের পেশেন্ট। কলকাতার ডাক্তাররা বলেই দিয়েছিলেন উনি দু থেকে আড়াই মাস বাঁচবেন। ওনার অফিস কলিগ হিসেবে আমরাই একটা শেষ চেষ্টা করে বাঁচানোর জন্য ওনাকে এখানে এনেছিলাম। হলো না। যাই হোক, আপনার পক্ষে কি এখানে এতদূর এসে ওনার ডেডবডি দেখা সম্ভব!
-- একেবারেই নয়। প্লেনের টিকিট কেটে যাওয়ার মতো কোনও দুঃস্বপ্ন দেখতেই পারিনা। আপনারাই দায়িত্ব নিয়ে এ্তদিন দেখেছেন, বাকিটাও করে দিন। বডি কলকাতায় আনবার কোনও মানেই হয়না। ওখানেই জ্বালিয়ে দিন।-- তবে মিতার আপনারা কাছের মানুষ ছিলেন বলেই বলছি, একরাতের জন্য আমাকে বিয়ে কোরে স্বামীর যে সম্মানটুকু মিতা আমার মত চালচুলোহীন একজন মানুষকে দিয়ে গেল, আমার একটা প্রণাম ওকে পৌঁছে দেবেন।
ফোনের লাইনটা আমিই কেটে দিলাম। সারারাত একটা ঘোরের মধ্যে ঘুমোবার যত চেষ্টাই করছি, মাথায় শুধু ঘুরে ঘুরে আসছে ট্যাক্সির মধ্যে বসে আমার দিকে তাকিয়ে থাকা ক্লান্ত, অভিব্যাক্তিহীন মিতার সেই চোখদুটো, আর কানে দুমদাম কোরে বাজছে "আমাকে বিয়ে করবি, আজ, এক্ষুণই"...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন