শনিবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৩

প্রথম দশকের কবি রাজা - র মুক্ত গদ্য "প্রলাপ "


প্রলাপ 



কোটইয়ার্ড হোটেলের সামনে পাতলা অন্ধকার ।  সারাদিনের ক্ষোভ ঘৃণা রক্তবমি নিয়ে মুখ লুকোনোর আশ্রয়, আমাদের রাত্রিকালীন আড্ডাঘর। আমাদের মানে আমি এবং আমার তিনবন্ধু। সাহিত্যের সঙ্গে দূর দূর যাদের কোনো সম্পর্ক নেই ,নেশার ঘোর গাঢ় হতেই সেই তিনবন্ধু হঠাৎ আবদার করে বসে, " কবি, একটা কবিতা শোনা আজ দেখি।" আমি চুপ করে যাই,  পালিয়ে বাঁচার সুরঙ্গ খুঁজি।  কবি শব্দটা কেমন গালির মতো কানে এসে লাগে। আমাকে এমন নিস্তেজ হতে দেখে ওদের কী মনে হয়, বাইকে বসিয়ে সোজা রওনা দেয় রাত্রি পাহাড়ের দিকে। বনজ্যোৎ্সনায় আমরা চারজন মাতাল । মানুষ অথবা আদিম প্রেতাত্মা, অনেকক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচির পর চুপ হতে শুরু করি  ।প্রচণ্ড এক কালো নিয়ে যে যার ভেতরে নামতে থাকি। ঠিক তখনই প্রশ্ন জেগে ওঠে - কে আমি, শিল্পী নাকি নিজের গুপ্তঘাতক? 

মাঝরাতে একা একা উদ্দেশ্যবিহীন শহর পরিক্রমার মাঝে পেট্রলিং ভ্যান এসে দাঁড়ায়। একজন হাওয়ালদার গোছের পুলিশ চেঁচিয়ে ওঠে "এত রাতে এখানে কী করছিস!" গাড়িতে বসে থাকা অফিসারকে বলে "স্যার মনে হচ্ছে ড্রাগ কেস আছে।" অফিসার মুখ বের করে আমার দিকে হাত নাড়ায়, একটু হাসে। এর আগে আরও দুতিনবার উনি আমাকে এইভাবে দেখেছেন । এবং বহু  জিজ্ঞাসার পর নিশ্চিত হয়েছেন আমার কোমড়ে কোনোরকম বোমা বাঁধা নেই। ড্রাইভারকে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে হাওয়ালদারকে বলেন " এটা কবি কেস, উঠে পড়ুন। " আবার সেই কবি শব্দ ধারালো গালির মতো শুনতে লাগে। কে আমি কবি নাকি দালাল? এই প্রশ্ন নিয়ে যতবার খাদের দিকে পা বাড়িয়েছি  কে যেন এক বিশাল কবিতার উৎসবের মাঝে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আমাকে। আমি খুব সাবধানে দর্শকাসনের একেবারে শেষে গিয়ে বসি । আর চশমার কাচ মুছতে গিয়ে দেখতে পাই, আলো ঝলমল মঞ্চে সুসজ্জিত কেউ শব্দের জাগলারি শোনাচ্ছে। ক্রমশ সেই শব্দ ফ্যাকাশে হয়ে আসে । রঙ্গমঞ্চের পেছনের দেয়াল সরে ফিনফিনে এক পর্দা হয়ে যায় । সেই পর্দার অস্তিত্ব থাকে না একসময় । একটা ভাঙাচোরা সংসার এসে দাঁড়ায় । দূষিত তুলসী তলার নীচে শোয়ানো থাকে বাবার মৃতদেহ । যে দেহ একবার কাঁধে তুলে নেওয়ার পর আজও নামাতে পারিনি। কবিতা অনুষ্ঠানের ঘোষক  জানেনা এইসব। জানেনা জন্মদাতার চিতায় আসলে লম্পট সন্তানও পোড়ে, ভেতরে ভেতরে আজীবন।জানেনা বলেই এখনই ঘোষণা করা হবে আমার নাম।পালিয়ে বাঁচার পথের কথা ভাবতে ভাবতে আমি অন্য ডায়মেনশনে ঢুকে পড়ি।  এখানে অতীত আমার জন্মদাগ ধরে বেনামি নদী হয়ে গেছে। বর্তমান মানেই মেঘ আর আগামীর নাম গন্ধ। 

পলিমাসির গায়ে কী এমন গন্ধ ছিল যাকে অতিক্রম করে আর শিউলি তলায় যাওয়া হয়নি! ফেরা হয়নি জোনাকি মিশ্রিত ছেলেবেলার কাছে!স্মৃতির গন্ধ নিয়ে আমি মেঘের মতো সরে সরে যাই, বেনামি নদীর সঙ্গে ভাসি। কে আমি স্মৃতিবিলাসী নাকি প্রবীণ এক বহুরূপী?

করোনেশন ব্রীজ থেকে  তিস্তায় উড়িয়ে দিই এইযাবৎ সমস্ত লেখা। কোথায় থাকে শব্দের ব্রহ্ম? কীভাবে জন্ম হয় গোটা জীবনের একমাত্র কবিতার?  কেন অপঘাতে মরে যাই আমি প্রতিটি লেখার শেষে? মূক ও বধির পথচারীর কাছে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করি। ভুল গন্তব্য আরও নতুন বিপথ খুলে দেয়।আমি হাঁটি অজানার দিকে ,অব্যক্তের প্ররোচনায় । ক্লান্ত ঝালমুড়ি ওয়ালার উদাস দৃষ্টি যতদূর দেখতে পায় ,তারও অনেক দূর আমি উন্মাদ হাঁটতেই থাকি। কে আমি , আত্মহত্যা প্রবণ মানুষ নাকি ভ্রষ্ট পথচারী,যে কিনা প্রতিনিয়ত দূরবীন হাতে অপেক্ষা করে আছে -একদিন অবিশ্বাসের ঈশ্বর নিভিয়ে দেবে জগতের সমস্ত কবিতা মঞ্চের আলো,কেউ আর কখনও কবি নামক গালি ছুঁড়ে দেবে না বাতাসে



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বনিক

  উৎসব সংখ্যা -২০২৩ প্রচ্ছদ শিল্পী - রিন্টু কার্যী সম্পাদক- শৌভিক বণিক উৎসবের আর মাত্র কয়েকটা দিন, একদম হাতে গোনা।  আর উৎসব  সংখ্যা ছাড়া উৎ...